চাহিদা বাড়ছে সুপারি পাতার পণ্যের, বড় বিনিয়োগ ও রপ্তানির আশা
ঝরে পড়া সুপারি গাছের পাতা। সেই পাতা কুড়িয়ে এনে ধুয়ে-মুছে সাফ করে রোদে শুকানো হয়। এবার পাতাটি যন্ত্রের ছাঁচে রেখে নির্দিষ্টমাত্রার তাপমাত্রা দিলেই তৈরি হয়ে যায় পরিবেশবান্ধব নানান ক্রোকারিজ।
অনেকের কাছে ফেলনা সুপারি পাতার এই ক্রোকারিজই এখন হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতন চেইন রেস্টুরেন্ট মালিকরা ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প হিসেবে এই পণ্যের ব্যবহার বাড়িয়েছেন এখন। কেননা এই পণ্য শতভাগ প্রাকৃতিক, বায়োডেগ্রেডেবল, কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক মুক্ত, কম্পোস্টেবল এবং ডিসপোজেবল।
চাহিদা বাড়ায় দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন এখানে বড় বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছেন। বর্তমানে দেশের ছোট-বড় প্রায় ৩০ প্রতিষ্ঠানে সুপারি পাতার ক্রোকারিজ সরবরাহ করে আসছে চট্টগ্রামের ইকোভ্যালি বিডি।
দেশের নামকরা চেইন শপ ও রেস্টুরেন্টের মধ্যে বর্তমানে ঢাকার মিঠাইওয়ালা, মাদল, চট্টগ্রামের ক্লাউড সিটি, কক্সবাজারের কোরাল স্টেশন, শালিক ইত্যাদি ইকোভ্যালির পণ্য ব্যবহার করছে। এর মধ্যে মিঠাইওয়ালা প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার পিস ও কোরাল স্টেশন ২০ হাজার পিস পণ্য নিচ্ছে।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ফুড ফ্যাক্টরি, ওয়েল স্টুডিওসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পণ্যটির ব্যবহার শুরু করেছে। এছাড়া স্যান্ডি বিচ, সি ল্যান্ড, ডি ভাইন ইকো রিসোর্ট, মারমেইডসহ দেশি-বিদেশি কমপক্ষে আরো ৫০টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পণ্য বিক্রির আলোচনা চলছে।
করপোরেট প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুইজন ডিলারের মাধ্যমে এই পণ্য বাজারজাত করে আসছে ইকোভ্যালি।
বর্তমানে ইকোভ্যালি খাবারের প্লেট, বাক্স, বাটি, নাস্তার প্লেট, বুফে প্লেট, পিৎজার ট্রে, কমন ট্রে, সস কাপ ও চায়ের কাপসহ ১৫ ধরণের পণ্য তৈরি করছে।
২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সুপারি পাতা থেকে ক্রোকারিজ পণ্য উৎপাদন শুরু করে চট্টগ্রামের ইকো ভ্যালি বিডি। ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে একটি মেশিন থেকে প্রায় ৮ লাখ টাকার পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।
চলতি বছরের গেল ১১ মাসে প্রায় এক লাখ পিস পণ্য উৎপাদন হয়েছে। যাতে আয় হয়েছে আট লাখ টাকার বেশি। কারখানাতে এই পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। ইকোভ্যালিতে বর্তমানে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বর্তমানে ইকোভ্যালি বছরে এক লাখ সুপারি পাতা ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করছে। আগামী বছর দেড় লাখের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে বাজারে থাকা প্রতিটি প্লাস্টিক প্লেটের দাম ৭ টাকা। তার চেয়ে একটু বেশি দামে অর্থাৎ মাত্র ১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব খাবার প্লেট। আরো নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলে এবং বড় পরিসরে উৎপাদন হলে খরচ আরো কমে আসবে।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে (২০২০-২১ অর্থবছর) ৪৭ হাজার ৫৫৬ হেক্টর জমিতে সুপারি আবাদ হয়। দেশের লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট, নোয়াখালী, ভোলা ও কক্সবাজারের টেকনাফে সবচেয়ে বেশি সুপারি গাছ রয়েছে। যেখানে প্রতিমাসে বিলিয়ন বিলিয়ন সুপারি পাতা পড়ে।
ইকোভ্যালির উদ্যোক্তা প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, 'একটা সুপারি পাতা বাগান থেকে সংগ্রহ করতে খরচ পড়ে ৫০ পয়সা। যা পরিবহন ভাড়া, পরিষ্কার করা, শুকানো ও কারখানা পর্যন্ত পৌঁছতে ৩ টাকা খরচ পড়ে। একটি পাতা দিয়ে অনায়াসেই তিনটি পণ্য তৈরি সম্ভব। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে একটি প্লেট বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা। সেই হিসেবে একটি পাতা থেকে আয় ১৮ টাকা।'
তিনি আরো বলেন, 'এই ব্যবসায় প্রফিট মার্জিন খুব ভালো। যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলে কাঁচামালের অভাব নেই। তাই দেশে এই খাতে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা সম্ভব। যেখান থেকে ভালো রেমিট্যান্স আসতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা। বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ওয়ার্কারদের বসে থাকতে হয়।'
ইকোভ্যালির দুই উদ্যোক্তার মধ্যে একজন মো. আমিনুল ইসলাম বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৌশলী। অপরজন মো. কামাল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্কুল শিক্ষক।
কিভাবে এই খাতের ব্যবসা শুরু এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, 'কর্ণফুলী নদী পার হয়ে শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরিতে যেতাম প্রতিদিন। নৌকা দিয়ে যাতায়াতের সময় কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ে পলিথিন উত্তোলনের চিত্র দেখে খুবই খারাপ লাগে। আগে থেকেই আমাদের একটা চিন্তা ছিল- প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা পরিবেশকে যেভাবে নষ্ট করছি তা নিয়ে কিছু করার।
করোনা লকডাউনের সময়ে সুপারি পাতা দিয়ে ক্রোকারিজ তৈরির বিষয়টি মাথায় আসে বলে জানান প্রকৌশলী এম মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'তখন বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে কাজ করি। দুজনে ইন্টারনেটে সার্চ করে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সুপারি পাতার ক্রোকারিজ পণ্যের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারি। বিশেষ করে ইন্ডিয়ার তামিলনাডু এবং চেন্নাইতে এটি একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেখান থেকে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আমেরিকাতে প্রচুর পরিমাণ রপ্তানি করছে। আমরা চিন্তা করেছি- আমাদের তো প্রচুর কাঁচামাল রয়েছে। তাহলে আমরা কেন চেষ্টা করব না।'
এরপরই দক্ষিণ ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এস এস ইঞ্জিয়ারিং নামের একটি কারখানা থেকে যন্ত্র আমদানি করেন তারা। ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় স্বপ্নের পথচলা।
শুরুতে অবশ্য বেশ বাঁধার মুখে পড়েন উদ্যোক্তারা। ভোলায় সুপারি গাছের পাতা সংগ্রহের খোঁজ নিতে গেলেই আত্মীয়স্বজনেরা বলতে শুরু করেন-'পাগল'। আবার তাদের নিজস্ব কোনো বাজার না থাকায় সমস্যায় পড়েন। সেসব বাঁধা কাটাতে তাঁরা বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে। সেখানে পেজ খুলে পণ্যগুলোর প্রচার চালান। তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী সেই পণ্য নিয়ে আগ্রহ দেখান।
ওই তরুণেরা প্লেটগুলো আট-দশ টাকায় কিনে পেইন্ট করে ১৫০-২০০ টাকায় অন্য জায়গায় বিক্রি করতেন। এরপর কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এমনকি জাপান, নেদারল্যান্ডস, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মান ও কানাডা থেকেও তারা ভালো সাড়া পান। তবে ব্যবসার প্রসার পেতে শুরু করে ২০২১ সালের মার্চে। ওই মাসে ঢাকার মিঠাইওয়ালা, সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের কোরাল স্টেশন ও নভেম্বর থেকে শালিক পণ্য নেয়া শুরু করে।
উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধীরে ধীরে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন দুই উদ্যোক্তা। যুক্ত করেন আরও একটি যন্ত্র। কারখানার জন্য ভোলাতে কিনেছেন ৫০ শতক জমি। এখন তাদের নিজেদের উপযোগী করে স্বয়ংক্রিয় মেশিন বানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এখনো উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সেজন্য আগামী বছর এক কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে ইকো ভ্যালির। এজন্য অর্থসংস্থানের বিষয়ে কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তারা। এখন একটি শেড নির্মাণ করে যন্ত্রপাতি বাড়ালেই উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের বাইরেও রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন।
উদ্যোক্তাদের আরেকজন মো. কামাল জানিয়েছেন তারা বৈশ্বিক সংকট কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, 'এখন আমদানি-রপ্তানিতে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা আছে। এই মুহুর্তে তাই বড় বিনিয়োগে যাব কি না তা নিয়ে ভাবছি। অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়ালে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে কারখানার কাজ শুরু করব।'
ইকোভ্যালি ছাড়াও লক্ষীপুরে ব্রাদার্স ইকো ক্রাফট নামে একটি প্রতিষ্ঠান সুপারি পাতা দিয়ে ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি করছে।