আইসিসিকে ইসরাইল ও তার মিত্রদের ভয় পাওয়ার কারণ কি?
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ছত্রছায়ায় দীর্ঘকাল থেকে ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখণ্ডে অবাধে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের গণমাধ্যমে একটি খবর ভেসে বেড়াচ্ছে। তা হলো ইসরায়েলের শীর্ষ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এবার গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মুখে পড়তে পারেন।
এ নিয়ে ইসরায়েলি নেতৃত্বের মাঝে উদ্বেগের ছাপ দেখা যাচ্ছে।
ইসরায়েলের গণমাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, এই সপ্তাহের মধ্যেই সম্ভাব্য এই পরোয়ানা জারি হতে পারে। এ অবস্থায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পরোয়ানা ঠেকাতে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক আদালতের ওপর চাপ প্রত্যাশা করছে।
অবশ্য আল-জাজিরা তার নিজস্ব উৎসের মাধ্যমে পরোয়ানাসংক্রান্ত তথ্যটি যাচাই করতে পারেনি।
গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স এ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ নিয়ে গাজার গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছে আইসিসি কর্তৃপক্ষ।
গাজা, অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ২০১৪ সালের পর ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়ে ২০২১ সালের মার্চ মাসে তদন্ত শুরু করে আইসিসি। ওই সময় আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ছিলেন ফাতোউ বেনসোদা।
গত বছরের নভেম্বরে বিষয়টি আবারও আদালতের নজরে আনে বাংলাদেশ, বলিভিয়া, কমোরোস, জিবুতি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর বর্তমান প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে জবাবিদিহির আওতায়র আনার ঘোষণা দেন এবং তিনি গত অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি সহিংসতাকে তদন্তের অন্তর্ভুক্ত করেন।
এর ঠিক মাসখানেক পর ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীর সফরে গিয়ে করিম খান বলেন, গত ৭ অক্টোবরের পর হামাস ও ইসরায়েলের অপরাধ তদন্তে কাজ করছেন আদালত।
কিন্তু তিন বছর ধরে চলা একটি তদন্ত, কেন ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হঠাৎ করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তা কিছু প্রশ্ন উঠেছে।
ইসরায়েল এবং আইসিসি
আইসিসি প্রতিষ্ঠার রোম সনদে সই করেনি ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারাও এর প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়ে কোনো তদন্ত চালাতে পারে না সংস্থাটি। সদস্যভুক্ত দেশের ওপরই শুধু এর কর্তৃত্ব রয়েছে।
তাই সদস্য রাষ্ট্রে কোনো অপরাধ ঘটলেও সংস্থাটি তদন্তকাজ চালাতে পারে। ২০১৫ সালে ফিলিস্তিন এই সংস্থাটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সেই অনুযায়ী, গাজা বা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা কিংবা নেতৃত্বকে অভিযুক্ত করে অপরাধ তদন্ত করার পাশাপাশি যেকোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধেই পরোয়ানা জারির ক্ষমতা রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
ইসরায়েলি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলেছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং সেনাপ্রধান হারজি হালেভির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হতে পারে। সত্যিই এই পদক্ষেপ নেওয়া হলে, তা তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতানিয়াহু বলেন, আইসিসির তার দেশের আত্মরক্ষার অধিকারকে নস্যাৎ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টাকে আমলে নেবে না ইসরায়েল।
আইনি বিশেষজ্ঞরা আল-জাজিরাকে জানান, গাজার বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখতে ইসরায়েলের খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার নীতি এবং হামাসের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবর অতর্কিত হামলার সময় ইসরায়েলিদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রুটগার্স ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক আদিল হক বলেন, দুই পক্ষের শীর্ষ নেতৃত্বকে এই দুটি অভিযোগের আওতায় আনা হবে।
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। উপত্যকায় এখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষের প্রায় সম্পূর্ণই বাস্তুচ্যুত।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে ১ হাজার ১৩৯ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। সংগঠনটি সেদিন আড়াইশ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ক্রমাগত আত্মরক্ষার কথা বলে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
গাজায় চলতি আগ্রাসনের কারণে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আরেকটি আদালত (জাতিসংঘের আদালত বলে স্বীকৃত) আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গণহত্যার অভিযোগের মুখে পড়েছে ইসরায়েল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইসিসির অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে গাজা যুদ্ধের বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়বে ইসরায়েল। এছাড়া রোম সনদে স্বাক্ষরকারী ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কের জটিলতা তৈরি হবে ইসরায়েলি নেতৃত্বের।
'ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনস'-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হিউ লোভাট বলেন, বিষয়টি আইসিসি ও ইসরায়েলের পাশাপাশি, দেশটির মিত্রদের জন্যও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।কারণ এর মধ্য দিয়ে গাজায় ইসরায়েলের কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ড আরও স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আইসিসির সম্ভাব্য পদক্ষেপের কেন্দ্রে থাকছে তিন ইসরায়েলি। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য সবচেয়ে বড় বিপত্তিতে পড়তে পারেন নেতানিয়াহু নিজে। দুর্নীতির অভিযোগে ভাবমূর্তির সংকটের পাশাপাশি ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণ ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতার দুর্নামের কারণে তার রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ যখন একদম দোরগোড়ায়, তখন আইসিসির সম্ভাব্য পদক্ষেপ তাকে আরও বিড়ম্বনায় ফেলবে।
সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না; কারণ সেখানকার সব দেশই রোম সনদের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করতে দায়বদ্ধ।
এ বিষয়ে আদিল হক আরও বলেন, '১২০টির মতো দেশে তিনি (নেতানিয়াহু) পা রাখলে তাকে ওইসব দেশ গ্রেপ্তার করতে দায়বদ্ধ থাকবে। এছাড়া এমনও কথা রয়েছে যে, কোনো দেশ আইসিসির সদস্য না হলেও, তারা তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে।'
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও কিংস কলেজ লন্ডনের প্রভাষক আলোনসো গুরমেন্দি ডানকেলবার্গ বলেন, ইসরায়েল দাবি করে যে তাদের সেনাবাহিনী 'বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী' এবং ফিলিস্তিনিরা 'বিশৃঙ্খল ও সহিংস এবং রাষ্ট্রহীন কিছু মানুষ; যারা অন্যায়ভাবে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে'।
ডানকেলবার্গ বলেন, 'এই যুদ্ধে ইসরায়েলের সব দাবি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। একদিকে আইসিজে'তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করা হচ্ছে, আরেকদিকে আইসিসি'তেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। দুই দিক মিলে ইসরায়েল চরম চাপে পড়তে পারে।'
দ্বৈতনীতি
লোভাটের মতে, ইসরায়েলি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইসিসির সম্ভাব্য পরোয়ানা ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করবে।
তিনি বলেন, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার-আইনের শাসনের প্রতি সমর্থন করেন, তাই ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যতিক্রমধর্মী সম্পর্কের ভারসাম্য তৈরিতে বাধ্য হবে ইউরোপীয়রা।
তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন, ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনে বর্বরতার অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমিরি পুতিনের বিরুদ্ধে জারি হওয়া পরোয়ানাকে সমর্থন করছেন। এখন এই নেতারা কীভাবে ইসরায়েলি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইসিসির একই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা কিংবা সমালোচনা করবেন?
তিনি আরও বলেন, ইউরোপীয়রা যদি আরও একবার ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহির আওতায় আনতে বাধা দেয়, তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, পশ্চিমা বিশ্ব দ্বৈতনীতির খেলা খেলছে এবং তা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে অবমূল্যায়ন করবে। আর গোটা পরিস্থিতির ওপরই নজর রয়েছে দক্ষিণ বিশ্বের (গ্লোবাল সাউথ) দেশগুলোর।
ডানকেলবার্গ আরও বলেন, সম্ভবত আইসিসির সনদে সহকারী ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো মিত্ররা ইসরায়েলি নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার না-ও করতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি হলে তা আদালতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হবে।
তবে এই ধরনের ঘটনা একেবারে নজিরবিহীন নয়।
২০০৯ সালে সুদানের তৎকালীন সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করলেও আফ্রিকার দেশগুলো আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ওই সময় ইউরোপীয় নেতৃত্ব ও অধিকার সংস্থাগুলো আফ্রিকার দেশগুলোর সমালোচনা করেছিল।
ডানকেলবার্গ মনে করেন, তবে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলো দ্বৈতনীতি সম্পর্কে খুব সচেতন।
তবে ইউরোপ যদি ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইসিসির কোনো গ্রেপ্তারি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে আদালতকে চাপের মুখে পড়তে হতে পারে।
এ নিয়ে ডানকেলবার্গ বলেন, 'এমন একটি নজিরও স্থাপন হতে পারে যে, তারা রোম সনদ সইকারীরা আইসিসির গ্রেপ্তারের আদেশ খারিজ করে দিতে পারে বা আদালত থেকে নিজেদের নামও প্রত্যাহার করে নিতে পারে।'
তিনি বলেন, 'ইসরায়েল কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে গেলে, সেটি হবে কফিনের শেষ পেরেক। এটি আইসিসির জন্য বৈধতার চরম সংকট তৈরি করবে। ভন্ডামিপূর্ণ আচরণের জন্য ইউরোপকে রাজনৈতিক মূল্য চুকাতে হবে।'