সুপারি পাতার ক্রোকারিজ এখন সম্ভাবনাময় খাত, দুই বছরে প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে ১৮টি

দেশে সুপারি পাতা থেকে ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি শুরুর গল্প বেশিদিনের না। মাত্র আড়াই বছর আগে করোনাকালীন সময়ে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব এই পণ্য তৈরি শুরু করেন চট্টগ্রামের দুই বন্ধু।
খুব শঙ্কার মধ্য দিয়ে প্রতি মাসে মাত্র ৭-৮ হাজার পিস ক্রোকারিজ পণ্য উৎপাদন করতো এই দুই বন্ধুর প্রতিষ্ঠান ইকোভ্যালি বিডি, যা এখন মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার পিস ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি করছে।
শুরুতে খুব কষ্ট করে ভারত থেকে পণ্য উৎপাদনের মেশিন আমদানি করলেও এখন এই দুই বন্ধুই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে মেশিন সরবরাহ করছে।
বর্তমানে দেশে অন্তত ১৮ জন উদ্যোক্তা সুপারি পাতা থেকে ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি ও বিপণনের ব্যবসা করছে। এরমধ্যে ৬ জন উদ্যোক্তা ইকোভ্যালির তৈরি মেশিন সহ সব ধরণের প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এসব মেশিনের প্রতিটি থেকে ১-২ লাখ টাকা মুনাফা করছে ইকোভ্যালি বিডি।
ইকোভ্যালি বিডি'র উদ্যোক্তা প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, "ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের বিপরীতে পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের চিন্তা থেকে আড়াই বছর আগে আমরা সুপারি পাতা থেকে পণ্য তৈরি শুরু করি। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ভারত থেকে মেশিন আমদানি করে পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করতে হয়েছে। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে এই খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সারা দেশে ১৮ জন উদ্যোক্তা সুপারি পাতার ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি করছে। এরমধ্যে গত এক বছরেই ১৫ জন উদ্যোক্তা এই খাতে ব্যবসা শুরু করেছে।"
"আগে বিদেশ থেকে মেশিন আমদানি করে পণ্য তৈরি করলেও এখন আমরা নিজেরাই মেশিন তৈরি করছি। বিদেশ থেকে মেশিন আমদানি করতে আগে ১১-১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন তা দেশেই মাত্র ৮ থেকে ৯ লাখ টাকায় তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া দেশে তৈরি এই মেশিন আমদানিকৃত মেশিন থেকে অনেক উন্নত। মেশিন বানাতে আমরা ডিজাইন সহ প্রযুক্তিগত সহায়তা করি। ওয়ার্কশপের মেকানিকরা তা বাস্তবায়ন করে।"
ইকোভ্যালি বিডি এ পর্যন্ত ভোলার ইকো কেয়ার বিডি, ইকো ড্রিমস বিডি, রায়পুরের ব্রাদার্স ইকো ক্রাফট এবং চট্টগ্রামের অ্যারেকা এক্সপোর্ট বিডিতে মেশিন সরবরাহ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বর্তমানে দিনে এক হাজারের বেশি ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি করছে।
এছাড়া ফিরোজপুর, বাগেরহাট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়, কক্সবাজার, লক্ষীপুর ও শরীয়তপুরে আরো ৯টি কারখানা সুপারি পাতার ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি করে চলেছে।
প্রতিষ্ঠানটির অপর উদ্যোক্তা মো. কামাল জানান, "ভোক্তাদের কাছে কদর বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এখন পণ্যটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফলে এখন আমাদের পণ্যটির প্রচারে খুব বেশি সময় দিতে হচ্ছে না। তাই আমরা এখন উদ্যোক্তা তৈরিতে বেশি কাজ করছি। কেননা দেশে যেভাবে পণ্যটির চাহিদা বাড়ছে আমরা সেভাবে যোগান দিতে পারছি না। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ক্রেতা পণ্যটি কিনতে আগ্রহ দেখালেও উৎপাদন সক্ষমতা কম থাকায় আমরা রপ্তানি করতে পারছি না। তাই আমরা উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে সমবায় ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।"
স্বাভাবিক উৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমানে দেশের একটি কোম্পানির জন্য ৩ কোটি পিস চামচ তৈরি করছে ইকোভ্যালি বিডি। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অর্ডারটি নিশ্চিত হলেও একটি দই প্রক্রিয়াজাত কোম্পানির জন্য এই চামচ বানানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
দেশের ১৫-১৮টি কারখানায় বর্তমানে মাসে কমপক্ষে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ ক্রোকারিজ পণ্য তৈরি হচ্ছে, যা বছরে অর্ধকোটি পণ্যের সমতুল্য।
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে (ওয়ালিমা) সুপারি পাতার এই ক্রোকারিজ পণ্য ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ওই অনুষ্ঠানের আয়াজক হুমায়ুন কবির বলেন, "ওয়ালিমাতে প্রায় হাজারো মানুষের খাবারের আয়োজন ছিল। গ্রামে ডেকোরেটরগুলো সাধারণত প্লাস্টিক কিংবা মেলামাইন ক্রোকারিজ ব্যবহার করে। নতুন একটি সংস্কৃতি যোগ হয়েছে ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের ক্রোকারিজ। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুপারি পাতার ক্রোকারিজের খবর পাই। তাই একটু ব্যয় বেশি হলেও আমরা এই পণ্য ব্যবহার করি।"
২০২১ সালের শুরুর দিকে সুপারি পাতা থেকে ক্রোকারিজ পণ্য উৎপাদন শুরু করে চট্টগ্রামের ইকো ভ্যালি বিডি। এ পর্যন্ত ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। ইকোভ্যালিতে বর্তমানে ২০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে বাজারে থাকা প্রতিটি প্লাস্টিক প্লেটের দাম ৭ টাকা। তার চেয়ে একটু বেশি দামে অর্থাৎ মাত্র ১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব খাবার প্লেট। তাছাড়া এটি শতভাগ প্রাকৃতিক, বায়োডিগ্রেডেবল, কম্পোস্টেবল, ওভেনে ব্যবহারোপযোগী, পানি নিরোধী, ফ্রিজে রাখার উপযোগী, এবং ব্যবহারের সময় খাবার বা পানীয়ের সাথে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
এই খাতের উদ্যোক্তারা জানান, একটা সুপারি পাতা বাগান থেকে সংগ্রহ করতে খরচ পড়ে ৫০ পয়সা। যা পরিবহন ভাড়া, পরিষ্কার করা, শুকানো ও কারখানা পর্যন্ত পৌঁছতে ৩ টাকা খরচ পড়ে। একটি পাতা দিয়ে অনায়াসেই তিনটি পণ্য তৈরি সম্ভব। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে একটি প্লেট বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকায়। সেই হিসেবে একটি পাতা থেকে আয় ১৮ টাকা।
সুপারি পণ্যের ক্রোকারিজ তৈরিকে একটি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে সংশিষ্টদের সহযোগিতা কামনা করেছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, এই খাতে উদ্যোক্তা তৈরি এবং বিনিয়োগ বাড়াতে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা সহ বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে দিতে হবে। পণ্য রপ্তানিতে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কমপক্ষে ৫০টিরও বেশি নামকরা চেইন শপ ও রেস্টুরেন্ট নিয়মিত সুপারি পাতার ক্রোকারিজ পণ্য ব্যবহার করছে। এছাড়া স্থানীয় ক্রোকারিজ মার্কেটেও এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। খাবারের প্লেট, খাবারের বক্স, বাটি, নাস্তার প্লেট, বুফে প্লেট, পিৎজার ট্রে, কমন ট্রে, সস কাপ, চায়ের কাপ ও চামচ সহ ২০ ধরণের পণ্য তৈরি করছেন উদ্যোক্তারা।