একদিকে অসহনীয় গরম আরেকদিকে বিষধর সাপ: ধানের মাঠে কৃষকের দীর্ঘ এপ্রিল
তালগাছের নিচে বসে ছিলেন সোহরাব হোসেন। খরতপ্ত দুপুরে বিস্তীর্ণ ধানখেতের মধ্যে সোহরাব ও তার দুই শ্রমিকের একমাত্র আশ্রয়স্থল মাঝে মাঝে মৃদু বাতাসে এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকা এসব তালগাছই।
তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম তাপপ্রবাহে এরচেয়ে অনেক বেশি তাপের অনুভূতি হচ্ছিল।
এখন ভরা বোরো মৌসুম, ধান কাটার গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু আমরা পুরো মাঠে শুধু এই তিনজনকেই পেলাম। তালগাছের ছায়ায় বসে দরদর করে ঘামতে ঘামতে আবার জমিতে কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন তারা।
ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের লবণকোটা গ্রামের কৃষক সোহরাব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এমন গরমে কাজ চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কষ্ট।'
তিনি জানান, 'আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে মাঠে কাজ করছি। আগে কখনও এমন গরম পড়েনি। শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রচুর পানি, স্যালাইন এসব খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি আমরা।'
জ্বলন্ত সূর্যের নিচে বসে আমাদের কথোপকথন চলছে। একপর্যায়ে সোহরাবকে জিজ্ঞেস করলাম, বছরের পর বছর ধরে ক্রমেই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তিনি অনুভব করছেন কি না। জবাবে সোহরাব বললেন, 'এটা সত্যি। আমার মনে আছে, গত বছর সবাই বলাবলি করছিল তারা আগে কখনও এমন গরম দেখেনি। আর গত বছরের তুলনায় এ বছর গরম অনেক বেশি।'
বেশিরভাগ জমিতেই ধান কাটার উপযোগী হয়ে উঠেছে। তার মানে, কৃষকদের জন্য এখন ব্যস্ত সময় চলছে। কিন্তু তারপরও মাঠে অন্য কোনো কৃষক নেই কেন, জানতে চাইলে সোহরাব বললেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে কৃষকরা দিনের বেলা কাজ করতে পারেন না। আগেরদিন রাতে তারা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ধান কেটেছেন।
তবে কৃষকরা সাপের ভয়ে রাতের বেলায় তাদের কাটা ফসল কাঁধে করে আইল দিয়ে চাতালে নিয়ে যেতে পারেননি।
খানিক বাদে স্থানীয় খালের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় ওই এলাকায় মারাত্মক বিষধর সাপের উপস্থিতি দেখতে পেলাম আমরা। আমরা যে আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তার ঠিক পাশেই বিশ্রাম নিচ্ছিল অত্যন্ত বিষধর সাপ কালকেউটে। কমন ক্রেইট বা বেঙ্গল ক্রেইট নামে পরিচিত এই সাপ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের দেখা যায়।
প্রচণ্ড গরমের কারণে এই মৌসুমে বিষধর সাপের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা স্বাভাবিক। কালকেউটেটা যেখানে বিশ্রাম নিচ্ছিল, সেই আইলের পাশে আমরা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাপটি লাফিয়ে ধানখেতে পড়ল। সাপটাকে দেখে আমরা ভয়ে আঁতকে উঠলাম। এর আগে অনেক ছবিতে কালকেউটে দেখেছি, কিন্তু প্রথম সরাসরি সাক্ষাতে কালোর মধ্যে প্রায় ৪০টি সাদা ডোরাকাটা দাগযুক্ত সাপটিকে অনেক বেশি সুন্দর লাগল।
এই সাপের জন্যই কৃষকরা দিনের আলোতে আইল দেখতে দেখতে মাঠ থেকে চাতালে ধান নিয়ে যাচ্ছিলেন।
সোহরাবের জমিতে কাজ করেন সুমন। তিনি নেত্রকোনা থেকে এখানে এসেছেন কাজ করতে।
সুমন বললেন, 'এ গরম অসহ্য। এই মৌসুমে আমাকে জ্বর, কাশি ও সর্দিতে ভুগতে হয়েছে। প্রতিদিন আমার ভীষণ মাথাব্যথা করে।'
তিনি আরও বলেন, 'সব শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এ কারণেই বেশিরভাগ শ্রমিক এখন ধানখেতে কাজ করতে চান না।'
আরেক শ্রমিক মানিক জানালেন, গত কয়েক বছর ধরে তিনি মাঠে কাজ করছিলেন না, এ বছর ফের জমির কাজে এসেছেন। কিন্তু এই গরম তাকে রীতিমতো 'মেরে ফেলছে'। তাই মাঠের কাজে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা তার কাছে ভুল বলে হচ্ছে।
সোহরাব জানান, কাজ করানোর জন্য শ্রমিক পাওয়া সত্যিই ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, 'দৈনিক এক হাজার টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এই গরমে মানুষ কাজ করতে চায় না। যে খরচ হয়, তা বিবেচনায় ধান চাষ এখন পুরোপুরি লোকসানি প্রকল্প।'
ভালুকা-৬ ইউনিয়নের খড়ুয়ালী গ্রামের কৃষক সিদ্দিক আখন্দ তার মেয়ে ও নাতনিসহ পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্যকে নিয়ে ধান কাটছিলেন।
সিদ্দিক বললেন, 'শ্রমিক পাওয়া কঠিন। গরম শুধু বাড়ছেই। রোদের নিচে এভাবে কাজ করা সম্ভব? আমার এখানে তিন কাঠা জমি আছে, আরও অনেক ফসল কাটা বাকি। চাল কীভাবে বাড়িতে নিয়ে যাব, সেই চিন্তায় আছি।'
লবণকোটায় সোহরাবের স্ত্রী পারভীন বেগম দুই জগ পানি আর ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে মাঠে এসেছেন।
আমাদের শরবত দিলেন তিনি। প্রচণ্ড গরমে সানন্দে সেই শরবত গ্রহণ করলাম আমরা।
পারভীন বলেন, 'অসহ্য গরম, কারেন্টও নেই। কাজে আনা সব শ্রমিক একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পর্যাপ্ত লোক নেই বলে আমাকেও মাঠে কাজ করতে হবে।'
জলবায়ু পরিবর্তন কী অথবা এটি কীভাবে তাদের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে, তা জানেন না কৃষকরা। তারা শুধু চান বৃষ্টি; এমনকি এতে যদি তাদের ফসলের কিছুটা ক্ষতিও হয়, তাতেও কোনো আপত্তি নেই।
পারভীন বেগম বলেন, 'বৃষ্টিতে যদি দুনিয়াটা একটু ঠান্ডা হয়, তাহলে আমাদের শ্রমিকরা স্বস্তিতে কাজ করতে পারতেন।'