ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়া নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে
চার মাস আগে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর পর রুশ বাহিনীর সেরা সময় কাটছে এখন।
লুহানস্ক অঞ্চলের অধিকাংশ ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা। দক্ষিণের একটি বেল্টে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। নিজেদের রসদ ও কমান্ড কাঠামো শক্তিশালী করেছে এবং ইউক্রেনীয় ড্রোনের হামলার কার্যকারিতা ভোঁতা করে দিয়েছে।
গত সপ্তাহেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর দখলে থাকা লুহানস্কের অবশিষ্ট অংশে অবিরল বোমাবর্ষণের পুরস্কার পেয়েছে রুশ বাহিনী। রুশ হামলার তীব্রতায় ইউক্রেনীয় বাহিনী শেষ পর্যন্ত সেভেরোদোনেৎস্ক ছাড়তে বাধ্য হয়েছে; লিসিচানস্কের দক্ষিণাঞ্চলও হারিয়েছে।
লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের প্রধান লিওনিড পাসেচনিক গত শুক্রবার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, রুশ বাহিনী দু-তিন দিনের মধ্যে লিসিচানস্ককে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলবে। কাজটা এখনও না করলেও লিসিচানস্ক আশু বিপদে রয়েছে।
দোনেৎস্ক অঞ্চলেও আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে রুশ বাহিনী। এ অঞ্চলের শিল্প শহরগুলোর দিকে—যা স্লোভিয়ানস্ক থেকে ক্রামতোর্স্ক হয়ে কোস্তিয়ানতিনিভকা পর্যন্ত দক্ষিণে চলে গেছে—আরেকটু অগ্রসর হয়েছে রুশ সেনারা।
যেরকম তীব্র গোলাবর্ষণের মুখে সেভেরোদোনেৎস্ক থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, লিসিচানস্কসহ আরও পাঁচ অঞ্চলের বহু শহরে ইউক্রেনীয়দের একই নিয়তির মুখে পড়তে হতে পারে। সেভেরোদোনেৎস্কে রক্ষা করার মতো আক্ষরিক অর্থেই কিছু ছিল না।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য এই মুহূর্তের উভয়সংকট হলো, লিসিচানস্ককে ঘেরাও করা হলে সৈন্য ও অস্ত্র হারানোর ঝুঁকি নিয়ে শহরটিকে রক্ষা করবে কি না। এবং ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সেনাদের নতুন প্রতিরক্ষামূলক লাইনে পিছু হটার নির্দেশ দেবে কি না।
যদি তা-ই হয়, সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের দখলে থাকা অঞ্চলগুলোতে নিয়োজিত ইউনিটগুলো লোকক্ষয় না করে পিছু হটতে পারবে? লিসিচানস্ক থেকে বাখমুত পর্যন্ত মহাসড়কের বড় অংশ ধ্বংসাস্তূপে পরিণত হয়েছে। এছাড়া রাশিয়ান ইউনিটগুলোও বাখমুতের কাছাকাছি চলে আসছে।
বারবার ইউক্রেনীয় লাইন ভাঙার চেষ্টা করলেও রুশ বাহিনী এই মুহূর্তে উত্তরে ইজিয়াম থেকে স্লোভিয়ানস্কের দিকে খুব বেশি এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা রোববার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন যে, রুশ বাহিনী স্লোভিয়ানস্কের উত্তরে 'জড়ো' হচ্ছে। সীমান্তের ওপারে রিজার্ভ থাকা কয়েক ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপকে দ্রুত একত্রিত করতে পারে রুশ সামরিক বাহিনী।
তবে কিছু রুশ সামরিক ব্লগারের দাবি, স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোরস্কের মতো সুরক্ষিত শহর ঘেরাও করার মতো পর্যাপ্ত জনবল রুশ বাহিনীর নেই।
এখন ইউক্রেনীয়দের একমাত্র আশা হলো, ফ্রন্ট লাইনের বহু দূর থেকে রুশ আর্টিলারি, রকেট সিস্টেম ও কমান্ড ধ্বংস করতে সক্ষম পশ্চিমা অস্ত্র। আরও বেশিসংখ্যক পশ্চিমা অস্ত্র পেলে তারা হয়তো ধীরে ধীরে অস্ত্র-সক্ষমতার ব্যবধান কমাতে পারবে।
কিন্তু ইউক্রেনকে সরবরাহ করা অস্ত্র—যেমন ৭০ কিলোমিটার পাল্লার হিমার্স রকেট সিস্টেম—চালাতে শেখার জন্য দেশটির সেনাদের কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী এখন যেরকম চাপে আছে, তাতে কয়েক সপ্তাহ অনেক দীর্ঘ সময়।
দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ইউনিটগুলো মোতায়েন রয়েছে বলে এ চাপ অনেক বেশি। রাশিয়ান বোমাবর্ষণের তীব্রতায় ইউনিটগুলো রীতিমতো বিধস্ত। এছাড়া এই ইউনিটগুলোকে সহজে প্রতিস্থাপন করাও সম্ভব নয়।
এছাড়া ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে বেশ কিছু অস্ত্র-লড়াইয়েও হেরে গেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে দাবি করেছে যে রুশ সেনাদের হামলায় ইতিমধ্যে আমেরিকার সরবরাহ করা বেশ কিছু এম৭৭৭ হাউইটজার (এক ধরনের ক্ষুদ্র কামান) ধ্বংস করে দিয়েছে।
কিয়েভে প্রথমদিকে যেসব ভুল করেছিল, তা থেকেও শিক্ষা নিয়েছে রুশ বাহিনী। ব্যাপকভাবে বিমান প্রতিরক্ষা—মূলত এস-৩০০—মোতায়েন করা হয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনের ড্রোন আক্রমণের কার্যকারিতা গেছে কমে। গত কিছুদিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইউক্রেনীয় যুদ্ধবিমানের লড়াই করার ভিডিও আপলোডও কমে এসেছে।
নতুন কমান্ডার নিয়োগ রাশিয়ার
রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী গেনাদি ঝিদকো-র সার্বিক নেতৃত্বে ইউক্রেনের জন্য নিয়োজিত দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীতে নতুন কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে শৃঙ্খলা ফিরেছে রুশ বাহিনীতে।
ইন্সটিটিউশন ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার বলেছে, 'ইউক্রেনে অভিযান আরও ভালোমতো পরিচালনার জন্য সামরিক কমান্ডে রদবদল ও পুনর্গঠন করছে রাশিয়ার হাই কমান্ড।'
কিংস কলেজ লন্ডনের রাশিয়ান সামরিক বিশ্লেষক রব লি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে (মার্চে) রাশিয়ার কোনো সামগ্রিক কমান্ডার ছিল না। এর ফলে কমান্ড নীতির ঐক্য লঙ্ঘন হয়।
ইউক্রেনীয়দের এখন আশঙ্কা, নতুন সাফল্যের ফলে রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে উৎসাহী হয়ে উঠবে। ইউক্রেনীয় বাহিনী এখনও দোনেৎস্কের ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বাঁচানোর জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের একমাত্র আশা এখন জি-৭। জোটটি যদি ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া চালিয়ে যায়, তাহলে হয়তো রাশিয়ার বিপক্ষে এ যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে।
তবে পুতিনের কাছে এই যুদ্ধ মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। তাই তিনিও অদূর ভবিষ্যতে এ যুদ্ধ থামাবেন না বলে আশঙ্কা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের।
- সূত্র: সিএনএন