ভারতে রেস্তোরাঁর কর্মীদের নাম প্রকাশ্যে ঝুলানোর নির্দেশ; বৈষম্য ও লক্ষ্যবস্তুর শিকার মুসলিম ব্যবসায়ীরা
ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং হিমাচল রাজ্যে, রেস্তোরাঁগুলোকে তাদের কর্মীদের নাম সাইনবোর্ডে টাঙিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এনিয়ে ভারতের মুসলমানদের অভিযোগ, দুই রাজ্যের নতুন 'বৈষম্যমূলক' এ নীতির কারণে তাদের চাকরি হারানো এবং ব্যবসা বন্ধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
প্রথমে এই নীতি কার্যকর করেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। গত মাসে হিমাচল প্রদেশও উত্তর প্রদেশকে অনুসরণ করে একই ধরনের নির্দেশনা দেয়। যদিও সেখানে বিরোধী কংগ্রেস পার্টি শাসন করছে।
দুটি রাজ্য সরকারের অবশ্য দাবি, এই নিয়মগুলো স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিধি এবং ভেন্ডিং নিয়মাবলি মেনে চলার জন্য। তবে স্থানীয় ও অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, নতুন নিয়মগুলো মুসলমান কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণের একটি কৌশল মাত্র।
ভারতে নামের মাধ্যমে সহজেই ধর্ম ও জাতিগত পরিচয় শনাক্ত করা যায়। একারণে উত্তর প্রদেশের মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ— রাজ্যের সক্রিয় কঠোর হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা তারা লক্ষ্যবস্তু বা অর্থনৈতিক বর্জনের শিকার হতে পারেন।
লাখনৌ'র একজন শেফ (রাঁধুনি) তাবিশ আলম বলেন, "এই আদেশ বিপজ্জনক, এটি আমাদের ধর্মকে প্রকাশ্যে তুলে ধরতে বাধ্য করছে। আমি নিশ্চিত, সরকার এ বিষয়টি জানে, এবং এজন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে।"
উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। মোদির শাসনামলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বিজেপির অন্যতম কঠোর হিন্দুত্ববাদী নেতা। ২০১৭ সাল থেকে তার নেতৃত্বে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, নতুন আইন বাস্তবায়নের ফলে তারা মুসলমান কর্মীদের বরখাস্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজ্যের মুসলিম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাদের কিছু ব্যবসা ইতোমধ্যে হয়রানির শিকার হয়েছে এবং কিছু বন্ধের পরিকল্পনা করছেন।
মুজফফরনগরের রেস্তোরাঁর মালিক রফিক বলেন, তিনি জুলাইয়ে পুলিশ কর্তৃক নামের সাইন বোর্ডে প্রদর্শনের নির্দেশের পর তার চার মুসলমান কর্মীকে বরখাস্ত করেছেন। তিনি বলেন, "আমি আমার মুসলিম কর্মীদের বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছি, কারণ আদেশের পর তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। নাম প্রদর্শন আমাদেরকে খুব সহজে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। যদি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তবে আমরা সহজেই মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাব এবং আক্রমণের শিকার হব।"
রফিকের মতে, আদিত্যনাথের সরকার কেন এই নতুন নিয়মগুলো চাপিয়ে দিচ্ছে তা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, "নাম প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের ধর্ম চিহ্নিত করা হবে। মুসলিম মালিকানাধীন বা মুসলিম কর্মচারী পরিচালিত রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার খেতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা-ই এখানে মূল উদ্দেশ্য"।
রফিক আরও বলেন, তিনি এখনও পর্যন্ত পুলিশের চাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তবে যদি তাকে বাধ্য করা হয়, তাহলে হয়ত তাকে তার ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।
নতুন এই নীতির কারণে সম্প্রতি চাকরি হারিয়েছেন ইদ্রিস আহমেদ, তিনি সাত বছর ধরে একটি রেস্তোরাঁয় রাঁধুনির কাজ করছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন, নতুন এ নিয়মের কারণে তার মতো আরও বেশ কিছু মুসলমান কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, "রেস্তোরাঁর মালিক হিন্দু ছিলেন, এবং অধিকাংশ কর্মীও হিন্দু। আদেশ জারি হওয়ার পর, মালিক আমাকে এবং অন্যান্য মুসলিম কর্মীদের ডেকে দুঃখ প্রকাশ করে আমাদের বাড়ি যেতে বলেন।"
আহমেদ জানান, এই পরিস্থিতিতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন এবং তার পাঁচ সদস্যের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, কারণ অন্য কোনো রেস্তোরাঁ তাকে কাজ দিতে রাজি নয়। "আমি শুধু আমার ধর্মের কারণে একটি চাকরি হারিয়েছি," বলেন আহমেদ।
"আমার জানা মতে, আরও অনেক মুসলিম রেস্তোরাঁতে কাজ করছিল, কিন্তু আদেশের পর তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।"
মুজাফ্ফরনগরের কিছু ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন, শুধু মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসাগুলোকে এই নিয়ম মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। ৪২ বছর বয়সী মোহাম্মদ আজিম, যিনি একটি ছোট রাস্তার পাশে দোকান চালান, বলেন, "আমিই একমাত্র ব্যবসায়ী যাকে পুলিশ তার নাম সাইনবোর্ডে প্রদর্শন করার জন্য হয়রানি করেছে। প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কেন শুধু আমাকে বেছে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো?"
উত্তর প্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র প্রবীণ গার্গ জানিয়েছেন, এই নীতির উদ্দেশ্য রেস্তোরাঁগুলোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা, এবং কেউই কাজ করার অনুমতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। তিনি বলেন, "খাবারে ইচ্ছাকৃত দূষণ ঘটানোর অভিযোগ পাওয়ার পর সরকার এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।"
প্রবীণ আরও বলেন, "কিছু বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজন এমন জিনিস দিয়ে খাবার দূষণ করেছে, যা একজন হিন্দু ভক্ষণ করতে পারে না।"
সম্প্রতি কিছু ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয় যে, কিছু বিক্রেতা খাবার ও পানীয়তে থুতু এবং প্রস্রাব মিশিয়েছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু গ্রেপ্তারও হয়েছে।
তবে ডানপন্থি হিন্দু গোষ্ঠীগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে 'থুতু জিহাদ' ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করলেও, হিন্দুদের লক্ষ্য করে এমন কর্মকাণ্ডের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চলতি বছরের জুলাইয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড সরকারের আরেকটি আদেশ স্থগিত করেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় বার্ষিক হিন্দু তীর্থযাত্রার পথে অবস্থিত রেস্তোরাঁগুলোকে তাদের মালিক ও পরিচালকদের নাম প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। উভয় রাজ্যই বিজেপি শাসিত।
বিরোধী রাজনীতিবিদরা আদেশের বিরুদ্ধে একটি পিটিশন দাখিল করেন, যেখানে তারা যুক্তি দেন যে, এই আদেশটি ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক। আদালতের স্থগিতাদেশের ফলে এই বিতর্কিত নীতি আপাতত বন্ধ রয়েছে।
ধর্মীয় বিভাজন উসকে দেওয়ার অভিযোগ সত্ত্বেও, সেপ্টেম্বরে হিমাচল প্রদেশের সরকার ঘোষণা করেছে যে, তারা শীঘ্রই উত্তর প্রদেশের উদাহরণ অনুসরণ করবে। রাজ্য সরকার খাদ্য সুরক্ষা, 'মাইগ্রেন্টদের আগমনের' আশঙ্কাকে এই নীতির পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
হিমাচল প্রদেশের কংগ্রেস নেতা ও রাজ্য মন্ত্রী বিক্রমাদিত্য সিং বলেন, বিষয়টি এখনও আলোচনাধীন। তিনি বলেন, "রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করা হবে না। এই আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। কেন একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত বা উদ্বিগ্ন হতে হবে?"
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ করেছেন। শিমলার রেস্তোরাঁর মালিক শারিক আলি বলেন, "আমি যখন আমার নাম সাইনবোর্ডে প্রকাশ করব, তখন আমি নিরাপদ বোধ করব না। আমরা দেখেছি গত ১০ বছরে মোদির শাসনে মুসলমানদের উপর হামলা হয়েছে। আমি কংগ্রেস সরকারের কাছ থেকে এটা আশা করিনি। তারা জানে, এটি তাদের ভোট পেতে সহায়তা করবে।"
গত পাঁচ বছরে মুসলমান বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে, এবং মুসলমানদের অর্থনৈতিক বর্জনের আহ্বান ক্রমশ বেড়ে চলেছে। গত মাসে বাজরং দলের এক নেতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে তিনি এক সভায় মুসলমান দোকানদারদের কাছ থেকে পণ্য না কেনার প্রতিজ্ঞা করতে উপস্থিতদের আহ্বান জানান।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন