হামাসের চিন্তা কী? হামাসের রাজনৈতিক নেতার ভাষ্য

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা মুসা আবু মারজুক শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পেরেছিলেন, তার দল ইসরায়েলের ভেতরে আক্রমণ করেছে। হামাসের গাজাভিত্তিক সামরিক নেতারা আক্রমণের পরিকল্পনা এতই গোপনে রেখেছিলেন যে, খোদ নিজেদের অ-সামরিক নেতাদেরও তারা আক্রমণের দিনক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানাননি।
৭ অক্টোবর আচমকা এ হামলায় হামাস ১২০০-এর বেশি ইসরায়েলিকে হত্যা করেছে। এদের অনেকেই বেসামরিক নাগরিক। আর সেই সঙ্গে ১৫০-এর বেশি ইসরায়েলিকে বন্দি করেছে এটি। জবাবে ইসরায়েল গাজায় পালটা হামলা শুরু করে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ১৯০০-এর বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল গাজায় খাবার, জ্বালানি ও পানি ইত্যাদি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরায়েল এখন গাজায় স্থল আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজা শাসন করা হামাস কেন আচমকা এমন আক্রমণ করে বসল, যে আক্রমণে এটি এখন পর্যন্ত খুব অল্পই দৃশ্যমান কিছু অর্জন করতে পেরেছে? যে আক্রমণের দরুন ফিলিস্তিনিদের বিপুল মূল্য চোকাতে হবে জেনেও? এখন পর্যন্ত আক্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা কথা বলেছে দলটির নেতারা।
হামাসের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক নেতা আবু মারজুকের সঙ্গে আলাপ করেছে দ্য নিউ ইয়র্কার। গোষ্ঠীটির কৌশলগত চিন্তন নিয়ে আরও স্পষ্ট ধারণালাভের জন্য পশ্চিমের কাছে পৌঁছানোর হামাসের প্রচেষ্টার সম্মুখভাগে ছিলেন তিনি।
মারজুক বলেন, হামাসের আক্রমণের সাফল্য দেখে তিনি যারপরনাই অবাকই হয়েছেন। গাজা সীমান্তে নিরাপত্তাবলয়ে প্রায় দুই ডজনের মতো ফাঁক সৃষ্টি করেছে দলটি, ইসরায়েলের প্রায় ২০টির বেশি শহর ও গ্রামে আক্রমণ করে এটি। মারজুক বলেন, হামাস নেতারা মনে করেছিলেন, গাজার আশপাশে মোতায়েন করা ইসরায়েলি ইউনিটগুলো 'সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডিভিশনসমূহ' হবে যাদের কাছে 'হামাসের গতিবিধি নিয়ে বিস্তর গোপন তথ্য থাকবে'।
আবু মারজুক বলেন, হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেনি, কোনো অত্যাচার চালায়নি। তার মতে, এমন কাজ করতে পারে হামাসের তৈরি প্রবেশপথ অনুসরণ করে ইসরায়েলে প্রবেশ করা অন্য ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।
আবু মারজুক জোর দিয়ে বলেন, যদিও তিনি আক্রমণের বিস্তারিত তথ্য জানতেন না, তবে তিনিসহ হামাসের অন্য রাজনৈতিক নেতারাই এ আক্রমণের মাত্রা ও লক্ষ্যসহ সার্বিক কৌশলের অনুমোদন দিয়েছিলেন। 'সেনারাই আক্রমণ পরিকল্পনা, নির্বাহ ইত্যাদি করে। তবে তারা আমাদের রাজনৈতিক ব্যুরোর তৈরি করা সাধারণ নীতিমালা মেনে চলে। আমরা আক্রমণের দিন দেখে চমকেছিলাম, আক্রমণ নিয়ে নয়,' তিনি বলেন। হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেড এ আক্রমণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এটা হুট করে চালানো কোনো আক্রমণ নয়।'
আবু মারজুক জানান, যদি ইসরায়েল এর সামরিক অভিযান বন্ধ করে, তাহলে বন্দি নারী, শিশু, ও বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্য দেশের নাগরিকদের ছেড়ে দিতে প্রস্তুত হামাস। 'যেসব নিরীহ লোকদের বন্দি করা হয়েছে, আমরা তাদেরকে রেখে দেব না,' তিনি বলেন। (হামাসের সামরিক নেতারা এর সঙ্গে একমত হবেন কি না তা দেখার বিষয়।)
তিনি আরও ইঙ্গিত করেন, ইসরায়েলি জেলে আটকে থাকা ফিলিস্তিনিদের বিনিময়ে কিছু ইসরায়েলি সেনাকে ছেড়ে দিতে পারে হামাস। তবে মারজুক আরও বলেন, 'বন্দি বিনিময় নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি।'
হামাসের সামরিক শাখার একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, গাজাবাসীকে বাড়ি ছাড়তে সতর্ক করে না দিয়ে ইসরায়েল যদি বোমাবর্ষণ শুরু করত, তাহলে হামাস বেসামরিক বন্দিদের হত্যা করার ভিডিও প্রকাশ করত। তবে মারজুক ওই হুমকিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, 'এটা একটা ভুল—আমরা বন্দিদের খুন করতে পারব না।'
তিনি জানান, চার বন্দি — এরেজ সীমান্তে আটক হওয়া চার ইসরায়েলি সেনা — ইতোমধ্যে মারা গিয়েছেন। তবে তাদের হামাস মারেনি, ইসরায়েলি বিমানহামলায় তারা নিহত হন। তিনি বলেন, 'পরিস্থিতি একটু শান্ত হোক, বোমা হামলা কমুক। যাতে আমরা বিভিন্ন দল থেকে বন্দিদের আলাদা করতে পারি। তাদের সংখ্যা অনেক। আমরা যুদ্ধটা থামাই, তারপর এ বিষয় নিয়ে সব আলোচনা করা যাবে।'
হামাসের আক্রমণের কারণে গাজার বাসিন্দাদের যে মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তা নিয়ে আপত্তি তোলার তাদের অবকাশ নেই। গাজা সিটিভিত্তিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী খাইমার আবুসাদা বলেন, হামাস নেতা ও গাজার সাধারণ বাসিন্দাদের মনোভাবের পার্থক্য স্পষ্ট: 'বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি মরতে চায় না, এবং তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে কোনো নিকৃষ্ট মৃত্যু চায় না। কিন্তু হামাসের মতো আদর্শভিত্তিক সংস্থা বিশ্বাস করে, সঠিক কারণের জন্য মরা অর্থহীন জীবনের তুলনায় শ্রেয়।'
হামাসের আক্রমণের পর বিশ্লেষকেরা বলছেন, গোষ্ঠীটি এতদিন ইসরায়েলেকে নিরাপত্তার একটি ভুল ধারণা দিয়ে আসছিল। গত কয়েক বছরে হামাসকে এর হার্ড-লাইন অবস্থান থেকে সরে এসে ইসরায়েলের সঙ্গে নানা সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর গাজার অভ্যন্তরের অন্য সশস্ত্রগোষ্ঠী ও বেসামরিক নাগরিকদের হামলাচেষ্টা প্রতিরোধ করেছে হামাস।
হামাসের এ ধরনের সহযোগিতামূলক মনোভাব কি কেবল ইসরায়েলে ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি করতে কালক্ষেপণ? আবু মারজুক বরং জোর দিয়ে বলেন, 'আলোচনা ও সহাবস্থানের হামাসের এ প্রচেষ্টা আন্তরিক ছিল।' হামাসের এ প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তিনি ইসরায়েল ও পশ্চিমাশক্তিকে দোষারোপ করেন। তার মতে, হামাসের সহাবস্থানের নানা ধরনের আহ্বানে সাড়া দেওয়া হয়নি।
আবু মারজুকের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করার জন্য বেশকিছু বাস্তবিক প্রমাণ আছে বটে। সাম্প্রতিক সময়ে হামাসকে আদতেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের সঙ্গে সহাবস্থানের চেষ্টা করতে দেখা গেছে। তবে আবু মারজুক এটাও স্বীকার করেছেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং সকল ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিজভূমিতে ফেরত আসার অধিকারের মতো মূল দাবিগুলো হামাস কখনোই পরিত্যাগ করেনি। এছাড়া হামাস এর অস্ত্রও পরিত্যাগ করেনি। 'কিন্তু আমরা কাউকে ভুলপথে পরিচালিত করিনি, আমরা এ স্লোগানগুলো কখনো পরিত্যাগ করিনি,' তিনি বলেন।
হামাস এ হামলা থেকে কী অর্জন করতে চায় — আবু মারজুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি পুনরায় অতীতের ব্যর্থতার কথাই শোনান। 'আমরা বিশ্বকে আহ্বান করেছি আমাদের সাহায্য করতে, রক্ষা করতে, এবং সেটলারদের উগ্রবাদ বন্ধ করতে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়,' তিনি বলেন।
এখন পর্যন্ত কি এ আক্রমণে কোনো অর্জন দেখছে হামাস? 'এ প্রথমবারের মতো সীমান্ত অতিক্রম করে ফিলিস্তিনিরা তাদের ঐতিহাসিক ভূমিতে লড়াই করছে। ইসরায়েল নিজেদের সীমান্তের বাইরে এসে এতদিন আমাদের ওপর অত্যাচার করত, যুদ্ধ করত, খুন-বন্দি করত। এখন ব্যাপারটা উলটো। ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে যে তারা চিরকাল ফিলিস্তিন দখল চালিয়ে যেতে পারবে না, তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন,' বলেন আবু মারজুক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। দ্য নিউ ইয়র্কার-এর মূল শিরোনাম আংশিক পরিবর্তিত।