'কোথাও যাবার জায়গা নেই': ইসরায়েলের সেনা আক্রমণের ভয়ে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস যখন গত শনিবার সকালে ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা শুরু করে, তখন গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি দেখা যায়।
সাধারণ ফিলিস্তিনি নাগরিকদের কেউ কেউ এই হামলার ঘটনাকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিজেদের বিজয় বলে গর্ব করে সেটি উদযাপন করেছেন। আবার কেউ কেউ ইসরায়েলের পাল্টা প্রতিক্রিয়া ও মারাত্মক প্রতিশোধের কথা চিন্তা করে বেশ ভয় পাচ্ছিলেন।
তারই ধারাবাহিকতায় হামাসের আকস্মিক হামলার পর জনগণের উদ্দেশে দেওয়া বিবৃতিতে হামাসকে 'নজিরবিহীন মূল্য' চুকাতে হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, "ইসরায়েলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি (উই আর অ্যাট ওয়ার)। ...আজ সকালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও এর জনগণের বিরুদ্ধে খুনে হামলা চালিয়েছে হামাস।"
হামাসের হামলার কয়েক ঘণ্টা পর নেতানিয়াহুর এই ভিডিও বার্তাটি প্রচার করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, "পাশাপাশি আমি সর্বোচ্চ সংখ্যায় রিজার্ভ সেনাদের সমবেত করার নির্দেশ দিয়েছি। যাতে এমন বড় ও তীব্র পাল্টা হামলা চালানো যায়, শত্রুপক্ষ আগে কখনোই যেমন হামলার সম্মুখীন হয়নি।"
এই বিষয়ে ইসরায়েলের স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী রন ডার্মার গতকাল (রবিবার) সিএনএনকে জানান, হামাসের হামলার অন্তত ৬০০ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছে। নিহতের এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন তিনি।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)-এর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি গতকাল (রবিবার) জানান, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণের অংশ হিসেবে গাজায় প্রায় ৮০০ টি টার্গেট ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে হামাসের ব্যবহৃত একটি 'লঞ্চিং প্যাড'ও ছিল বলে তারা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় ৭৮ শিশুসহ অন্তত ৪১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
ইসরায়েলের সাথে এমন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বহু ফিলিস্তিনি আশ্রয়ের জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে বেশিরভাগ গাজাবাসীকে তাদের নিজ বাড়িতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
একইসাথে অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে একটি। যেখানে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মাত্র ১৪০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বাস করে।
বর্তমানে গাজার বসবাসকৃত ফিলিস্তিনিরা খুব কমই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের হচ্ছেব, তারা হয় প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার জন্য কিংবা ইসরায়েলি হামলার নিখোঁজ হওয়া স্বজনদের খোঁজ নিতে বের হচ্ছে। ইসরায়েলের হামলায় রাস্তাগুলি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ধ্বংসস্তূপে আবৃত হয়ে গেছে। একইসাথে বাতাসে উড়ছে ধুলো এবং বারুদের গন্ধ।
ইসরায়েলি হামলায় সর্বস্ব হারানো তেমনি একজন ফিলিস্তিননি নাগরিক সেলিম হোসেন। তার বাড়ি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি যে ভবনটিতে থাকতেন সেটি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তাকে এবং তার পরিবারকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল।
৫৫ বছর বয়সী সেলিম জানান, কেন তার বাড়িতে হামলা করা হয়েছে, তা তিনি জানেন না। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "শুধু পরনের পরা কাপড় নিয়েই আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছিল। এখন তার পরিবারের থাকার মতো জায়গা নেই; সম্পদ বলতেও আর কিছু বাকি নেই।"
ইসরায়েলে হামাসের পর ফিলিস্তিনিদের এরেজ ক্রসিং দিয়ে গাজা ছেড়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটি হামাস এবং ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
গত শনিবার ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানান, ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় 'বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পণ্য' সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। যদিও আইডিএফ মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচট গতকাল (রবিবার) জানান, অঞ্চলটিতে শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
নেতানিয়াহুর ঐ ঘোষণার পর থেকে গাজায় দিনে গড়ে মাত্র চার ঘন্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে; যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। একইসাথে এলাকাটির ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ইসরায়েলই গাজার সিংহভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
গত ১৭ বছর ধরে গাজা উপত্যাকা বাকি বিশ্বের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অঞ্চলটি ২০০৭ সাল থেকে অনেকটা হামাস নিয়ন্ত্রিত৷ তবে এটি মিশর এবং ইসরায়েল বিমান ও নৌ ক্ষেত্র দ্বারা কঠোর অবরোধের মধ্যে রয়েছে। তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে 'বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার' হিসাবেও বর্ণনা করেছে।
২০০৫ সালে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের পর থেকে গাজাবাসীরা বেশ কয়েকবার ইসরায়েলি হামলায় ভূখণ্ডটি জ্বলতে দেখেছে। হামাস এবং ইসলামিক জিহাদসহ গাজায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিয়মিত সংঘাত হয়ে থাকে।
গতকাল (রবিবার) হাজারি জানান, ইসরায়েল গাজায় কমপক্ষে ১০ টি গুরুত্বপূর্ণ টাওয়ার ধ্বংস করেছে। তাদের দাবি, এগুলো হামাসের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছিল। অন্যদিকে গাজা উপত্যকার চারপাশে কয়েক হাজার ইসরায়েলি সৈন্যও মাঠে রয়েছে৷
আইডিএফ গতকাল (রবিবার)জানায়, তারা এখন গাজা উপত্যাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করছে। তাই সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার নিশ্চিন্তে অবিলম্বে সীমান্তের কাছাকাছি আবাসিক এলাকা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। কেননা হামাসকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বাহিনী সামরিক অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে।
কিন্তু অধিকাংশ গাজাবাসীর কাছেই অবরুদ্ধ অঞ্চলটি থেকে অন্যথায় সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। মিশরের সাথে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাফাহ ক্রসিং ব্যতীত অঞ্চলটি থেকে বের হওয়ার সমস্ত ক্রসিং বর্তমানে বন্ধ অবস্থায় রয়েছে।
গাজার হানি এল-বাওয়াব নামের এক অধিবাসী জানান, তিনি এবং তার চার সদস্যের পরিবার বিমান হামলার ভয়ে সারা রাত জেগে ছিলেন। তার বাড়ির সংলগ্ন টাওয়ারটিতে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা করেছিল। এতে করে তার নিজের বাড়িও ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে তারা গৃহহীন অবস্থায় রয়েছে।
৭৫ বছর বয়সী হানি এল-বাওয়াব বর্তমানে খুব কষ্টে রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, "আমি ঠিক জানি না যে, আমি কী করবো?" অন্যদিকে তার স্ত্রী পরিচিত এক পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
হানি এল-বাওয়াব সিএনএন-কে বলেন, "গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বোমার আঘাতে যেকোনো মুহুর্তে নিজ বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে তারা শংকায় রয়েছেন৷ আমি শুধু আমার বাচ্চাদের সাথে নিয়ে একটি বাড়িতে থাকতে চাই। আমি শুধু থাকার মতো একটা জায়গা চাই।"