ইউরোপের চরম জ্বালানি সংকট এবার খাদ্যেও থাবা বসাতে চলেছে
লন্ডনের অদূরেই অবস্থিত বিখ্যাত ফেঞ্চ বেকারি ব্রিয়স পাসকির ২ লাখ ৪০ হাজার বর্গফুটের বিশাল কারখানা। প্রতিনিয়ত এখানে উনুনে সেঁকা রোলগুলো বেড়িয়ে আসে সারবেঁধে; কিন্তু তারা আগের মতো নয়। না স্বাদ বা মানের কথা উঠছে না; বদলে গেছে কেবল মূল্য। আগের চেয়ে এখন বেকারিটির প্রতিটি খাদ্যের দাম বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশ।
আর বাড়বেই না কেন; প্রতিটি খাদ্য উপাদানের দামই যে বাড়বাড়ন্ত। মাখন থেকে শুরু করে ডিম, দুধ, চিনি সবেরই বেড়েছে। ফলে ক্রঁসো হোক বা পা ও শকোলা (চকোলেট ব্রেড) বিক্রির সময় ফ্রেঞ্চ বেকারিটি গ্রাহকদের ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপাতে বাধ্য হচ্ছে।
গত এক বছর ধরেই বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামে এই ঊর্ধ্বমুখী মিছিল শুরু হয়েছে; যা থামবার নামই নিচ্ছে না। ভোক্তার জন্য শাকের ওপর আঁটির বোঝা হয়েছে জ্বালানির আকাশচুম্বী খরচ।
স্বস্তিতে নেই ফ্রেঞ্চ বেকারিটির মতো খাদ্য প্রস্তুতকারক ব্যবসাগুলোও। তারা রয়েছে উভয় সংকটে। জানা কথা, জীবনযাপনের খরচ যখন যুক্তরাজ্যসহ গোটা দুনিয়ায় রুদ্ধশ্বাসে বাড়ছে, তখন দাম বাড়ানো মানেই বিক্রি কমা। আবার উৎপাদন কম করলেও, অর্থনীতির সহজ সূত্রে পণ্যপ্রতি উৎপাদন খরচও বাড়তি হবে।
এর মধ্যেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বলছে, যুক্তরাজ্যে এ বছর ১৩ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হতে পারে। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ পরিবারকে তাদের আয়ের ১০ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিল মেটাতে। তার সাথে মুদি পণ্যের অতিরিক্ত খরচ 'খাদ্য দারিদ্রের' চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
ব্রিয়স পাসকি ইউকে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়ান পিটারস বলেন, 'আমাদের জ্বালানি খরচও অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ার এই ডোমিনো ইফেক্ট (ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া) সৃষ্টি হয়েছে'।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'এজন্য আমরা খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছি; দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে'।
যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের চেয়ে খাদ্যের দাম আরও বেশি ভোগান্তি সৃষ্টি করছে স্বল্পোন্নত দেশে। বৈশ্বিক এই খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। এই সংঘাতের কারণে গম থেকে শুরু করে উদ্ভিজ্জ তেলের মতো সকল মৌলিক খাদ্যপণ্যের দর বাড়বাড়ন্ত। বিশ্ববাজারে পণ্যগুলির সরবরাহে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়–প্রাথমিকভাবে তাই মূল্যবৃদ্ধিকে উস্কে দেয়।
আশার কথা হলো- বিশ্ববাজারে পণ্যগুলির দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু, একইসাথে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে– জ্বালানি মূল্য চড়া থাকলে এই দাম কমার সুফল ভোক্তাপর্যায়ে সামান্যই পৌঁছাবে।
ইতঃপূর্বে, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সমস্যাটির দিকে আলোকপাত করে বলা হয়– 'কার্যত আমাদের এখন একটি 'জীবাশ্ম খাদ্য' ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি রপ্তানিকারক দেশ কিছু মৌলিক খাদ্যশস্য উৎপাদন করে। সেগুলো আবার জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়'।
শুধু খাদ্য রপ্তানি পর্যায়ে ফসলের মাঠ থেকে খাদ্য গুদাম, আর সেখান থেকে বন্দর প্রতিটি পর্যায়ে আছে পরিবহনের ব্যবহার। জ্বালানির বাড়তি মূল্য প্রতি ধাপে সেখানে যোগ হচ্ছে। আমদানির পরও একই রকমভাবে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের মূল্য।
তার সঙ্গে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পকেও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও কয়লার বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। শেষপর্যন্ত যার চাপ আসছে আপামর জনতার ওপর।
ইউরোপে জ্বালানির খরচ বেড়েছে রাশিয়ার সাথে শত্রুতায়। ইংলিশ চ্যানেলের উভয় পাড়ের সাধারণ ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের তাই সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য দিতে হচ্ছে।
সামনেই আবার আসছে শীতকাল, যখন মহাদেশটিতে ঘর উষ্ণ রাখতে ও বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা থাকে জোরালো। খাদ্য প্রস্তুতকারকরাও এই দুর্বিপাকে নাজেহাল হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান- ইডিঅ্যান্ডএফ ম্যান- এর প্রধান গবেষক কনা হক বলেন, 'কফি বীজ রোস্ট করতেই হোক বা বিট থেকে চিনি উৎপাদনে–এপর্যন্ত খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো কেবল মৌলিক কাঁচামালের দাম বাড়া নিয়েই আলোচনা করেছে। কিন্তু, আমি মনে করি, তার সঙ্গে জ্বালানির রুদ্ধশ্বাস মূল্য যোগ হয়ে সামনে আরও খারাপ সময় আসছে। এ বছরের শীতকাল সবকিছু উল্টেপাল্টে দেবে; খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের খরচ বহুগুণে বেড়ে যাবে'।
ইউরোপের বৃহত্তম বিট-চিনি প্রস্তুতকারক সুয়েডজুকার এজি। চলতি বছরের শুরুতে কোম্পানিটি জানায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে তাদের আয় বাড়লেও– সেখানে থাবা বসিয়েছে কাঁচামাল, জ্বালানি ও মোড়কজাত করার খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি।
আরেকটি বড় প্রস্তুতকারক এলায়েড বেকারিজ জুন মাসে জানায়, তৃতীয় প্রান্তিকে তাদের বিক্রিবাট্টা বাড়লেও লাভের মার্জিনকে ব্যাপকভাবে কমিয়েছে উৎপাদন খরচ।
ইউরোপে সয়াবিন, সূর্যমুখীর বীজ ও রাইসরিষা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদকরা এরমধ্যেই তাদের উৎপাদন কমাতে শুরু করেছেন। অনেকে ইউরোপ থেকে মাড়াইকল সরিয়ে নিচ্ছেন জ্বালানি খরচ কম বিশ্বের এমন অঞ্চলে।
গত জুনে ইউরোপে তৈলবীজ মাড়াই কমেছে ৩.২ শতাংশ, ২০১৯ সালের পর যা সবচেয়ে কম বলে জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিল্পের জোট- ফেডিওল- এর তথ্য।
সরকারি সহায়তা:
এই শিল্পের পূর্বাভাস এতি নাজুক যে সরকারগুলিকে বাধ্য হয়ে সহায়তা দানে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে ১১ কোটি ইউরোর একটি ত্রাণ প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে ইইউ। কৃষিখাতের যেসব কোম্পানি জ্বালানি, সার ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পড়েছে, তাদের সহায়তায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
ইইউ অ্যান্টিট্রাস্ট কমিশনার মার্গারেট ভেস্তেজার বলেন, 'জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি বিশেষত কৃষি খাতের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং সেই প্রেক্ষাপটে মস্কোর ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলিও উৎপাদন খরচকে অসহনীয় মাত্রায় নিয়ে গেছে'।
তিনি আরও বলেন, 'এই অবস্থায় যেন জাতীয় পর্যায়ে সময়মতো, কার্যকরভাবে সহায়তার পদক্ষেপগুলি নেওয়া যায়–সেজন্য আমরা (ইইউ) সদস্য দেশগুলির সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি'।
ইইউ ও জাতীয় সরকারের প্রচেষ্টা আদৌ কতখানি সহায়তা দিতে পারবে– রয়েছে তা নিয়ে আশঙ্কার অবকাশ। আসন্ন শীতে গ্যাস সংকট চরমে পৌঁছালে রেশনিং ব্যবস্থায় ফিরতে হতে পারে ইউরোপকে। তখন জ্বালানি ব্যবহারে অতি-নির্ভরশীল কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর নাভিশ্বাস উঠবে।
এরমধ্যেই গ্যাস সংকটে তিন-দফার জরুরি পরিকল্পনা চালু করেছে জার্মানি। পরবর্তী ধাপে অনেক শিল্পে শাটডাউনের কাল ফিরতে পারে। কারখানা পর্যায়ে জ্বালানি সরবরাহ কমানোর একটি পরিকল্পনা করছে যুক্তরাজ্যও। পরিস্থিতি সত্যিই এতটা নাজুক হলে, মুদিপণ্যের মূল্য পৃথিবীর বৃত্ত ছেড়ে পাড়ি দিতে পারে মহাকাশে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ