রাশিয়ার তেল-গ্যাস ছাড়া কি বিশ্ব চলতে পারবে?
সারাইয়ের জন্য ১০ দিনের বিরতির পর আবারও ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের বৃহত্তম পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ১ দিয়ে গ্যাস সরবরাহ চালু করেছে রাশিয়া।
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-র নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় মস্কো দীর্ঘ সময়ের জন্য সরবরাহ বন্ধ রাখবে বলেও আশঙ্কা করে ইইউ।
সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ না নিলেও মাস না ঘুরতেই সারাই কাজের জন্য আবারও গ্যাস সরবরাহ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। সারাই কাজে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে আরেকটি টারবাইন বন্ধ করলে উৎপাদন ২০ শতাংশ কমার কথা জানিয়েছে রাশিয়ার বৃহত্তম গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম। এরই ধারাবাহিকতায় রাশিয়া যদি ইউরোপে পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্বব্যাপী কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে?
বর্তমান নিষেধাজ্ঞাগুলো কী?
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ সমুদ্রপথে আসা সমস্ত রাশিয়ান তেল আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ।
তবে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত রয়েছে ইইউ নেতারা। হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলো এই তেলের ওপর নির্ভরশীল বলে 'অস্থায়ী' ভাবে তেল আমদানির সুযোগ থাকবে বলে জানান তারা।
এক বছরের মধ্যে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার অঙ্গীকারও নিয়েছে ইইউ। তবে সরাসরি আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো আরও কঠিন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ ইউরোপের জন্য সহজ নয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এসব নিষেধাজ্ঞার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল ও গ্যাস আমদানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাজ্যও রাশিয়ার তেল আমদানি বন্ধ করে দেবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউরোপের 'শত্রুভাবাপন্ন' দেশগুলোর কাছে রুশ রুবেলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধের দাবি করেন, যা মুদ্রার মান বাড়াতে সহায়তা করবে।
পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং ফিনল্যান্ড রুবেলে মূল্য পরিশোধে অস্বীকৃতি জানানোয় রাশিয়া তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
বেশ কিছু ইউরোপীয় জ্বালানি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইউরোকে রুবেলে রূপান্তরিত করে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করছে। ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন ছাড়াই এই লেনদেন সম্ভব বলে জানিয়েছে দেশগুলো।
রাশিয়া গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে।
২০২০ সালে রাশিয়ার গ্যাসের প্রধান আমদানিকারক ছিল ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানি। গ্যাস আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইতালি।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর যুক্তরাজ্যের নির্ভরতা কম। গত বছর যুক্তরাজ্যের চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে একেবারেই গ্যাস আমদানি করে না।
ইইউ রাশিয়ার বিকল্প গ্যাস সরবরাহকারী খুঁজে পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জ্বালানি বিশ্লেষক কেট ডোরিয়ান জানান, 'ইইউকে বিকল্প গ্যাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কাতারের মুখাপেক্ষী হতে হবে যারা ট্যাঙ্কারে করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ করবে'।
'কিন্তু ইউরোপে যথেষ্ট সংখ্যক এলএনজি টার্মিনাল নেই। বিশেষ করে জার্মানির জন্য এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। জার্মানিতে এলএনজি আনলোড করার মতো সরঞ্জামাদিই নেই'।
ইউরোপে কি তেলের ঘাটতি দেখা দিবে?
রাশিয়ার আমদানি নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক ইউরোপীয় দেশই তেল সরবরাহ নিয়ে চাপের মুখে পড়তে পারে।
লিথুনিয়া এবং ফিনল্যান্ড গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়া থেকে দেশগুলোর চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ তেল আমদানি করে বলে জানা গেছে।
তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের কাছ থেকে তেল কেনা কঠিন নয়।
তেল আমদানিকারক দেশগুলো নিয়ে গঠিত জোট আইইএ তাদের মজুদ থেকে ১২০ মিলিয়ন ব্যারেল সম পরিমাণ অপরিশোধিত তেল উন্মুক্ত করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও আমেরিকার তেলের রিজার্ভ থেকে তেল উন্মুক্তকরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
কেট ডোরিয়ান বলেন, 'সৌদি আরবের মতো দেশগুলো বিশ্ববাজারে বছরের শেষ নাগাদ তেল সরবরাহ বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও সরবরাহ বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে'।
নিষেধাজ্ঞা কি কাজ করবে?
জ্বালানি মূল্যের দাম বাড়ায় রাশিয়া ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে গত এক বছরে ৪৩০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে।
ইইউ বলেছে তাদের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া থেকে তেল সরবরাহের পরিমাণ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাবে।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। এমনকি কার্যকর হলেও রাশিয়া বিশ্বের অন্যত্র তেল বিক্রি করতে পারবে।
জ্বালানি বিষয়ক ডেটা ফার্ম আর্গাস মিডিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভিড কাইফ বলেন, 'এশিয়ার দেশগুলো এখনকার চেয়ে রাশিয়া থেকে দৈনিক এক মিলিয়ন ব্যারেল পর্যন্ত অতিরিক্ত তেল নিতে পারে'।
'এখন পর্যন্ত ঘোষিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ রাশিয়া মোট তেলের লভ্যাংশের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক হারাতে পারে, তবে সব হারাবে না,' বলেন তিনি।
জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ ক্রেতাদের কী হবে?
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ভুক্তভোগী সাধারণ গ্রাহক।
ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি সীমিত করা হলে জ্বালানির দাম আরও বাড়তে পারে।
যুক্তরাজ্যে গৃহস্থালির জ্বালানি খরচ নির্দিষ্ট সীমায় নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। এপ্রিলে সীমা পুননির্ধারিত হলে গৃহস্থালির জ্বালানি ব্যয়ের সীমা ৭০০ পাউন্ড থেকে বেড়ে ২,০০০ পাউন্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে আরেকদফা বৃদ্ধিতে তা ৩,০০০ পাউন্ডে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের পেট্রোল ও ডিজেলের দামও বেড়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাওয়ায় দেশটির সরকার জ্বালানি শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সূত্র: বিবিসি