তুফান চাকমা: যার ছবিতে উঠে আসে পাহাড়িদের জীবনগাথা
মানুষ কত ভাবেই না তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কেউ বলে, আবার কেউবা লিখে ব্যক্ত করেন তার ভেতরকার অবস্থা। তবে কেউ কেউ শুধু ছবি এঁকেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন নিজের অব্যক্ত কথামালা। ওই যে, বলা হয়— ছবি কথা বলে। প্রকৃত অর্থেই তাই। এমনই এক চিত্রশিল্পীর প্রতিটি ছবিই যেন বলে যায় শত শত অজানা গল্প। যে গল্পে উঠে আসে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।
শৈশব থেকেই আঁকিবুকির প্রতি শখ তার। তাই অন্য কিছু শেখার আগে ছবি আঁকাটাই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। হাতের কাছে টুকরো কোনো কাগজ পেলেই ছবি আঁকতে বসে পড়তেন। সেখানে ইচ্ছেমত আঁকিবুকি করে কাটিয়ে দিতেন দিন। যখন যা আসে ভাবনায়, ইচ্ছে হলেই রূপ দিতেন ছবিতে। শৈশবে তার ছোট্ট জগতজুড়ে যে নির্মল খুশিরা খেলা করতো, তার অন্যতম উৎস ছিল ছবি আঁকা। বড় হওয়ার সাথে সাথে আঁকাআঁকির নেশা তীব্রভাবে চেপে বসেছিল তার মাথায়। তাই তুলির আঁচড়ে ক্যানভাস সাজানোর এই কাজটিকে বেছে নেন নিজের ঐতিহ্য উপস্থাপনের মাধ্যম হিসেবে।
ছবিতে চাকমা সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য
স্বপ্নচারী সেই বালক হলেন তুফান চাকমা। জন্ম খাগড়াছড়ির দীঘিনালার উদাল বাগানে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। মা, বাবা ও এক ভাইকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।
ছোটবেলায় খেলতে যাওয়ার ছল করে বের হতেন বাড়ি থেকে। তারপর মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ি গ্রামের অপরূপ সব দৃশ্যপটে চোখ জুড়াতেন। জুম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পাথর,আর সেখান থেকে বেয়ে আসা পাহাড়ি ঝিরির ঠান্ডা পানির কলকল শব্দ, ঘন সবুজ বন, রঙ-বেরঙের পাখিদের ডাকাডাকি, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মেঘেদের ছুটোছুটি, তারপর শেষ বিকেলে সূর্যের লুকিয়ে পড়ার সৌন্দর্য দেখে কাটিয়ে দিতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সেসব সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় আঁকাআঁকি করতেন খাতায়। ছোট্ট তুফানের তুলিতে তখন পাহাড়ি গ্রামের রূপ, রীতি, সংস্কৃতিই উঠে এসেছে বারবার। এখনো সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন; তবে একটু বড় পরিসরে। এখন আর রূপ প্রকৃতি নয়, চাকমা সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন ছবিতে। ফুটিয়ে তোলেন পাহাড়িদের জীবনের পুরো চালচিত্র। পাহাড়িদের দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনা ও হতাশার গল্পও উঠে আসে তার শিল্পে– যা নিয়ে কথা বলে না কেউ, তুফানের ছবিই যেন বলে যায় সেসব।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র তুফান। তবে এত পথ পাড়ি দেওয়ার যে যাত্রা, তা সুখকর ছিল না মোটেও। যেখানে তিনবেলা ভাতের যোগান দিতেই হিমশিম খেতেন কৃষক বাবা অশ্বত্থামা চাকমা, পড়াশোনা সেখানে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই ছেলের উচ্চশিক্ষার খরচ জোগানো স্বপ্নের মতো বিষয় ছিল তার পরিবারের কাছে। কিন্তু তাই বলে তুফান থেমে থাকেননি।
চাতকের মত স্বপ্নের পথে অটল থেকে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তুফান। ২০১২ সালের কথা। উদাল বাগান হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভালো কলেজে পড়ার লক্ষ্যে বাড়ি থেকে অনেক দূরে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে এসে ভর্তি হন। বাড়ি ছেড়ে এই তার শহুরে এলাকায় প্রথম যাত্রা। সে সময়ে তুফানের কাছে এমন একটি কলেজে পড়তে পড়াই ছিল বিশাল ব্যাপার।
তবে এতটুকুতেই থেমে থাকেননি তিনি। আরও বড় হওয়ার যে তীব্র ইচ্ছা ধারণ করেছিলেন বুকে, নড়চড় হয়নি সেখানেও। সফলও হয়েছেন অবশ্য। স্বপ্নের সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখার সুযোগ হয় তার। এখন তার পরিচিতি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই সীমাবন্ধ নয়— তুফান তার শিল্পের মাধ্যমে জয় করেছেন দেশের নানান প্রান্তের মানুষের মন। এমনকি, দেশ পেরিয়ে সে সুনাম ছড়িয়ে গেছে বিশ্বপর্যায়েও।
'ভুল ধারণা অবসানের লক্ষ্য'
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ঠিকঠাকভাবেই চলছিল সবকিছু। ধীরে ধীরে চারপাশের মানুষের সাথে সখ্য বাড়তে থাকে তার। তবে এরই মধ্যে কিছু বিষয় বেশ অস্বস্তিতে পড়েন তুফান। লক্ষ্য করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত অনেক বন্ধুদের মধ্যেই আছে পাহাড়িদের নিয়ে ভুল ধারণা। বিষয়টা বেশ ভাবায় তাকে। মনক্ষুণ্ণ হয়ে এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেন, 'আদিবাসীদের নিয়ে এমন চিন্তা-ভাবনা নতুন নয়'।
ঢাকায় আসার পরে যখন মাঝেমধ্যে গ্রামে যেতেন, তখন পাহাড়ের অবস্থা দেখে দুঃখ হতো তার। আগের মত ছিল না কিছুই। বাইরের মানুষের হস্তক্ষেপ সেখানে স্পষ্ট। নিজের ভেতরের যে ক্ষোভ, প্রতিবাদ জমা হতো একসময় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান আঁকাআঁকিতেই। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন নিজের এই শিল্প সত্ত্বাকে।
তুফান অনুভব করেন, মানুষের ভেতরকার এইসব ভুল-ভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন। ফলে উপায় খুঁজতে শুরু করেন তিনি। এরমধ্যে খুঁজে নেন পথও। সিদ্ধান্ত নেন, প্রথমেই দূর করবেন নিজের যত ভুল-ভ্রান্তি। শুরু হয় আদিবাসীদের নিয়ে পড়াশোনা। যেখানে যা পেতেন, তা নিয়েই বাড়াতে থাকেন নিজের জানার পরিধি।
তুফান বলেন, "আমিও আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে খুব একটা সচেতন ছিলাম না। কিন্তু যখন দেখলাম বাইরের মানুষ আমাদের নিয়ে অনেক ভুল ধারণা পোষণ করে, তখন খারাপ লাগতে থাকে। নিজের অজ্ঞতার বিষয়টাও নজরে আসে।"
এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। তার মাথায় চেপে বসে আরও বড় পরিকল্পনা। তিনি ভাবলেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই পাহাড়িদের নিয়ে এত ভুল-ভ্রান্তি থাকে, তবে অন্যদের ক্ষেত্রে সে অবস্থা হয়তো আরও ভয়াবহ। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে তুফান সন্ধান করছিলেন এমন একটি প্ল্যাটফর্মের, যার মাধ্যমে বহু সংখ্যক মানুষের কাছে নিজের বার্তা পৌঁছানো যাবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে বেছে নেন মাধ্যম হিসেবে।
২০১৪ সাল। পরিকল্পনা মোতাবেক তুফান নিজেকে যুক্ত করেন ফেসবুকে। কিছুদিন ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই ছবি পোস্ট করা শুরু করেন। আরও বড় পরিসরে কাজ করার লক্ষ্যে ২০২০ সালে বন্ধুদের পরামর্শে 'Tufan's Artbin' (তুফান'স আর্টবিন) নামের একটি পেইজ খুলে বসেন। তারপর সেখানে নিজের আঁকা ছবি আপলোড করতে শুরু করেন।
খুব দ্রুত সেসব ছবিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে দারুণভাবে সাড়া পেতে থাকেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশংসাও আসতে থাকে। এভাবে করে তার আঁকা ছবি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায়। ধীরে ধীরে মানুষের কাছে তুফান পরিচিত হয়ে ওঠেন তার ফেসবুক পেইজ 'Tufan's Artbin' এর মাধ্যমে।
তুফানের ভাষ্য এই, "আমাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অজ্ঞানতা, জানার সীমাবদ্ধতা- তা কিছুটা কমানো, সত্য জানানোর উদ্দেশ্যেই আমি জোরেশোরে এই কাজে আগাই।"
তবে যে বিষয়টির মাধ্যমে মানুষের কাছে তুফানের পরিচিতি, সে আঁকাআঁকিতে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান ছিল না তার। জানতেন না ছবি আঁকার কোনো নিয়ম-নীতি। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে যেসব ছবি আঁকতেন, তা নিয়ে উৎসাহ জোগাতেন তার মা ও জেঠিমা। সেই উৎসাহই তাকে আরও সামনে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকে।
জাতিসংঘের পুরস্কার
২০২৩ সাল। তুফানের শিল্পী জীবনের এক গৌরবময় দিন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায় তার ছবি। পাহাড়িদের জীবনাচারণ তুলে ধরে ছবি আঁকা নিয়ে জাতিসংঘের হিউমান রাইটস বিষয়ক সংস্থার কাছ থেকে 'ইন্টারন্যাশনাল আর্ট কন্টেস্ট ফর মাইনোরিটি আর্টিস্ট' পুরস্কার ভূষিত হন তুফান। একই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৭ জন শিল্পী এ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তুফান চাকমা তাদেরই একজন। 'ইন্টার সেকশনালিটি' নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মান দেওয়া হয় তাকে।
তার এই আঁকাআঁকি যে একদিন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করবে তা কখনো কল্পনাও করেননি তুফান। এমনকি কেউ তার কাজ দেখবে, প্রশংসা করবে, এত মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে তার আঁকা ছবি— সেটিও ছিল কল্পনাতীত। তবে এখন বিশ্বাস করেন চাইলেই ছুঁতে পারা যায় আকাশ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তুফান এখন ডিজিটাল উপায়ে তুলে ধরতে চান তার সংস্কৃতি। সেলক্ষ্যে টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছেন আইপ্যাড। এখন এই ডিজিটাল যন্ত্রের সাহায্যে নিত্যনতুন উপায়ে পাহাড়কে তুলে ধরছেন তুফান। বিশ্বের মানুষের কাছে পাহাড়ি জীবনকে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষদের জানাতে চান আদিবাসীদের জীবনের অপ্রিয় সত্যগুলো।
তুফান বলেন, "আমাদের নিয়ে কথা বলার মানুষ নেই। কারণ কথা বলার মত পর্যায়ে খুব কম মানুষই যেতে পেরেছে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে আসলাম, ছবি এঁকে যখন পরিচিতি বাড়লো– তখন ভাবলাম আমিও পাহাড়িদের কণ্ঠস্বর হতে পারি। আমি যা পারি, তা দিয়েই মানুষের কাছে আমাদের জীবন তুলে ধরবো। এই চিন্তা থেকেই ছবি আঁকাকে হাতিয়ার বানাই।"
স্বপ্নচারী এই তরুণ চান, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে জানবে মানুষ। কারো কাছেই অজানা, অদেখা বা উপেক্ষিত হয়ে থাকতে নারাজ এই শিল্পী। তাই নতুন প্রজন্মের কাছেও তার আর্জি 'কেউ যেন ভুলে না যায় নিজের শেকড়। সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে সামগ্রিক মঙ্গলই যেন হয় চিন্তার প্রধান বিষয়।