বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ এখন কোথায়
দেশে উদযাপিত হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন- তারই নিদর্শন রাখল বাংলাদেশ। এদেশের জন্মের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম এককভাবে জড়িত বলেই জানে সকলে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সামর্থ্য ও সক্ষমতার শুরু করেছিলেন মাত্র ২৯ বছর বয়সে, ১৯৪৯ সালে। তখন এই ভূখণ্ডে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক প্রথম মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। যে দলটির সেসময়ের মূল নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী। তিনি ছিলেন দলটির সভাপতি। দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন জনাব শামসুল হক।
কথিত আছে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের অন্তরালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব একটি ভূমিকা পালন করেছিলেন। যদিও তিনি এই দলটির নেতৃত্বে কোন অংশে যোগদান করেন নাই। তিনি বরঞ্চ এই সময়কালের পরেই পশ্চিম পাকিস্তানে জিন্নাহ মুসলিম লীগ নামক আরেকটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে ২৯ বছর বয়সে আওয়ামী মুসলিম লীগ দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। আর তার এক বছরের মাথায় দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেই আওয়ামী মুসলিম লীগের গর্ভ থেকেই ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।
আওয়ামী লীগের মূল নেতা ও সভাপতি হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম ভিত্তি রচনা করেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের এই অংশে পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন নিজ ভূমি গোপালগঞ্জ থেকে। সে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অগ্রণী সৈনিক ছিলেন মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও একেএম ফজলুল হক।
যুক্তফ্রন্টের প্রধান দলগুলো ছিল; কৃষক প্রজা পার্টি, আওয়ামী লীগ, গণতান্ত্রিক পার্টি এবং সে সময়কার ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলামী এই ফ্রন্টে অংশ নিয়েছিল। এরা মূলত মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গের কর্তৃত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যেই যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যারা সেই সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক পার্টি নামক দলটি মূলত ছিল সেই সময়ের নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক শাখা।
যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মাধ্যমে যে মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছিল সেই মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুকে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল শিল্প, বাণিজ্য, দুর্নীতি দমন, শ্রম, ও গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ক্ষুদ্র শিল্প ও কুটির শিল্প (বিসিক )গঠিত হয় ১৯৫৭ সালে। তেমনিভাবে, সেই সরকারে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি দমন ব্যুরোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই সময় দুর্নীতি দমন ব্যুরো বেশকিছু নতুন আইন সংযোজন করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল অ্যান্টি-করাপশন অ্যাক্ট- ১৯৫৭।
যে সমস্ত আইনগুলো আজ দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যবহার করছে তার মধ্যে একটি আইন দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ গঠন। এই আইনের বলে তারা যে যেকোনো নাগরিকের সম্পত্তির তালিকা চাইতে পারে।
১৯৫৪ সালে গঠিত প্রাদেশিক সরকার ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল, যদিও এই সময়কালে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার পরিবর্তন হয়; শেরে বাংলা ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, আবুল হোসেন সরকার এই তিনজন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন সেই সময়ে। কিন্তু, বঙ্গবন্ধু তার অধীন পাঁচটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন । ১৯৫৭ সালের শেষে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীসভা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য।
মন্ত্রীসভার সকল দায়িত্ব ত্যাগ করার এই দৃষ্টান্ত বর্তমানকালে খুবই বিরল। এদেশে এখন মন্ত্রীত্ব প্রত্যাশী লোকের সংখ্যা কত- তা জনগণ জানে না। ১৯৫৭ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন- তার অল্প কিছুকাল পরেই পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয় ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের সাবেক এই মন্ত্রীর কারাগারে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তার পরিবারকে ঢাকা ত্যাগ করতে হয়েছিল। আজকের যুগে এমন কথা শোনাও যায় না।
বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা কন্যা শেখ হাসিনাসহ পরিবারের অন্যদের নিয়ে গোপালগঞ্জের বাড়িতে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু যত দিন কারাগারে ছিলেন- ততদিন গোপালগঞ্জে বসবাস করেছে পরিবারটি। মহান এ নেতার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে বাঙালিকে একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে যে, তার মতন দীর্ঘ ও সংগ্রামী রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় কেউ এ ভূখণ্ডে এখনও জন্ম নেয়নি। অথচ সেই বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যেই এদেশের একটি রাজনৈতিক দল বারবার একজন সামরিক কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। যে সামরিক কর্মকর্তা দেশের রাজনীতির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নিজেও কখনো এই দাবি উত্থাপন করেন নাই। কিন্তু, তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি তার মৃত্যুর পর এভাবেই তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য যে সামরিক কর্মকর্তাকে বঙ্গবন্ধু দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব প্রদান করেছিলেন, সেই সামরিক কর্মকর্তাই ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা হবে না বলে পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পার্লামেন্টে পাস করিয়ে ও তাতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাক্ষর করে দেশের আইনে পরিণত করেন। ওই আইন দেশের সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক ছিল, কারণ যেকোনো হত্যার বিচার মানুষের মৌলিক অধিকার, যার স্বীকৃতি আমাদের সংবিধানই দিয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী এদেশের মানুষকে দীর্ঘ এক বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
১৯৯১ সালে সামরিক শাসন অবসানের পর পার্লামেন্টে এই পঞ্চম সংশোধনীর ইনডিমিনিটি অংশ বাতিলের দাবিতে আওয়ামী লীগ যখন সোচ্চার হয়েছিল- তখন সেই সামরিক কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়। তারা তখন সেই বিল পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বাংলাদেশের সমাজের বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার ভেতর দিয়ে। আজকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে মনে হয়, সেখান থেকে দেশ হয়ত আগামীতে বেরিয়ে আসবে। তবে মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি করা না হলে, দেশের উন্নয়ন তার লক্ষ্যে পৌঁছবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গঠন করা যাবে না।
দেশের বর্তমান অবস্থায় মানুষকে গভীরভাবে ভাবতে হবে বঙ্গবন্ধু দেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা আজ কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে! দেশের আনাচে-কানাচে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার অপচেষ্টা করছে মৌলবাদীরা। এরা ১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধিতা করেছিল। সেই চিন্তার ধারকরা আজকে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই তাদেরকে রাজপথে মিছিল করতে দেখা যায়। এই ডামাডোলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা আগামীতে হারিয়ে যাবে কিনা সেটাও আজ বড় প্রশ্ন।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক