সিরিঞ্জের জন্য যখন বিশ্ব জুড়ে হাহাকার, তখন মিনিটে ৫,৯০০ সিরিঞ্জ সরবরাহের চ্যালেঞ্জ নিলেন রাজীব
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সিরিঞ্জ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান- হিন্দুস্তান সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিক্যাল ডিভাইসেস। নভেম্বরের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটি ইউনিসেফের কাছ থেকে জরুরি এক ইমেইল পায়। জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। সংস্থাটি তাদের বিপুল সংখ্যক সিরিঞ্জের চাহিদা জানিয়ে মেইলটি পাঠিয়েছিল। তবে, এই সিরিঞ্জটি হতে হবে বিশেষ ধরনের। সাধারণ সিরিঞ্জের তুলনায় এর আকার হবে ছোট। পুনর্ব্যবহারের ঝুঁকি এড়াতে একবার ব্যবহারের পরই সিরিঞ্জ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তবে, তার থেকেও বড় কথা, তাৎক্ষণিকভাবে বিশাল পরিমাণে এই সিরিঞ্জ জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করতে হবে।
হিন্দুস্তান সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিক্যাল ডিভাইসেসের নির্বাহী পরিচালক রাজীব নাথ অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত ছিলেন না। "আমি ভাবলাম, কোনও ব্যাপারই না," বলেন রাজীব। "আমরা যে কারও তুলনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে সিরিঞ্জ সরবরাহ করতে পারব," মন্তব্য করেন তিনি। রাজীবের আত্মবিশ্বাসের পিছে ছিল অগ্রীম বিনিয়োগ। মহামারির টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনার মাঝেই সিরিঞ্জ নির্মাণের পেছনে তিনি লাখ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে প্রস্তুতি নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশ্বব্যাপী আট থেকে ১০ বিলিয়ন সিরিঞ্জের প্রয়োজন। তবে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ভ্যাকসিনের জন্য তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সিরিঞ্জ নেই। জানুয়ারিতে, টিকাদান কর্মসূচীতে সংকটের সৃষ্টি হওয়ায় ব্রাজিলও সিরিঞ্জ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
অন্যদিকে, সব ধরনের সিরিঞ্জই টিকাদানের জন্য যথাযথ নয়। যেমন- ফাইজার ভ্যাকসিনের সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে সিরিঞ্জের ধারণক্ষমতা নির্ভুলভাবে ০.৩ মিলিলিটার হওয়া প্রয়োজন। এমনকি ভ্যাকসিনের অপচয় রোধ করতে সিরিঞ্জের ডেড স্পেসও সর্বনিম্ন রাখা জরুরি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিচ সল্যিউশনসের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম সিরিঞ্জ সরবরাহকারী। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাল্লা দিয়ে সিরিঞ্জ রপ্তানি করে থাকে। বার্ষিক সিরিঞ্জ রপ্তানির মিলিত আয় প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, সিরিঞ্জ উৎপাদন ও রপ্তানিতে ভারত বৈশ্বিকভাবে বেশ পিছিয়ে। ২০১৯ সালে দেশটি মাত্র ৩২ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সিরিঞ্জ রপ্তানি করে বলে জানান রাজীব নাথ।
রাজীব আরও জানান, তার প্রতিষ্ঠানের নির্মিত প্রতিটি সিরিঞ্জ মাত্র তিন সেন্ট মূল্যে বিক্রি করা হবে। কিন্তু, হিন্দুস্তান সিরিঞ্জের বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। রাজীব বিশেষ ধরনের এই সিরিঞ্জ প্রস্তুতে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক বিক্রির প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ অর্থ এখানে ছিল। সিরিঞ্জের অর্ডার আসার বহু আগেই রাজীব বিনিয়োগ করেছিলেন। মে মাসেই তিনি ইতালি, জার্মানি এবং জাপান থেকে সিরিঞ্জের জন্য নতুন মোল্ড আমদানি করেন।
নয়াদিল্লির পার্শ্ববর্তী এলাকায় ধুলোময় অঞ্চলে ১১ একর জুড়ে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা অবস্থিত। রাজীব নাথ নতুন করে ৫০০ জন কর্মী নিয়োগ দেন। ফলে বর্তমানে, কারখানায় প্রতি মিনিটে ৫ হাজার ৯০০ সিরিঞ্জ উৎপাদন করা সম্ভব। রোববার এবং সাধারণ ছুটি বাদ দিয়ে কারখানায় প্রতি বছর আড়াই বিলিয়ন সিরিঞ্জ উৎপাদিত হয়। তবে, এবছরের জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তিন বিলিয়ন পর্যন্ত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।
ইউনিসেফের টিকাদান কর্মসূচির সাথে কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা আছে হিন্দুস্থান সিরিঞ্জের। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি দরিদ্র দেশগুলোতে ইউনিসেফের টিকাদান কর্মসূচিতে সিরিঞ্জ সরবরাহ করেছে। এসব দেশে সিরিঞ্জের পুনর্ব্যবহার একটি প্রধান সমস্যা। ব্যবহৃত সিরিঞ্জ দ্বিতীয়বার ব্যবহারের ফলে এইচআইভি এবং হেপাটাইসিসের মতো প্রাণঘাতী ব্যাধির সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফাইজারের টিকার জরুরি ব্যবহারের ঘোষণা দেয়। কোপেনগেহেনে ইউনিসেফের কন্ট্রাক্ট ব্যবস্থাপক রবার্ট ম্যাথিউজ এবং তার দলের উপর দায়িত্ব পড়ে বিপুল সংখ্যক সিরিঞ্জ উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করবার।
ম্যাথিউজ জানান, হু এর চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ সরবরাহকারীর খোঁজে প্রথমেই তারা হিন্দুস্তান সিরিঞ্জের কাছে যান।
ইউনিসেফ জানান, মান যাচাই পূর্বক প্রতিষ্ঠানটি শীঘ্রই ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন সিরিঞ্জ সরবরাহ শুরু করবে।
রাজীব নাথ জানান, তিনি ভারত সরকারের কাছে ৪০০ মিলিয়নের বেশি সিরিঞ্জ সরবরাহ করেছেন। অন্যদিকে জাপানেও ১৫ মিলিয়ন সিরিঞ্জ রপ্তানি করেন। ইউনিসেফ ছাড়াও ব্রাজিলসহ অন্যান্য গ্রাহক এখন সিরিঞ্জের জন্য অপেক্ষা করছেন। সবাইকে সন্তুষ্ট করতে এখন তিনি আরও ২৪০ মিলিয়ন সিরিঞ্জ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন।
সিরিঞ্জের দক্ষতা বৃদ্ধিতে রাজীব নাথ মার্ক কসকার ডিজাইনকৃত সিরিঞ্জের উপর নির্ভর করেন। বৃটিশ উদ্ভাবক কসকা নিরাপদ ইঞ্জেকশন প্রস্তুতের ব্যখ্যা দিয়েছিলেন। হিন্দুস্থান সিরিঞ্জ জাপান থেকে আমদানিকৃত স্টেইনলেস স্টিক স্ট্রিপ থেকে সুঁই উৎপাদন করে।
তবে সিরিঞ্জ ব্যবসাকে জোঁকের মতো 'রক্তচোষা' বলে মন্তব্য করেন রাজীব নাথ। তিনি জানান, এই ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিমাণ বিশাল হলেও, লাভের বিষয়টি বেশ সীমিত। আগামী বছর গুলোতে সিরিঞ্জের চাহিদা যদি অর্ধেকেও নেমে আসে, বিনিয়োগের ১৫ মিলিয়ন ডলারই হারাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নিশ্চিত ভাবেই কাজটি বেশ হিসাব-নিকাশের সাথেই পরিচালনা করতে হয়। রাজীব নাথের অফিসের নীল কার্পেটটি সিড়ির ঝাড়বাতির মতোই পুরনো এবং মলিন। ১৯৮৪ সালে, পরিবারের কাছে ব্যবস্থা হস্তান্তরের আগে রাজীব নাথের বাবাই অফিসে জিনিসগুলো স্থাপন করেছিলেন।
রাজীব আরও জানান, পারিবারিক ব্যবসাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এখানে, অংশীদার নেই। নেই কোনও হস্তক্ষেপ বা দুশ্চিন্তা। ১৯৯৫ সালে রাজীব নাথ উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন পড়ে। তখনই তিনি প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিনিয়োগের মুখাপেক্ষী হন। তবে, আজ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে, তিনি সম্ভবত নিজের ইন্দ্রীয়কে অনুসরণ করে বিশাল এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারতেন না বলে মন্তব্য করেন রাজীব নাথ।
'রাতের ঘুম যথাযথ হওয়া প্রয়োজন," বলেন রাজীব নাথ। "ছোট পুকুরে বড় মাছ হয়ে চলাফেরা করাই উত্তম।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস