সৌদি আরব আসলে কতোটা ধনী?
মোট সম্পদ ও দেনার সামগ্রিক ব্যালান্স শিট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব। ইতোপূর্বে, হিসাবের বাইরে থাকা দেশটির প্রভাবশালী- রাষ্ট্রীয় তহবিলের অনেক বিনিয়োগ এবং ঋণকেও যার আওতায় আনা হবে।
দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "আর্থিক দিক থেকে বিবেচনা করলে এটি সরকারের প্রকৃত আয়-ব্যয় সক্ষমতার নাড়ি-স্পন্দন নিরূপণের উদ্যোগ। স্বাস্থ্য পরীক্ষার এমআরআই স্ক্যানের মতো এখানেও আর্থিক হালচিত্রের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।" বর্তমানে হিসাবের বাইরে থাকা দেনা ও সম্পদকেও এর আওতায় আনার কথা নিশ্চিত করেন তিনি।
অর্থনীতি সংস্কার ও বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি তেল রপ্তানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চান সৌদি আরবের নেপথ্য শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। সেজন্য তিনি দেশটির প্রধান রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল- পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) থেকে নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন। ইতোমধ্যেই, অনেক বিনিয়োগ করাও হয়েছে।
বর্তমান বিন সালমান পিআইএফ- চেয়ারম্যান। তিনি পিআইএফ'কে একটি নিভৃত সম্পদ তহবিল থেকে বৈশ্বিক পুঁজি লগ্নীর কেন্দ্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। যার আওতায় তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক পরিবহন কোম্পানি উবার-সহ, পুঁজিবাজারে অন্যান্য শীর্ষ কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়। এমনকি তিনি জাপানি তহবিল সফটব্যাংকেও হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন।
এসব পুঁজি নিবেশের আর্থিক তথ্য প্রকাশিত হয়নি, ফলে দেশটির জাতীয় বাজেট তৈরির সময়েও বিনিয়োগের হালনাগাদ তথ্য অনুপস্থিত থাকে। অর্থাৎ, বাজেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রকৃত আর্থিক সঙ্গতি জানতে পারে না সাধারণ জনগণ।
অবশ্য, শুধু সৌদিতে নয়, দেনা ও সম্পদের পরিসংখ্যান নিয়ে লুকোচুরি উপসাগরীয় প্রায় সব দেশেই প্রচলিত ঘটনা। তারপরও, পিআইএফ- এর সাম্প্রতিক ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের উদ্যোগগুলো এবং সেগুলো ঘিরে অস্পষ্টতা বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।
"কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সহজে লেনদেন যোগ্য অনেক সম্পদ সাম্প্রতিক সময়ে পিআইএফ- এ স্থানান্তর করা হয়েছে। কারণ, রাস্ত্রীয় তহবিলটির অপেক্ষাকৃত কম লেনদেনযোগ্য সম্পদ আসলে অস্পষ্ট ধাঁচের বিনিয়োগ হওয়ায়- তা সরকারি খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বাড়িয়েছে," বলছিলেন মার্কিন আর্থিক পরামর্শক সংস্থা ফিচ' এর সার্বভৌম তহবিল গবেষণা দলের প্রধান কিরজানিস ক্রুসটিন্স।
তিনি বলেন, "সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকারীরা সৌদি সরকার এবং পিআইএফ এর মতো একটি বড় তহবিলকে পরস্পর সম্পৃক্ত হিসেবে দেখে থাকেন। তাদের কাছে উভয়ের ঝুঁকিও একই। সোজা কথায়, ভবিষ্যতে পিআইএফ- এর দেনা এক সময়ে সৌদি সরকারের নিজস্ব ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।"
রয়টার্সের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে, এব্যাপারে সৌদি সরকারের জন-সংযোগ বিভাগ অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
আরামকো'র শত শত কোটি ডলার:
গেল বছরের শেষ দিক থেকেই তথাকথিত- রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা (এসএএলএম) নামের এই পরিসংখ্যানের রুপ-কাঠামো নিয়ে কাজ করছে সৌদি সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। এবং কখন এটি সম্পন্ন হবে বা এর ফলাফল কীভাবে প্রকাশিত হবে, সেই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, "বৈশ্বিক মাপকাঠির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনেক দেশই সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি যথাযথ ব্যবস্থা তৈরিতে বেশ কয়েক বছর সময় ব্যয় করেছে।"
পিআইএফ এর অর্থের উৎস অত্যন্ত শক্তিশালী। ২০১৫ সালের ১৫ হাজার কোটি ডলার থেকে, ২০২০ সাল নাগাদ তহবিলটির সম্পদ ৪০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়। সৌদি আরবের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি আরামকো'র পুঁজিবাজার অন্তর্ভুক্তির প্রেক্ষিতে সেখানে থাকা পিআইএফ এর অংশীদারিত্ব থেকে আরও ৭ হাজার কোটি ডলার আসবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকেও ৪ হাজার কোটি ডলার পেয়েছে তহবিলটি।
ইতোপূর্বে, ২০১৯ সালে আরামকোর আইপিও থেকেও ৩ হাজার কোটি ডলার আয় করেছিল পিআইএফ।
২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২১শ' কোটি ডলার ঋণ নেয় তহবিলটি। নতুন আরেকটি ঋণ উদ্যোগের মাধ্যমে ১ হাজার কোটি ডলারের ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বলেও নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
স্বাভাবিক পদ্ধতি!
জ্বালানি তেলের বিপুল প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও; দেশটির যুব সমাজের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এখন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
২০১৬ সাল থেকেই সৌদি সরকার লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ২০৩০ সাল নাগাদ বেকারত্বের হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। তবে বার্ষিক বাজেট ঘাটতির কারণে এখাতে আশানুরুপ হারে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তার উপর করোনা মহামারির আঘাতে গেল বছর বেকারত্বের হার ১৫.৪ শতাংশে উন্নীত হয়।
বাজেট ঘাটতির পরিমাণ গেল বছর ছিল মোট জিডিপি'র ১২ শতাংশ। সেটি চলতি বছরে ৪.৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে রিয়াদ বিপুল পরিমাণ ব্যয় সংকোচন করেছে। উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়েছে কর্মসংস্থান তৈরির জন্যে বিনিয়োগ।
তার পরিবর্তে পিআইএফ- এর সাহায্যে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে সরকারি ব্যয়ের অভাব পূরণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে, আছে ৫০ হাজার কোটি ডলারের হাই-টেক ব্যবসা কেন্দ্র 'নিওম' এবং সম্প্রতি ঘোষিত 'দ্য লাইন' নামের আরেকটি সুবৃহৎ প্রকল্প। নিওমের অভ্যন্তরে কার্বন দূষণমুক্ত ১০ লাখ বাসিন্দার নতুন শহর 'দ্য লাইন' তৈরিতে কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাশপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতে ২০২৫ সাল নাগাদ, প্রতিবছর ৪ হাজার কোটি ডলার যোগ করার পরিকল্পনা করছে পিআইএফ। একইসময়ে, তহবিলটির নিজস্ব সম্পদ ৪ লাখ কোটি রিয়াল বা ১ লাখ ৭ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
"যুবরাজ জানেন অর্থনীতি প্রতিবছর সাড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি গতিতে না বাড়লে যুব সমাজের বেকারত্বের হার; বর্তমান অবস্থায় থাকবে বা তা আরও বাড়বে। বেকারত্ব থেকে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা জন্ম নিতে পারে," পিআইএফে রাষ্ট্রীয় তহবিল স্থানান্তরের প্রসঙ্গে বলছিলেন লন্ডন ভিত্তিক স্যাম ক্যাপিটাল পার্টনার্সের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (মেনা) অঞ্চলের তহবিল ব্যবস্থাপক খালেদ আব্দুল মাজিদ। তার সংস্থা বিনিয়োগ পরামর্শক হিসেবে কাজ করে।
তার মতে, "এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক চ্যানেলে প্রচলিতভাবে অর্থ স্থানান্তরে অনেক বেশি সময় লাগতো। তাই সময় স্বল্পতার কারণেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।"
- সূত্র: রয়টার্স