ঢাকার বই
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে
জজ সাহেব ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ঢাকা শহরের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বড় সাহেবদের মেয়েদের নিয়ে পদ্য লিখলে আদালত অবমাননার সম্ভাবনা আছে, ভিন্ন ধারায়ও মামলা হতে পারে। কিন্তু বঙ্গেশ্বর রায় যখন জজ সাহেবের মেয়ের পেখম মেলার কথা লিখলেন, কড়া জজ সাহেব কিছুই বললেন না, পদ্যটা মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে ছাদ পেটানোর গানে পরিণত হলো।
নতুন সহস্রাব্দের কুড়ি বছর পার হতে চলেছে -- ছাদ পেটানোর গান কেউ শুনেছেন? অথচ এই কুড়ি বছরে অন্য যেকোনো কুড়ি বছরের তুলনায় অনেক বেশি ছাদ নির্মিত হয়েছে। ষাটের দশকেও ছাদ পেটানোর ছন্দবদ্ধ আঘাতের সাথে নারী শ্রমিকরা কোন গানটি গাইছেন শোনার জন্য আমার মতো আরো কেউ কেউ কান পেতেছিল। এখন ছাদ পেটানোর ব্যাপার নেই, গানও নেই, পেশাটাই অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তারপরও বঙ্গেশ্বর রায়ের গানটা কি ছিল? একবার পাঠ তো করি :
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে
মহব্বতের রশির টানে উধাও হইয়াছে
কেলাস নাইনের ছাত্রী আছিল
গতর-শোভা ভালাই আছিল
কেম্বে কমু হগল কথা সরম অইতাছে।
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে
তাইরে নারে তাইরে নারে
কোথাও খুঁজে পায়না তারে
চান্দিঘাটে নসা ডিপটি মজা লুটতাছে
জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে।
প্রয়াত কবি রবিউল হুসাইনকে ধন্যবাদ। তার সম্পাদিত 'কবিতায় ঢাকা' গ্রন্থে শতবছর আগের ছাদ পেটানোর এই গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে আমার জন্ম সলিমউল্লাহ এতিম খানা সংলগ্ন সরকারি ম্যাটার্নিটিতে। এতিমখানার কারণে রাস্তাটি কি তখন অরফাজেন রোড ছিল? নাজির হোসেনের 'কিংবদন্তির ঢাকা' পড়ে জানলাম মোটেও তা নয়। এক সময় কাছাকাছি একটি হিন্দু বালক আশ্রম ছিল, সেটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেলেও রাস্তার নামটি রয়ে গেছে অরফানেজ রোড। ঢাকার ইতিহাস, ঢাকার কাহিনী নিয়ে অন্তত এক কুড়ি বই আমি পড়েছি। সবচেয়ে বিশ্বস্ত মনে হয়েছে দুটি সরকারি প্রকাশনা : হান্টার সাহেবের স্ট্যাটিসটিকাল অ্যাকাউন্টস অব বেঙ্গল (পঞ্চম খন্ড) এবং বিসি অ্যালেনকৃত ঢাকা ডিস্ট্রিক্স গেজেটিয়ার্স। আগ্রহী পাঠকের জন্য ঢাকা বিষয়ক আরো কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করছি এবং চারটি বই নিয়ে লিখছি। গুরুত্বপূর্ণ আরো বই নিশ্চয়ই আছে, আগ্রহী পাঠক তা খুঁজে নেবেন।
ঢাকা নিয়ে বই
কেদারনাথ মজুমদার: ঢাকার ইতিহাস
জেমস টেইলর: কোম্পানি আমলে ঢাকা
সরদার ফজলুল করিম: চল্লিশের দশকে ঢাকা
হাকিম হাবিবুর রহমান: ঢাকা পাচাশ বারস পহেলে
আহমদ হাসান দানী: কালের সাক্ষী ঢাকা
নাজির হোসেন: কিংবদন্তির ঢাকা
মুনতাসির মামুন: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ঢাকা, ঢাকা সমগ্র, ঢাকার স্মৃতি, হৃদয়নাথের ঢাকা শহর
স্যার চার্লস ডয়লী: ঢাকার প্রাচীন নিদর্শন
সাঈদ আহমেদ: ঢাকা আমার ঢাকা
শামসুর রাহমান: স্মৃতির শহর
কাজল ঘোষ সম্পাদিত: স্মৃতির ঢাকা, নানা রঙের ঢাকা
মুনশী রহমান আলী তায়েশ: তাওয়ারিখ-ই- ঢাকা
শরীফ উদ্দিন আহমেদ: ঢাকা: ইতিহাস ও নগর জীবন ১৮৪০-১৯২৯
সৈয়দ মাহমুদুল হাসান: মসজিদের নগরী ঢাকা
অনুপম হায়াত: নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও স্মৃতি
এ কে এম শাহনাওয়াজ: ঢাকা : ইতিহাস ও ঐতিহ্য
মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান: বিজন জনপদ থেকে রাজধানী ঢাকা
রিদওয়ান আক্রাম: ঢাকার কোচোয়ানরা কোথায়
মফিদুল হক: চল্লিশের দশকের ঢাকা
মুনতাসির মামুন: কর্নেল ডেভিডসন যখন ঢাকায়, স্মৃতিময় ঢাকা, উনিশ শতকের ঢাকা, ঢাকার প্রথম
এশিয়াটিক সোসাইটি: ঢাকা কোষ, ঢাকাই খাবার
আলী ইমাম: জাহাঙ্গীরনগর থেকে ঢাকা
মোহাম্মদ হান্নান: ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস
হাফিজা খাতুন: ঢাকাইয়াস অন দ্য মুভ (ইংরেজি)
রফিকুল ইসলাম: ঢাকার কথা
কাবেদুল ইসলাম: ঢাকা জেলার ভূমি ব্যবস্থা ও ভূমিরাজস্ব প্রশাসনিক ইতিহাস
সরলানন্দ সেন: ঢাকার চিঠি
শেখ মেহেদী হাসান: ঢাকার সংস্কৃতি
আবদুল করিম: ঢাকা দ্য মুঘল ক্যাপিটাল (ইংরেজি)
এঢ.বি ব্র্যাডলি বার্ট: দ্য রোমান্স অব ইস্টার্ন ক্যাপিটাল (রেহিমুদ্দিন সিদ্দিকী অনুদিত প্রাচ্যের রহস্যনগরী)
এস এম তাইফুর: গ্লিম্পসেস অব ওল্ড ঢাকা (ইংরেজি)
আজিমুশ্বান হায়দার: ঢাকা : হিস্ট্রি অ্যান্ড রোমান্স ইন প্লেস নেইমস (ইংরেজি)
জেমস টেয়লর: আ স্কেচ অব দ্য টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স অব ঢাকা (ইংরেজি)
মন্দিরা ভট্টাচার্য: ঢাকার স্মৃতি ও ডাক্তার নন্দী
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া: বৃহত্তর ঢাকার প্রাচীন কীর্তি
বাংলাদেশ সরকার: ঢাকা জেলা গেজেটিয়ার
তাওয়ারিখ-ই-ঢাকা
তাওয়ারিখ মানে বহু বচনার্থে ইতিহাস। মুনশী রহমান আলী আয়েশের তাওয়ারিখ-ই-ঢাকা বা ঢাকার ইতিহাস উর্দু ভাষায় লিখিত গ্রন্থ। আলী তায়েশ ঢাকার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারি ছিলেন। তিনি রাসুল ও শিশুতোষ গ্রন্থের রচয়িতা। তবে তার শ্রেষ্ঠ কাজ তাওয়ারিখ-ই- ঢাকা। আ স ম শরফুদ্দীন গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন। গ্রন্থকার ১৯০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স আনুমানিক ৮৫ বছর। ১৯১০ সালে তার পুত্রের তত্ত্বাবধানে বইটি প্রকাশিত হয়। বইটির সিংহভাগ জুড়ে ঢাকা তথা বাংলার ইতিহাস। অনেক খুঁটিনাটি বিষয়সহ লিখেছেন। অনুমান করা যায় বইটি দীর্ঘসময় ধরে লিখিত। তিনি সমকালীন বিষয়, ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও লিখেছেন।
তার সময়ের ঢাকার উত্তরাংশের গভীর বনজঙ্গলে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, শূকর প্রভৃতি ছিল। ইংরেজ সাহেবগণ এবং দেশিয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সেখানে শিকার করতে যেতেন। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখানদীগুলো এ জেলাকে খন্ডবিখন্ড করে রেখেছে। তার রচিত ইতিহাস অংশ পাশ কাটিয়ে তার সময়কার ঢাকার কিছু বিবরণ ও বৈশিষ্ট তুলে ধরা হল :
গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের নাম 'ঢাকার প্রাচীন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সর্দারগন'- এ মুহাম্মদ মুকীম নামের অত্যন্ত ধনী এক ব্যক্তির কন্যা তার অন্দরমহলের পুকুরে প্রতিদিন গায়ের একটি অলঙ্কার ছুঁড়ে ফেলত এবং অলঙ্কারের পানিতে ডুবে যাওয়াটা খুব উপভোগ করত। প্রতিদিনই তাকে নতুন করে অলঙ্কার কিনে দিতে হতো। এক সময় মুহাম্মদ মুকীমের মৃত্যু হয়। মেয়ের সম্পদও শেষ হয়ে আসে -- সম্পদ ফুরিয়ে যাবার পর সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে -- দারিদ্র্য ও রোগশোকে তার মৃত্যু হয়। মুনশী আলী তায়েশ ১৮৬৬ পরবর্তী আর্মেনিয় সম্প্রদায়ের বিবরণ দেন; আদমশুমারি অনুযায়ী তখন ঢাকায় ১১৩ জন আর্মেনিয় ছিল। ১৮৭০ সালে জি এম পগোজ জানান, ঢাকায় আর্মেনিয়দের সংখ্যা ছিল ১০৭ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৩৯ জন, নারী ২৩ জন এবং শিশু ৪৫ জন। পুরুষদের মধ্যে একজন ছিলেন ব্যারিষ্টার এবং পাঁচজন ছিলেন জমিদার।
ঢাকার পালোয়ান
তিনি ঢাকার পালোয়ান মীর্জা মুন্নার বর্ণনা দেন, তাকে প্রতিদিন দশ সের পোলাও খেতে হতো। কাঠের চকিতে বসলে তা ভেঙ্গে যেত, তিনি পাথরের চকিতে বসতেন। বুড়িগঙ্গার তীরে জিঞ্জিরায় নবাব ইব্রাহিম খানের সাথে অবস্থানের সময় নদীতে বড় কুমির ভেসে উঠে। নবাবের বন্ধুরা তাকে কুমিরের সাথে লড়াই করতে প্ররোচিত করে। তিনি খড়্গ নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেই বড় হা করে কুমির তাকে গিলে নেয়। ফলে সকলেই ব্যথিত ও অপরাধী বোধ করেন। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় মীর্জা মুন্না সাঁতার কেটে চলে আসছেন- পেছনে কুমিরটাও ভেসে উঠেছে। মির্জা মুন্না কুমিরের পেট চিরে বেরিয়ে এসেছেন। একবার হাতির দাঁত কেটে বানানো দুটো ডিম দু হাতে চেপে চূর্ণ করার সময় তার সমস্ত শরীরে শিরা উপশিরায় প্রবল রক্ত প্রবাহিত হয় এবং তিনি মারা যান।
ঢাকার হোসেনী দালানের পাশে ছিলেন বিখ্যাত পালোয়ান হসনু খলিফার আখড়া। তার উল্লেখযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন রজবী খলিফা ফত্তি, দখরাতি ভাগীরথ ঠাকুর, সানু খলিফা প্রমুখ। সেকালে প্রত্যেক মহল্লায় দু-একটা করে আখড়া থাকত এবং সেখানে ডন ও মল্লযুদ্ধের মহড়া চলত। ওমর পালোয়ান পাঞ্জাবি মীর্জা পালোয়ানকে পরাজিত করে বিখ্যাত হয়ে উঠেন।
ঢাকার কবি ও সঙ্গীত শিল্পী
নবাব আবদুল গণির ভাগ্নে খাজা মুহাম্মদ আফজল কবি আফজল নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ফার্সি ছন্দের জাদুকর হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি উর্দু গজলও রচনা করেন। তিন খন্ডের মাজসুয়া তারীখ রচনা করেন। নবাব আহসান উল্লাহর স্ত্রীর মৃত্যুতে প্রকাশ করেন 'পাম-মাহ-ই-পায়কর' নামের পুস্তিকা। দিল্লির বিখ্যাত কবি দাগ-এর মৃত্যুর পর তিনি ৭১টি তারীখ রচনা করেন। শহরে তিনি 'আফজল আল-মুয়াররিখীন' নামেও খ্যাত ছিলেন। আসাদউদ্দীন হায়দর কবি খাজা আফজলের শিক্ষক। তিনিও জাদুকরী কাব্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। নবাব আবদুল গণির মৃত্যুতে তিনি একটি মসনবী রচনা করেন। তিনি ব্যাঙ্গাত্মক কবিতাও লিখতেন। কবিদের মধ্যে আরো ছিলেন হাজী সৈয়দ মুহাম্মদ বাকের (কাব্যগ্রন্থ : গঞ্জিনা বাকের), মুনশী আবদউন নঈম তায়িব ছদ্মনাম নিয়ে লিখতেন, খাজা হায়দার জাহান দিল্লির মীর্জা আসাদ-উল্লাহ গালিবের সাথে পত্র যোগাযোগ করে নিজের কবিতার সংশোধন ও মানোন্নয়ন করতেন। নবাব খাজা সলিমুল্লাহর পুত্র খাজা আবদুর রহীম 'সাবা' ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। আরও ছিলেন খাজা আবদুল গাফফার মীর উজির আলী। মাষ্টার সৈয়দ আহমদ হুসাইন ইংরেজি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখতেন। মস্তিষ্ক বিকৃত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। নবাব স্যার আহসানউল্লাহও শাহিন ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। খাজা আফজলের লাইব্রেরিতে তার রচিত 'কুল্লিয়াত' পাওয়া যায়।
দিল্লী থেকে আগত দুই ভাই ইমাম বক্স ও রহিম বক্স ছিলেন শহরের সেরা গায়ক। ইমাম বক্স গাইতেন ধ্রুপদ ও খেয়াল আর রহিম বক্স পাট্টা সঙ্গীত। দুইজনেই ঢাকার স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। শিল্পী মিঠন খানকে বলা হতো ঢাকার তানসেন। পরবর্তী সময়ে হাবিব মিয়া ও গোপাল নামের দুজন শিল্পীকে তানসেন ও বৈজ্জু বাওরা বলা হতো।
উকিল জজ ডাক্তার
ঢাকার মুসলমান বিচারপতি মীর আব্বাস আলী খান বাহাদুর আমীন-ই-আলা। আরমানিটোলায় নিজের বাড়িতে তিনি আমীরানা জীবনযাপন করতেন। তার মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরীরা বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। যখন তাওয়ারিখ-ই-ঢাকা লিখিত হয় তখন বাড়িটি জজ কোর্টের উকিল আনন্দ রায়ের দখলে। বেচারাম দেউরি মহল্লার মুহাম্মদ নাজিম খান বাহাদুরও নামকরা বিচারক ছিলেন।
হেকিম মীর জঙ্গ ছিলেন সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক। তার শিষ্য হেকিম কোরবান আলী এবং নিমতলীর হেকিম নিয়ামত উল্লাহ চিকিৎসক হিসেবে মশহুর। তবে শৈল্য চিকিৎসায় সবচেয়ে নামকরা পর্তুগিজ ডাক্তার ক্লিমন্তি। শহরের গ্রিক ও আর্মেনিয় অধিবাসী, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বড় বড় হিন্দু জমিদার, মুসলমান নবাব সকলেই বেগমবাজারের এই পর্তুগিজ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেন। তিনি বাস্তবিকই টাকার বিছানায় ঘুমোতেন বলে রটনা আছে। জেলখানার ডাক্তার হিসেবে সরকারি পেশায় নিযুক্ত গেবু ডাক্তার বাংলাবাজারের পোড়া মহল্লায় থাকতেন। পাটুয়াটুলিতে রাস্তার মাথায় তার আরো একটি দোতলা বাড়ি ছিল। নিচতলায় ছিল তার ডাক্তারখানা। সে সময়কার প্রসিদ্ধ ও ধনী ডাক্তারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। মুনশী আলী তায়েশ আফসোস করেছেন, তার তিন পুত্রের সকলেই অপদার্থ ছিল। তারা পিতার সম্পত্তি নষ্ট করে ভবঘুরে হয়ে পড়ে।
উকিলদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা ছিলেন মুনশী নন্দলাল দত্ত। তিনি তার অর্জিত লক্ষ লক্ষ টাকা জমিদারি কেনার পেছনে ব্যয় করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে তার বাড়ির নাচঘর ধ্বংস হয়ে যায়। জিন্দাবাহার লেনের গোকুল মুনশী, বেচারাম দেউরির হরি কিশোর রায়, সাভারের বরদা কিঙ্কর রায়, সঙ্গতটোলা মহল্লার উকিল আবদুল আলীম, বেচারাম দেউড়ির মৌলবি আমীরউদ্দিন মুহাম্মদ, হোসেনী দালানের মুনশী গোলাম আব্বাস নামকরা আইনজীবী ছিলেন। জজ কোর্টের উকিল মুনশী সৈয়দ গোলাম মোস্তফা যেমন ভালো কৌশলী ছিলেন তেমনি ভালো সাহিত্যিকও ছিলেন। ঢাকার বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফিক লিপিকারদের মধ্যে আগা আবদুল আলী, লালা মদন মোহন, মুনশী আরহম (তার লিপি অনুসরণে আরহমী হস্তলিপি প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য লিপিকারগণ তা অনুসরণ করেন) মুনশী নওয়াবজান এবং হোসেনী দালানের প্রতিষ্ঠাতা মীর মুরাদের ভাই মীর ইয়াকুব।
ঢাকা পাচাস বারাস পাহেলে
হেকিম হাবীবুর রাহমানের ঢাকা ১৯৪৫ সালের পঞ্চাশ বছর আগের ঢাকা। মোহাম্মদ রেজাউল করিম অনূদিত 'ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে' সামনে নিয়ে লিখছি। পূর্ব পুরুষ পেশোয়ার থেকে ঢাকায় হিজরত করে এবং ১৮৮১ সালে ঢাকার ছোট কাটরায় জন্মগ্রহণ করেন হেকিম হাবীবুর রাহমান। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার আগেই মার্চে তার মৃত্যু হয়। বিদ্বান এই মানুষটি চিকিৎসা সেবার বাইরেও রাজনীতি ও সমাজকর্মে জড়িত ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম উর্দু সাময়িকীর সম্পাদক তিনি। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ঢাকা বেতার থেকে পঞ্চাশ বছর আগের যে কথিকাগুলো তিনি পাঠ করেছেন সেগুলোর সমন্বয়েই এই বই। উনবিংশ শতকের শেষভাগের ঢাকা তার জীবন্ত স্মৃতি থেকে এই গ্রন্থে উঠে এসেছে।
টুপির কাহিনীতে তিনি দেখিয়েছেন একালের ভাষায় এটা ছিল ঢাকার সেকুলার পোশাকের অংশ-- উত্তর ভারত থেকে ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করা হিন্দুরাও মাথায় টুপি পরতেন। বাঙালি হিন্দুরাও তাদের অনুসরণ করতেন-- কেউ কেউ আবার ইংরেজদের ক্যাপও পরতেন। পাগড়ির হরেকরকম বাহার ছিল। প্রলেতারিয়েত ধাচের পাগড়ি ছিল লাঠিয়াল পালোয়ান এবং তরবারি চালনাকারি ফাকিতদের -- কম চওড়ার দশ-বারো হাত লম্বা এই পাগড়ি হৃদয়গ্রাহী করে বাধা হতো না। এর মূল লক্ষ্য ছিল আঘাত থেকে মাথাটাকে বাঁচানো।
তখনকার রমযান মাসের ঢাকার অসাধারণ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। ইফতারে ঠান্ডা পানি শরবতের জন্য অপরিহার্য ছিল। সেকালে তো রেফ্রিজারেটর ছিল না-- ধনীদের বাড়িতে শোরা (যবক্ষার) এর সাহায্যে পানি ঠান্ডা করা হতো কিন্তু গরীবরা নিজেদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে নিয়েছিল --ঐ সময় প্রত্যেক বাড়িতে কূপ ছিল। সুরাহী অথবা ঘড়ার মুখ বন্ধ করে দড়ির সাহায্যে দুপুরে অথবা সকালে কূপের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হতো এবং ইফতারের পূর্বে তা উঠানো হতো। এই পানি বরফের থেকেও ঠান্ডা হতো।
মসজিদে জমা হওয়া ইফতার সম্পর্কে তিনি বলেছেন রোজার প্রথম দিন মসজিদে এত ইফতার আসত যে খানেওয়ালারা বিপদে পড়ে যেত। ঢাকার খাবার নিয়ে কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে। হেকিম সাহেব যে খেতে ও খাওয়াতে পছন্দ করতেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে খাজা নাজিমউদ্দিন তার যে পরিচিতি লিখেছেন তাতে বিস্তারিত লিখেছেন। বছরে কয়েকবার তার বাড়িতে তৈরি নেহারির ভোজে তিনিও নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন।
ঢাকার 'হুক্কা, পান ও চা' নেশা ধরিয়ে দেবার মতো একটি অধ্যায়। বিয়েতে 'গোলামনাবাদ' নামের চা পরিবেশন করা হতো যা মূলত বিয়ের মহফিলের বিশেষ সরবত- কিন্তু আল্লাহ জানেন কিভাবে এর উপর চা নিজের অধিকার বিস্তার করেছে এবং গুলকন্দ ( রোজ সিরাপ) দারচিনি-লবঙ্গ ইত্যাদি মিলে অদ্ভুত স্বাদ তৈরি করেছে।
শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর
শামসুর রাহমানের জন্ম ঢাকার মাহুতটুলীতে। মহল্লার নামটি তার পছন্দের। অনেক আগে হয়তো শুধু মাহুতদের বসবাস ছিল পাড়াটায়, সেই রাজা-বাদশাহদের আমলে। মাহুতটুলীতে কিন্তু আমি কোনো হাতিশালা দেখিনি, হাতি দেখিনি, হাতির হাওদা দেখিনি, দেখিনি মাহুত-- সেই যারা হাতি চালায়-- মাহুতটুলীর গলিতে পালঙ্ক ছিল না, সোনা রুপোর কাঠি ছিল না, ছিল না ঘিয়ের প্রদীপ। কিন্তু ছিল একটা বাতি, গলির শেষ সীমানায় দাঁড়ানো। রোজ সন্ধেবেলা কাঁধে মই ঝুলিয়ে আসত বাতিঅলা। তার গলায় মাদুলি, মাথায় কিস্তি টুপি, কাত করে পরা। গায়ে তালিমারা ফতুয়া, খালি পা, হাঁটত হনহনিয়ে। শামসুর রাহমান অপেক্ষা করতেন কখন সূর্য অস্ত যাবে আর সেই বাতিঅলা আসবে।
জন্মের প্রথম দিন থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ঢাকাতেই কেটেছে তার জীবন। পুরোনো ঢাকার জীবন যত নিবিড়ভাবে তিনি দেখেছেন এবং কবিতায় তুলে এনেছেন এমনটি আর কেউ করেন নি।
ঢাকার মাতোয়ালা রাত কেমন?
হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও
আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি, চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।
আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, 'তুমি
ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।'
আমার গলায় কার গীত হুনি ঠাণ্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোন্হানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার, আশক
জমাদার লেইন, বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।
আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।
মাতোয়ালা রাতের এই বেসামাল মানুষটি মইফ্যার পোলা, জুম্মনের বাপ, হস্না বানুর খসম, নাম সুবারতি মিস্ত্রি, বেহায়া হলির চাম্পা তাকে চুমাচাট্টি দেয় আর বলে সে-ই নাকি তার মনের মানুষ আর দিলের হকদার। শামসুর রাহমান পুরোনো ঢাকার অন্যতম প্রধান চরিত্র এই মাতালকে এভাবে এঁকেছেন:
এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি এই নাকে আহে
গোলাপ ফুলের বাস, মাঠার মত চান্নি দিলে
ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বরাত, খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালির তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথথি দিয়া
মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।
শামসুর রাহমান তার স্মৃতির শহর ঢাকা-তে লিখেছেন ঢাকার কালা-ধলার লড়াইয়ের কথা। লিখেছেন গোরা সৈন্যরা যখন লালবাগ ঘিরে ফেলে, লড়তে লড়তে প্রাণ দেন চল্লিশ জন শ্যামল বরণ বীর বাঙালি সৈনিক।
নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকা
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ঢাকা নিয়ে যথেষ্ট খেটেখুটে লেখা একটি বইয়ের নাম যদি বলতে হয় তা অবশ্যই নাজির হোসনের কিংবদন্তির ঢাকা। পান্ডিত্য প্রকাশ করা ডেস্কভিত্তিক বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে-- তার প্রায় সবই সেকেন্ডারি ম্যাটেরিয়ালের ওপর ভিত্তি করে লেখা। নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকার কিছু ইতিহাস পর্ব বাদ দিলে বাকী সবটাই মাটিতে নেমে করা কাজ। ১৯৭৬ সালের প্রথম সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৩১। আমার হাতে তৃতীয় সংস্করণের যে বইটি আছে তাতে ৬০৮ পৃষ্ঠা- কতোটা পরিবর্ধিত হয়েছে এটাই তার প্রমাণ। ঢাকাকে জানতে হলে আমার প্রথম সুপারিশ হবে কিংবদন্তির ঢাকা পড়া। বইটি থেকে কয়েকটি টুকরো টুকরো বিষয় উপস্থাপন করব:
১. ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েতের সর্দার অর্থাৎ সর্দারদের সর্দার ছিলেন মীর্জা আবদুল কাদের সরদার। নাজির হোসেন লিখেছেন, বাইশ পঞ্চায়েতের প্রধান সর্দার মীর্জা আবদুল কাদের নওয়াব পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে তিনি তাদের বিরাগভাজন হন। যার ফলে ঢাকাবাসী দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় তৎকালীন ঢাকার জনগণের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক এই টানাপোড়েন ঢাকার মুসলমানরা বিশেষ করে সর্দারগণ দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একটি শিবিরের নেতৃত্ব দেন আহসান মঞ্জিলের খাজা পরিবার, অন্যটিতে নেতৃত্ব দেন মীর্জা আবদুল কাদের সর্দার ও মতি সর্দার।
অর্থাৎ মুসলিম লীগ বিরোধী শিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন কাদের সর্দার।
২. লালবাগ রোডের ঋষি পাড়ায় তফসিলি হিন্দুগণ স্যান্ডেল ও জুতো তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। গরীব হলেও তারা বিভিন্ন পূজা-পার্বন ও উৎসবে আনন্দ করতে কোন অংশে কম ছিল না। চৈত্রের মঙ্গ, যাত্রাগান, কীর্তন ইত্যাদিতে মশগুল থাকত। এখানে আদু ঋষি নামে এক ঢোলক ছিলেন যে নবাব বাড়ির বিবিগণের গানের আসরে ঢোল বাজিয়ে বেশ বকশিস প্রাপ্ত হতো। ফলে ঋষি পাড়ার মধ্যে প্রথম তার বাড়িটিই পাকা হয়েছিল।
৩. নগরজীবনের ব্যবস্থাপনার ইতিহাসও তিনি তুলে ধরেছেন-- '১৮২৪ সালের দিকে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন মিঃ এলিয়ট। ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা ও চৌর্যবৃত্তি হ্রাসের উদ্দেশ্যে তিনি শহরে চৌকিদারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তখন ঢাকায় গৃহসংখ্যা ছিল একুশ হাজার। গৃহপ্রতি দুই আনা কর ধার্য করে চৌকিদারি ব্যবস্থা সুচারুরূপে পরিচালনা করেন। ফলে শহরে চুরি ডাকাতি অনেকাংশে হ্রাস পায়।