ট্রাকের কেবিন থেকে তরুণীর মরদেহ তিস্তা নদীতে
করোনাভাইরাস মাহমারিতে নির্মম নিষ্ঠুরতার নতুন নজির তৈরি করা হলো এক গার্মেন্টস কর্মী তরুণীর মরদেহের সঙ্গে। রংপুরে ট্রাকের কেবিনে ১৬ ঘণ্টা থাকার পর ময়নাতদন্ত হয়ে দুইদিন তিস্তা নদীতে ভেসে পুলিশের সহযোগিতায় হয়েছে দাফন।
করোনা এবং ধর্ষণ সন্দেহে লালমনিরহাটের বুড়িমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের হুমকিতে হাসপাতাল থেকে মরদেহ বাড়ি নিয়ে যেতে পারেনি ওই তরুণীর পরিবার। নিষ্ঠুর ওই ঘটনায় ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন।
পুলিশ, পরিবার এবং ট্রাক চালক ও হেলপার সূত্র মতে, গত ২১ মে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটায় টঙ্গীর হারিকেন এলাকা থেকে মাহমুদা আক্তার মৌসুমী নামের গার্মেন্টস কর্মীকে লালমনিরহাটের বুড়িমারীর শফিকুল ইসলাম নামের এক ড্রাইভার এর ফোন কলে ট্রাকের কেবিনে উঠায় চালক আজিজুলও হেলপার রতন।
এরপর তাকে নিয়ে ঢাকায় গাউছিয়া হয়ে মুন্সীর পাম্পে গিয়ে ট্রাকে গরুর মশারি ভর্তি করে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহপুরে এসে ওই ট্রাকে ওঠে আজিজুলের ভাতিজা বদি মিয়া। এরপর চান্দুরা এলাকা পার হওয়ার পর ভাতিজা বদি জানায়, মেয়েটি মারা গেছে। তারপর ২২ মে শুক্রবার সকাল সাতটায় রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে এসে ট্রাকটি দাঁড় করান ড্রাইভার। এরই মধ্যে লাশটির সঙ্গে শুরু হয় নজীরবিহীন নিষ্ঠুরতা।
মেয়েটির পৈত্রিক নিবাস লালমনিরহাটের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিশাত ও ফোন করে তুলে দেওয়া অপর চালক শফিকুল এবং ট্রাকটির চালক আজিজুল, হেলপার রতন ও বদি মিয়া বিষয়টি পুলিশকে অবহিত না করেই বুড়িমারীতে মেয়েটির পিতা মোস্তফার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেন।
ট্রাক চালক আজিজুল ইসলাম জানান, তরুণীর পিতা মোস্তফা রংপুরে এসে মেয়েকে দেখে জানান, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। লাশ না নিয়েই তিনি পাটগ্রামে ফিরে যায়। পরে বিষয়টি সন্ধ্যায় পুলিশ জানার পর থেকেই সেখানে পুলিশের পাহারা বসানো হয় এবং ড্রাইভার ও হেলপারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ।
এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতায় ট্রাক থেকে গরুর মশারিগুলো নামিয়ে নেওয়ার জন্য রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের খান বেডিংয়ের মালিক আরেকটি ট্রাক আনেন। রাত সাড়ে ১০টায় সেখানে সাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে মাল আনলোড করার জন্য আনা একটি কাভার্ড ভ্যান দ্রুত গতিতে সটকে যায়।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানার ওসি রোকন উদ দৌলা জানান, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি তরুণীর পিতা লাশটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় ২২ মে সন্ধায় খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। আমরা সেখানে পাহারা বসাই। লাশ পোস্ট মোর্টেমের জন্য রাত পৌঁনে ১২টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের মর্গে পাঠাই। পরের দিন ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি তার পিতা মোস্তফার হাতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা হস্তান্তর করি। একইসঙ্গে মেয়েটির নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠাই।
এরপরের গল্প আরও নিষ্ঠুর। ১৬ ঘণ্টা কেবিনে থাকার পর ময়নাতদন্ত হলেও লাশ হস্তান্তরের পর যে ঘটনা ঘটেছে, তা অমানবিকতার সকল দৃষ্টান্তকে বদলে দিয়েছে! হাসপাতাল থেকে লাশ বুঝে নিয়ে বিপাকে পড়েন পিতা মোস্তফা।স্থানীয় বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিশাত লাশ বাড়িতে আনতে বারণ করে অন্যত্র দাফনের নির্দেশ দেন।
বাড়িতে আনলে তাকে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেন। কী করবেন, তরুণীর বাবা বুঝে উঠতে না পারায় চেয়ারম্যানই তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দিয়ে ৫ হাজার টাকা দিতে বলেন। অ্যাম্বুলেন্স চালককে বলে হয় আনজুমানে মফিদুল ইসলামে লাশটি দিয়ে আসতে। এরপর মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে অসহায় পিতা চলে যান বাড়িতে। আর নিষ্ঠুর অ্যাম্বুলেন্স চালক লাশটি আনজুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে না দিয়ে গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর পার্শ্বে তিস্তা নদীতে ফেলে দেয়।
২৪ মে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিশখোচা ইউনিয়নের চরগোবর ঘাট চরে স্থানীয়রা সাদা কাফনে একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখেন। খবর দেওয়া হয় পুলিশ।
আদিতমারী থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে সন্ধার আগে আগে যাই চরগোবরার চরে। গিয়ে দেখতে পাই বাংলাদেশ পুলিশ লেখা একটি কাফনের কাপড়ে মোড়ানো এক তরুণীর মরদেহ। খুলে দেখতে পাই, ময়না তদন্ত করা।
নিয়মানুযায়ী মরদেহটি দাফন হওয়ার কথা। কিন্তু নদীতে কেন? বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই এসপিকে জানানো হয়। রাতেই খুঁজে বের করা হয়, বুড়িমারির আমবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমীর পিতা মোস্তফাকে। তাকে থানায় নিয়ে এসে মরদেহ সনাক্ত করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, স্থানীয় চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজ নিশাত হুমকি দিয়েছিল লাশ বাড়িতে না নেওয়ার জন্য।
মোস্তফা বলেন, 'চেয়ারম্যান বলেছেন, তোমার মেয়ের করোনা আছে, নয় তাকে ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে। তাকে গ্রামে দাফন করা যাবে না। আনজুমানে মফিজুল ইসলামে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে লাশ দিয়ে বাড়ি আসো।'
ওসি বলেন, 'এসব কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন ওই অসহায় পিতা। এরই মধ্যে আমরা রিপোর্ট পাই, তরুণীর করোনা নেগেটিভ এসেছে। বিষয়টি এসপিসহ জেলা প্রশাসনকে জানানো হলে পাটগ্রামের ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসিসহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নিজ বাড়িতে লাশ দাফন করা হয়।'
তিনি জানান, চেয়ারম্যান সব সময় মোবাইলে কথা বলতেন মোস্তফার সঙ্গে। সব নম্বর ট্র্যাকিং করা শুরু হয়েছে।
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা মর্মন্তুদ এই ঘটনার বর্ণা দিয়ে বলেন, 'আদিতমারীর ওসি আমাকে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মাথায় আসে রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে ট্রাকের কেবিনে থাকা তরুণীর মরদেহের বিষয়টি। সঙ্গে সঙ্গে আমি রংপুর মেটোপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাটগ্রাম থানার ওসিকে নির্দেশ দেই খোঁজ নিতে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানান, মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তর করা হলেও সেটি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়নি।পরে আমরা লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।'
তিনি জানান, 'পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষায় মেয়েটির করোনার রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। বাকি থাকল ধর্ষণের ঘটনা। পুরো ঘটনাতেই ঘুরে ফিরে আসছে স্থানীয় চেয়ারম্যান নিশাতের নাম। তিনিই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে বাঁধা দিয়েছিলেন। সে কারণে অসহায় ছিল পরিবার। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার হবে।'
এদিকে, প্রশাসন নড়ে-চড়ে বসায় ঘটনার গল্প পরম্পরা থেকে নিজেকে বাঁচাতে উঠে-পড়ে লেগেছেন ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত। তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। স্থানীয় এই আওয়ামী লীগ নেতা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুরো ঘটনাই তিনি ওই তরুণীর পরিবারের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
নির্মম এ ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন। যে ট্রাকের কেবিনে ছিল লাশ, সেটির গায়ে খাদ্য পরিবহনের কথা লেখা থাকলে বহন করা হচ্ছিল গরুর মশারি।