যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা: দুই বেডের ফ্ল্যাটে থাকছে ২০ জন!
নাজমুশ শাহাদাত যখন শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে যান, তখন থাকার জন্য তিনি কোনো জায়গায়ই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যুক্তরাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত আইনে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তবে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সুবিধা এতই ব্যয়বহুল ছিল যে, শাহাদাত চাইলেও সেখানে থাকার সুযোগ হয়নি। খবর বিবিসির।
বহু স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে গিয়েছিলেন শাহাদাত। কিন্তু খুব শীঘ্রই যেন কঠিন সব বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। অবশেষে দুই বেডের একটি ফ্লাটে ২০ জনের সাথে থাকা শুরু করেন তিনি।
দুর্বিষহ সেই দিনের কথা স্মরণ করতে যেয়ে শাহাদাত বলেন, "আমি এমন পরিবেশে থাকবো, সেটা কখনো ভাবিনি। আমি এখনও সেইসব স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছি।"
অল্প একটু জায়গায় এত বেশি মানুষ থাকায় ফ্ল্যাটটিতে ঘুমানোর মতো পরিবেশও ছিল না। সেখানে প্রায় সব জায়গায়ই বাঙ্ক বেড ছিল এবং প্রতিনিয়ত মানুষজন আসা যাওয়া করতো।
নিজের অবস্থা বোঝাতে শাহাদাত বলেন, "প্রথম কয়েক মাস আমি পরিবারের সাথে ভিডিও কলে কথাও বলতাম না। কেননা আমি তাদেরকে দেখাতে চাইতাম না যে আমি ঠিক কোন পরিবেশে আছি। এটা আমার জন্য বেশ কষ্টের ছিল।"
সেই অবস্থা কাটিয়ে বর্তমানে শাহাদাত বন্ধুর সাথে মিলে একটি ফ্ল্যাট নিয়েছেন। সেখানে নিজের আলাদা রুমও রয়েছে তার।
তবে শুধু শাহদাতই নয়, বরং লন্ডনে বাইরে থেকে পড়তে আসা প্রায় শিক্ষার্থীদের জন্যই সাধ্যের মধ্যে ভালোভাবে বসবাসের জন্য একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। কেননা তাদের কাছে খুব সহজেই রেফারেন্স কিংবা পে স্লিপ থাকে না, যা বাড়ি ভাড়ার জন্য সেখানে চাওয়া হয়।
অনেক শিক্ষার্থীরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি পরিশোধের জন্য পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আনতে হয়। কেননা ক্ষেত্রবিশেষে তিন বছরের কোর্সে প্রায় ৩৯ হাজার পাউন্ডের মতো খরচ হয়ে যায়।
এ সম্পর্কে শাহাদাত বলেন, "আমি লন্ডনে এসেছিলাম আমার এবং বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। সেক্ষেত্রে আমার পরিবারের জমানো অর্থ খরচ করতে হয়েছে।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেন সরকার দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। হায়ার এডুকেশন স্ট্যাটিসটিক্স এজেন্সির তথ্যমতে, ২০১৫/১৬ শিক্ষাবর্ষে দেশটির রাজধানীতে ১,১৩,০১৫ জন বিদেশী শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু ২০২০/২১ শিক্ষাবর্ষে সেটি ৫৯ ভাগ বেড়ে পৌঁছায় ১,৭৯,৪২৫ জনে।
রাশাভ কৌশিক নামের এক ভারতীয় চলতি বছরে আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডনে গিয়েছেন। সেখানে তিনি থাকার জন্য বন্ধুদের সাথে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। তবে সেখানে তাকে এক বন্ধুর সাথে বেডরুম শেয়ার করে থাকতে হচ্ছে।
নিজের জন্য আলাদা একটি বেডরুম না পেলেও বাসা ভাড়া বাবদ কৌশিকদের খরচ করতে হয়েছে অগ্রীম ১৬ হাজার পাউন্ড, যা শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল। একইসাথে তাদেরকে একজন গ্যারান্টর দিতে হয়েছে।
ন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর স্টুডেন্টস (এনইউএস) এর নেহাল বাজওয়া বলেন, "যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি করে বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তির চেষ্টা করছে। কেননা এইসব শিক্ষার্থীরা বেশ মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে থাকেন। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি এর পরিমাণ এতই বেশি যে, তার প্রভাব দেখা দিচ্ছে হাউজিং খাতেও।"
এনইউএসের পক্ষ থেকে লন্ডনে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসাথে বিদেশী শিক্ষার্থীরা যে আর্থিক চাপের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, সেটি বিবেচনা করার দাবি জানিয়েছেন।
এ সম্পর্কে বাজওয়া বলেন, "শিক্ষার্থীরা এখানে খুব সহজেই শোষিত হচ্ছে। কেননা তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানে না।"
বাজওয়া জানান, বিদেশী শিক্ষার্থীদের চুক্তি ছাড়াই বাড়ি ভাড়া নিতে হয়, অনেক বেশি পরিমাণে অর্থ খরচ করতে হয় এবং শিক্ষার্থীবান্ধব নয় এমন শর্তও পূরণ করতে হয়।
বাজওয়া বলেন, "এতসব প্রতিবন্ধকতা মেনেই আপনাকে বাড়ি ভাড়া নিতে হবে। নাহলে আপনি থাকবেন কোথায়? এইখানে থাকার জায়গা নিশ্চিত করতে না পারার ঝুঁকি অনেক বেশি।"
১৯ বছর বয়সী ইতালিয়ান জিউলিয়া টর্টোরিসি লন্ডনে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। দুই বান্ধবী মাইসি ও লিডিয়ার সাথে তিনি একটি বাসা ভাড়া করে থাকছেন। গত বছর থাকার জন্য বাড়ি ভাড়া করতে যেয়ে বেশ ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।
এ সম্পর্কে জিউলিয়া টর্টোরিসি বলেন, "লন্ডনে বাড়ি ভাড়া খুবই ব্যয়বহুল। গতবছর আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন আমার থাকার মতো জায়গাই ছিল না। আমার এক বন্ধু তার রুমে থাকার জায়গা দিয়েছিল। এক মাস এখানে থেকে আমি বহু কষ্টে থাকার জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম। এটা আমার জন্য বেশ চাপের ছিল।"
যুক্তরাজ্যে যে শুধু বিদেশী শিক্ষার্থীরাই যে আবাসন সংকটে কষ্ট করছে এমনটি নয়। বরং পাশাপাশি দেশটির স্থানীয় শিক্ষার্থীরাও থাকার জন্য বাড়ি খুঁজে পেতে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয় তাদের।
স্যাভিলিসের বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায়, লন্ডনে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য তৈরি করা ভবনগুলোতে প্রতিটি বেডের জন্য ৩.৮ জন শিক্ষার্থীর চাহিদা রয়েছে। পুরো যুক্তরাজ্যে অবশ্য এই পরিমাণ একটু কম, প্রতি বেডের জন্য ২.৯ জন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের জন্য চ্যারিটি সংগঠন ইউনিপোল মনে করে, দেশটিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আর সাশ্রয়ী মূল্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য এটা খুবই জরুরী যে, তারা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই আবাসন সংকট দূর করতে পারে। কেননা এদের মধ্যে অনেকেই বিদেশী শিক্ষার্থী কিংবা অনেকেই ক্যাম্পাসের বাইরের এলাকা ভালোভাবে চেনে না।
ইউনিপোলের সিইও মার্টিন ব্লেকি বলেন, "একটি রুমের ব্যবস্থা না করে যদি অস্থায়ীভাবে বসবাস করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩৫ ভাগ বেশি ভাড়া গুণতে হয়। তবে রুমের ব্যবস্থা করা সহজ ব্যাপার নয়। তাই কিছু শিক্ষার্থী মনে করে, আপাতত তারা অস্থায়ীভাবেই থাকুক। পরবর্তীতে যখন শেয়ারে বাসা পাওয়া যাবে তখন তারা অর্থ বাঁচাতে পারবে।"
এদিকে সাশ্রয়ীভাবে বসবাসের জন্য বাসা খুঁজে পাওয়ার আগেই অনেক শিক্ষার্থী নিজের ফান্ডে থাকা অর্থ খরচ করে ফেলে। তখন পড়াশোনা বন্ধ করে নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া হয়তো আর উপায় থাকে না।
এ সম্পর্কে মার্টিন ব্লেকি বলেন, "একজন শিক্ষার্থীর জন্য এমন পরিণাম সত্যিই খুব কষ্টকর। বহু স্বপ্ন এভাবেই ঝড়ে যায়।"
আবাসন সংকট সম্পর্কে এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের শিক্ষা বিভাগের এক মুখপাত্র বলেন, "বিদেশী মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে আমাদের দেশে পড়াশোনার জন্য আগ্রহী করা তোলা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের জন্যই ভালো। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তিগতভাবে আবাসন নিয়ে কাজ করা সকলের কাছে অনুরোধ, তারা যেন শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে তাদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করে।"
ইউনিভার্সিটি ইউকে এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, "আবাসন খাতে বিদ্যমান বর্তমান সংকট সমাজের প্রতিটি স্তরেই অনুভূত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও তার বাইরে নয়। এই সমস্যা যথাসম্ভব সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথাসম্ভব চেষ্টা করছে।"
বিবৃতিতে বলা হয়, "বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এছাড়াও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে আসার আগে আবাসন নিশ্চিত করতে আমরা শিক্ষার্থীদের বলে থাকি। তবুও কোনো শিক্ষার্থী যদি থাকার জায়গা খুঁজে পেতে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়, তবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংক্রান্ত যে টিম রয়েছে তাদের সাথে শীঘ্রই যোগাযোগের জন্য বলছি।"