রাশিয়ার সহযোগীদের গুপ্তহত্যা করছে ইউক্রেন
এক মাস ধরে অপারেশনের প্রস্তুতি চলেছে। খারকিভের ভেলেকি বরলোক শহরের মেয়র ইয়েভহেন ইয়ুনাকভ রাশিয়ার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। বিশেষ বাহিনীর 'ককেশাস' নামক এক কমান্ডার ও স্থানীয় একদল অফিসারকে অপারেশনটির দায়িত্ব দেওয়া হলো।
টানা কয়েকদিন ধরে তারা ইয়ুনাকভের ওপর নজর রাখতে শুরু করলেন — ইয়ুনাকভ কখন জিনিসপত্র কেনেন, কখন-কোথায় যান, তার নিরাপত্তা কতটুকু শক্তিশালী। তারপর একদিন দূর থেকে ককেশাসের দলটি ইয়ুনাকভকে লক্ষ্য করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেন।
ঘটনার পরপরই অপারেশন পরিচালনাকারীরা আত্মগোপনে চলে যান। সপ্তাহখানেক পরে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে তাদের আবার দেখা যায়। তবে মেয়রের মৃতদেহ কখনো পাওয়া যায়নি।
গত ১৮ মাসের যুদ্ধে রাশিয়ার দখলিকৃত ইউক্রেন এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইয়ুনাকভের মতো কয়েক ডজন মানুষকে এ ধরনের অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। গুলি, বিস্ফোরণ, ফাঁসি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিষপান ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
ইউক্রেন অবশ্য এ ধরনের গুপ্তহত্যা নিয়ে টুঁ শব্দটিও করছে না। কিন্তু দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর এসব অপারেশন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
'যারা ইউক্রেনের সঙ্গে নেমকহারামি করবে, ইউক্রেনীয়দের দিকে গুলি বা মিসাইল ছুড়বে, তাদের বোঝা উচিত যে, তারা সবসময়ে নজরদারিতে আছে, এবং বিচারের মুখোমুখি হবে,' বলেছেন ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এইচইউআর-এর একজন কর্মকর্তা আন্দ্রি চেরনিয়াক।
গত জুলাইয়ে চেরনিয়াকের বস জেনারেল কিরিলো বুদানভ কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন: 'আপনার যদি মোসাদের (একটি সংস্করণ তৈরির) ব্যাপারে জানতে চান… আমাদের তার দরকার নেই। ওটা আমাদের ইতোমধ্যে আছেই।'
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের উল্লেখ এটাই বোঝায় যে, ইউক্রেন বিচারের জন্য মরিয়া হয়ে আছে। আদতে রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার সূচনা ইউক্রেনের ঘরের কাছেই হয়েছিল। মোসাদ এর অনেক কার্যক্রম শিখেছে সোভিয়েত যুগের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে।
আধুনিক ইউক্রেনে গুপ্তহত্যার ইতিহাসের শুরুটা ২০১৫ সাল থেকে। ওই বছর রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউ পঞ্চম একটি শাখা তৈরি করে। ওই শাখাটি রাশিয়ার আক্রমণের জবাব হিসেবে বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যক্রম চালানে শুরু করে।
এসবিইউ'র তৎকালীন প্রধান ছিলেন ভ্যালেন্টিন নালিভায়শেঙ্কো। তিনি বলেন, ওই সময়ের ইউক্রেনীয় নেতারা ঠিক করেছিলেন, শত্রুপক্ষের সহযোগীদের কেবল কারাবন্দি করাই যথেষ্ট নয়। 'আমরা অনিচ্ছুকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম, শত্রর সহযোগীদের নিকেশ করতে হবে,' ভ্যালেন্টিন বলেন। এসবিইউ'র উপশাখাটির একজন সাবেক কর্মকর্তাও একই কথা জানিয়েছেন।
২০১৫ ও ২০১৬ সালে এসবিইউ'র নতুন এ দপ্তরটি দনবাসে রাশিয়ার মদতপুষ্ট অনেক কমান্ডারের গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। মিখাইল তলস্তিখকে মারা হয় রকেট হামলা চালিয়ে। আর্সেন পাভলভ খুন হন লিফটে বিস্ফোরণের মাধ্যমে। আলেকজান্ডার জাকারশেঙ্কোকে একটি রেস্তোরাঁর ভেতর উড়িয়ে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, এসবিইউ'র এ পঞ্চম শাখাটি চলমান যুদ্ধে রাশিয়ান অপারেশনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখছে। সামরিক গোয়েন্দা এইচইউআর-এর চেয়ে এটির আকার ও বাজেট দুটোই প্রায় পাঁচগুণ বেশি।
ধারণা করা হয়, সবচেয়ে বিতর্কিত অপারেশনগুলোর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টই নির্দেশনা দেন। তবে অন্য সিদ্ধান্তগুলো অন্য কর্মকর্তারাই নেন। দেশটির সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন এসব অপারেশনের কারণে বেসামরিক নাগরিকদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
এসবিইউ'র পঞ্চম শাখার সাবেক ওই কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়ার অভ্যন্তরে গুপ্তহত্যার অপারেশনসমূহ কেবল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে খুশি করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এসব অপারেশন ইউক্রেনের বিজয়ে কোনো সহায়তা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, রাশিয়ার সরকারের আশপাশে অনেক ভাঁড়, জোকার রয়েছে। তাদের একজনকে মারলে ওই জায়গায় নতুন আরেকজনকে দেখা যাবে।
সাবেক এ স্পাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, ইউক্রেনের এ গুপ্তহত্যা যু্ক্তির বদলে আবেগ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। কিছু হত্যা করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধের মূল্য ও সাধারণ ইউক্রেনীয়দের উদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য। 'কেবল পারে বলেই আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে সব কাজ করা উচিত নয়,' তিনি বলেন।
ইউক্রেনের একজন গোয়েন্দা মুখপাত্র আন্দ্রি ইয়ুসভ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন কোনো 'অন্ধ ত্রাস' তৈরি করছে না। তাদের এ ধরনের গুপ্ত অপারেশনের লক্ষ্য 'শত্রুকে ভয় পাইয়ে দেওয়া নয়', বরং 'তাদেরকে দখলিকৃত ইউক্রেনীয় ভূমি থেকে বের করে দেওয়া'।