অঘোষিত ৩টি যুদ্ধে লড়ছে রাশিয়া

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সপ্তম মাসে পড়েছে; কিন্তু এখনো কোনো সমাধানের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না।
দু'পক্ষই নিজেদের শক্তিমত্তার জায়গা থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া এর যুদ্ধক্ষমতা ব্যবহার করে এগিয়ে থাকতে চাইছে, অন্যদিকে ইউক্রেন চেষ্টা করছে রাশিয়ার সাপ্লাই লাইন ভেঙে দিতে।
কিন্তু এটা কেবল দৃশ্যপটের একটি অংশ। পুতিন আসলে তিনটি যুদ্ধ পরিচালনা করছেন, কিন্তু তিনটিই অঘোষিত। তিনি একই সঙ্গে চাচ্ছেন ইউক্রেন দখল করতে, রাশিয়ার আঞ্চলিক ক্ষমতা ধরে রাখতে, এবং পশ্চিমের পতন ত্বরান্বিত করতে। আর এসবের মাঝে কি একটি অভ্যন্তরীণ সংঘাতও উঁকি দিচ্ছে?
রাশিয়ার বিস্তার
রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযান' মূলত অঘোষিত এক যুদ্ধ যেখানে পুতিন রাশিয়ান সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে চাইছেন। পুতিন এটিকে হচ্ছে 'তাদের ভূমি' ফিরিয়ে নেওয়া বলে অভিহিত করেছেন।
রাশিয়ার এ যুদ্ধের লক্ষ্যকে মূল্যায়ন করার ভিত্তিতে বলা যায় দেশটির সাফল্য মিশ্র। তবে ইউক্রেনকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সফল হয়েছে রাশিয়া। এ যুদ্ধে ইউক্রেনের অবকাঠামোগত যা ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দেশটির কয়েক দশক সময় লেগে যাবে।
কিন্তু এ যুদ্ধে রাশিয়া যে পরিমাণ সৈন্য হারিয়েছে, তার বিনিময়ে গত ছয়মাসে অতি অল্পই অর্জন করতে পেরেছে দেশটি। এ যাত্রায় পুতিন রাশিয়ার সক্ষমতা নিয়ে বড়াই করেছেন, মানবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, এবং তার সশস্ত্র বাহিনীর দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ও শৃঙ্খলার অভাবকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন।
আঞ্চলিক প্রাধান্যের সংগ্রাম
পুতিনের দ্বিতীয় অঘোষিত যুদ্ধটির লক্ষ্য হচ্ছে মধ্য এশিয়া থেকে মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রভাব দৃঢ় করা।
এটা অবশ্যই এক ধরনের যুদ্ধ: আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া'র অঞ্চল নিয়ে বিতর্কে ২০১৮ সালে রাশিয়া পাঁচ দিনের মধ্যে জর্জিয়া'র সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। নিরপেক্ষ অবস্থান ত্যাগ করলে মলডোভা'র ওপর আক্রমণ চালানোর হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। কাজাখস্তান, এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সশস্ত্র হস্তক্ষেপও করেছিল দেশটি।
আঞ্চলিক প্রাধান্য নিয়ে সংগ্রামে নিদারুণভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছেন পুতিন। চীনের কাছে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব হারানো ইতোমধ্যে স্বীকৃত। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখিয়ে দিলো ক্রেমলিনের প্রভাব আদতে কতদূর পর্যন্ত কমে গিয়েছে।
কাজাখস্তান ইউক্রেনকে সাহায্য পাঠিয়েছে। মলডোভা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দিতে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বেলারুশ বাদে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের রেজল্যুশনে রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে সৈন্য সরাতে ভোট দিয়েছে বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
ইউক্রেনের 'অ্যান্টি-রাশিয়া' হওয়া ঠ্যাকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন পুতিন।
পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধ
পুতিনের তৃতীয় অঘোষিত যুদ্ধটি সবচেয়ে অস্পষ্ট। এটিকে তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়।
- ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সমাজকে অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত করার রাজনৈতিক যুদ্ধ;
- কৌশলগত উদ্দেশ্যের স্বার্থে অন্যের নির্ভরশীলতাকে নিজের হাতিয়ার বানানো;
- এবং বিশ্বের যে অঞ্চলে পশ্চিমাদের নাগাল দুর্বল, সেখানে তাদের প্রভাবকে আরও কমিয়ে ফেলা।
রাশিয়াকে ইউরেশীয় তৃতীয় রোম বানানোর পুতিনের যে ভিশন রয়েছে, সেজন্য পশ্চিমাদের সঙ্গে তার এ অঘোষিত যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের দ্বিতীয় শাসনামলে ইউরোপ পুতিন প্রভাবশালী ছিলেন। আর এটি বিশ্বের সামনে পশ্চিমা সমাজের ভাঙনকে প্রকাশ করেছে, যে ভাঙন সারানো এখন তাদের জন্য জরুরি একটি কাজ।
তবে পশ্চিমাবিশ্বকেও রাশিয়াকে বৈশ্বিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হিসেবে দেখার দৃষ্টি পরিবর্তন করতে হবে। কারণ বর্তমান ইউক্রেন আক্রমণের জন্য ন্যাটোকে নিয়ে রাশিয়ার ছড়ানো 'ভুল বার্তা'র বিষয়ে বিশ্বের অনেক দেশ এখনো ক্রেমলিনের প্রতি সহানুভূতিশীল।
বিশ্বে পশ্চিমাশক্তির ভবিষ্যৎ বিশ্বাসযোগ্যতাও নির্ভর করবে এটি কত ভালোভাবে ঘরের ভেতর ও বাইরে রাশিয়ার চাপ সামলাতে পারে। একইসঙ্গে এটিকে ভারত, আফ্রিকা, ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে প্রচলিত রাশিয়ার বর্তমান মিথ্যা বয়ানের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হবে।
অভ্যন্তরে অঘোষিত যুদ্ধ
আলেক্সান্ডার দুগিনের মেয়ে দারিয়া দুগিনার গাড়িবোমা হামলায় নিহত হওয়ার ঘটনা রাশিয়ার চরম ডানপন্থীদের তীব্রভাবে উত্তেজিত করে তুলেছে।
এ বোমা হামলার মাধ্যমে ফেব্রুয়ারির পর এ প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে আদর্শিক ভাঙ্গনের কথা বাইরে এল।
দুগিনা আর দুগিনা দুজনেই রাশিয়ার রাজনীতিতে ছোটখাটো খেলোয়াড়। কিন্তু একজন অত্যাধিক-জাতীয়তাবাদীকে লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা রাশিয়ায় বিরল ঘটনা যেখানে গুপ্তহত্যা, বিষপানে হত্যা, বা 'দুর্ঘটনাবশত' মৃত্যু কেবল মধ্যপন্থীদেরই জোটে।
তবে এ হামলার ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারী আজভ রেজিমেন্টের সদস্য নাটালিয়া ভভক বলে দাবি করেছে এফএসবি। হামলার পর নাটালিয়া এস্তোনিয়া পালিয়ে গেছে বলেও জানায় সংস্থাটি।
এক্ষেত্রে শাঁখের করাতের পরিস্থিতিতে পড়েছে রাশিয়া। যদি হামলাকারীরা সত্যিই নাটালিয়া হয়, তাহলে সেটা রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যর্থতা। তবে কি সীমান্তে এত কড়াকড়ি সব লোক দেখানো?
অন্যদিকে এফএসবি যদি নিজেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তাহলে সেটা কি সংস্থার ভেতরে পুতিনবিরোধী কোনো অংশের কাজ? নাকি যুদ্ধের ঝিমিয়ে পড়া সমর্থনকে জাগ্রত করতে পুতিনের নির্দেশেই এ হামলা করা হয়েছে?
উত্তর যদি প্রথমটি হয়, তাহলে রাশিয়ার এলিটদের মধ্যে গভীর ফাটল ধরেছে। দ্বিতীয়টি হলে, পুতিন নিজেই আলট্রা-রাইটদের লক্ষ্যবস্তু করেছেন, কারণ এরা ইউক্রেনের ওপর আরও কঠোর না হওয়ার জন্য পুতিনের সমালোচনা করেছিল।
তবে অতি অল্প পর্যবেক্ষক মনে করছেন এ হত্যার দায় স্বীকার করা ন্যাশনাল রিপাবলিকান আর্মিই ঘটনার মূলহোতা। যদি এমনটা সত্যি হয়, তার মানে হচ্ছে রাশিয়ার ভেতর সংগঠিত সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয়েছে।
তবে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, দারিয়া দুগিনার হত্যা পুতিনের নেতৃত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে। আর এ ধরনের কিছুই পুতিন সবসময় সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তবে কি তিনটি অঘোষিত যুদ্ধ পুতিনের জন্য যথেষ্ট নয়? তিনি কি আরেকটি, ব্যক্তিগতভাবে আরও বিপদজনক একটি যুদ্ধের আগুন জ্বালালেন শেষ পর্যন্ত?
এশিয়া টাইমস থেকে সংক্ষেপে অনূদিত