পুতিন যেভাবে লৌহযবনিকার নতুন মানচিত্র আঁকছেন
যুদ্ধ– ইতিহাসের উন্মুক্ত পাতার মতো। বিদ্বেষ আর হিংসার চরমতম সময়েই প্রকাশ পায় বিয়োগান্তক সব পরিণতি। ট্র্যাজেডির এমনই আরেক অধ্যায় ভৌগলিক অবস্থান। হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূরাজনীতি কত শত জনপদ গড়েছে; নাহয় মিশিয়ে দিয়েছে ধুলার সাথে।
বর্তমান বিশ্বে সংঘাতে জড়িত রাষ্ট্রগুলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বহুবার– কীভাবে ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য সংঘাতের সূচনা করে। লড়াই কোন কৌশলে হবে অথবা তার পরিণতি কতোটা মারাত্মক হবে–তাও প্রভাবিত করে ভূগোল।
এমন ভূরি ভূরি উদাহরণের পাতায় নতুনতম সংযোজন ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ।
রাশিয়া ও বাকি ইউরোপের মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কার্পেথিয়ান পর্বতমালা। ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম এ পর্বতশ্রেণি দক্ষিণ পোল্যান্ড থেকে মাথা তুলতে শুরু করেছে। এরপর দক্ষিণে বাঁক নিয়ে রোমানিয়ায় গিয়ে ধীরে ধীরে সমতলে রূপ নিয়েছে। তারপরই বিস্তীর্ণ সমভূমির বিস্তার কৃষ্ণসাগর অবধি।
অতীতে যতবার কোনো বিদেশি শত্রু বাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করতে এসেছে, তাদের সামনে বাধা হিসেবে পেয়েছে কার্পেথিয়ানকে। ফলে সহজে চলাচলের জন্য তাদের এগোতে হয়েছে পর্বতের বাধাকে এড়িয়ে– কখনো উত্তরদিকে, কখনোবা দক্ষিণ দিক দিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা উত্তরের পথ নেয়।
উত্তরের সমতল পথ পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। ফ্রান্স থেকে শুরু হয়ে উত্তর ইউরোপীয় সমভূমির এই অংশটি সবচেয়ে সংকীর্ণ হয়েছে পোল্যান্ডে এসে। তবে কোনো আগ্রাসী বাহিনী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়– পোল্যান্ড পেরোনোর পরই তাদের সামনে পেয়েছে রাশিয়ার সীমানাজুড়ে প্রসারিত উন্মুক্ত প্রান্তরকে।
এই দিক থেকেই বেশ কয়েকবার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে রাশিয়া। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– ১৮১২ সনে নেপোলিয়নের এবং ১৯৪১ সনে হিটলারের অভিযান। পোল্যান্ড দখলের মাধ্যমে বার বার এই পথকে শত্রুর আওতার বাইরে রাখতে চেয়েছে রাশিয়া। সর্বশেষ এই নিয়ন্ত্রণ তাদের ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে।
কিন্তু, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির ওপর তখন নিয়ন্ত্রণ হারায় ক্রেমলিন।
সম্মুখভাগের পোল্যান্ড হাতছাড়া হওয়ায়– ঠিক এর পরেই অবস্থিত বেলারুশ ও ইউক্রেনকে নিজ প্রভাববলয়ে রাখার ওপর জোর দেয় মস্কো। মূলত এই দেশ দুটিকে আগ্রাসন ঠেকানোর বাফার জোন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
তা ছাড়া, রাশিয়ার দরকার উষ্ণজলের বন্দর। রাশিয়ার উত্তর দিকের বন্দরগুলি মেরু বলয়ের তীব্র ঠান্ডায় সামুদ্রিক জমাট বরফের কবলে থাকে বছরের অধিকাংশ সময়। ফলে রুশ নৌবাহিনীকে বাল্টিক সাগর থেকে বেরিয়ে উত্তর সাগরে যাওয়ার পথে পাড়ি দিতে হয় সংকীর্ণ স্কাগেরার্ক প্রণালী।
ফলে সহজেই ন্যাটো রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে।
এই ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক দুর্বলতাগুলিকে তুলে ধরেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিকে তুলে ধরে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে নিজ দেশবাসীর সমর্থন লাভ করেছেন।
আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের কথায় আরেকটু পরে আসা যাক। সাম্প্রতিক ইতিহাসের চর্চা বরং আরেকটু জরুরি। যেমন ইউক্রেন যতই পশ্চিমা বলয়ে ঝুঁকছিল–ততই দিশেহারা হচ্ছিল ক্রেমলিন। তারই পরিণতি ছিল ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়ার দখলে নেওয়ার ঘটনা।
এর মাধ্যমে রাশিয়া কেবল আংশিক একটি বাফার জোন-ই শুধু লাভ করেনি, তার সাথে চিরদিনের জন্য পেয়ে যায় উষ্ণ জলের সেভেস্তোপল বন্দর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ। অবশ্য ক্রিমিয়া দখলের আগে বন্দরটি ইউক্রেনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ব্যবহার করতো রুশ নৌবাহিনী। কিন্তু, কিয়েভ ইইউমুখী হতে থাকায়–ভবিষ্যতে এটি হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
আর ২০২২ সালে এসে পুরো ইউক্রেন দখলে নেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করেছে– এমন ভেবে বসে রাশিয়া।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বেলারুশে আসে রুশ সেনারা। অবস্থান নেয় পোলিশ সীমান্তের কাছে। ফলে পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার মাঝে অবস্থিত "সোয়ালকি গ্যাপ' নামে পরিচিত ৪০ মাইল দৈর্ঘ্যের সমভূমির সীমান্তের কাছে তাদের অবস্থান তৈরি হয়।
এই সীমান্তের এক প্রান্তে অবস্থিত রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত কালিনিনগ্রাদ। সেখানে রয়েছে ১৫ হাজার রুশ সেনা, অন্যপ্রান্তে বেলারুশ। রুশ সেনাদের এই অবস্থান সোয়ালকি গ্যাপ দিয়ে আগ্রাসী সেনার প্রবেশ বন্ধ করতে পারে। কিন্তু তা করা সম্ভব না ন্যাটো সদস্য লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ার ক্ষেত্রে।
উত্তরে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। আর এই সীমান্তগুলি দিয়ে বাল্টিক দেশগুলিতে সামরিক শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে ন্যাটো। স্থলপথে ন্যাটো বাহিনী অগ্রসর হওয়ার এটাই একমাত্র পথ।
বেলারুশে রুশ সেনাদের উপস্থিতির অর্থ– উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ডে প্রবেশের সুযোগ পাবে তারা। দজভিনা ও নিপার নদীর মাঝে 'স্মলেনস্ক গেইট' নামে পরিচিত ৫০ মাইল দীর্ঘ আরেকটি সমভূমি রয়েছে। সাধারণত এখানেই রুশ সেনারা পোল্যান্ডমুখী অবস্থানে থাকতো।
রাশিয়া থেকে অন্য দেশে যাতায়াতকালে রুশ বাহিনী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই স্মলেনস্ক গেইট ব্যবহার করেছে। কিন্তু, এই পথটির পাহারায় থাকা রুশ বাহিনী এখন আরও সামনে এগিয়ে বেলারুশে অবস্থান নেওয়া সুযোগ পেয়েছে। আর তাতেই উদ্বিগ্ন পোল্যান্ডসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্র।
তবে ক্রেমলিন উপলদ্ধি করছে, যুদ্ধকালে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এড়ানো কঠিন। পুতিন ধারণা করেছিলেন, ইউক্রেনে হামলার পর ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তিবাদী ও যুদ্ধংদেহী– এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু, ন্যাটো জোট এতে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ইইউ-ও রুশ বিরোধিতায় এপর্যন্ত ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে।
যুদ্ধের ছড়িয়ে পড়া প্রভাব হয়েছে খুবই নাটকীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে সামরিকায়ন শুরু করেছে জার্মানি। বাতিল করেছে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন সচলের উদ্যোগ। জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যেকার এই বিশাল প্রকল্প বাতিল হওয়ায় ক্ষতি উভয়পক্ষেরই হয়েছে।
রাশিয়ার অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ ছিল হাঙ্গেরি। কিন্তু, ইইউ সদস্যরা ব্রাসেলস বা মস্কো–যেকোনো একপক্ষ বেছে নেওয়ার চাপ দিয়েছে দেশটিকে। চাপের মুখে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানকে ব্রাসেলসের দিকেই ঝুঁকতে হয়েছে।
ভিক্টর ওরবান একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক। রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে তার আগ্রহের কারণও ঐতিহাসিক এবং ভৌগলিক।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য। যুদ্ধের পর পরাজিত সাম্রাজ্যটির বিপুল অঞ্চল বিজয়ী শক্তিগুলো দখল করে নেয়। একেক দেশের ভাগে আসে একেক অঞ্চল।
যেমন ইউক্রেন পায় এর আগে এক হাজার বছর ধরে হাঙ্গেরির নিয়ন্ত্রণে থাকা ট্রান্সকার্পেথিয়া'কে। হাঙ্গেরির সাথে সীমান্ত থাকা এ অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ জাতিগত হাঙ্গেরিয়র বসবাস। মাতৃভাষা চর্চার অধিকার নিয়ে তাদের সাথে অন্য ইউক্রেনীয়দের উত্তেজনা দীর্ঘদিনের।
এই অঞ্চলকে অন্যায্যভাবে কেড়ে নেওয়া নিজ ভূখণ্ড বলেই মনে করে বুদাপেস্ট। যদিও এর ওপর নিজস্ব সার্বভৌমত্ব দাবি করেনি। কিন্তু, ইউক্রেনকে এজন্য সুনজরেও দেখেনি। এই ইতিহাসের পাশাপাশি জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা তো রয়েছেই। তাই প্রতিবেশী ইউক্রেনে যুদ্ধ চললেও হাঙ্গেরি ভারসাম্য রেখেই চলতে চাইছে।
ইউক্রেনকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দানে এপর্যন্ত রাজি হয়নি হাঙ্গেরি। এমনকী নিজ ভূখণ্ডের মধ্যে দিয়ে ইউক্রেনে ন্যাটো অস্ত্রের চালান পাঠাতে দেয়নি। ইউক্রেন দুর্বল হোক তাই চায় হাঙ্গেরি। তাহলে দেশটির পক্ষে ট্রান্সকার্পেথিয়া ও সেখানে বসবাসকারী হাঙ্গেরিয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ভূ-রাজনীতির এ খেলায় একটি বিষয় স্পষ্ট। ইউরোপ জুড়ে আবারো টানা হচ্ছে লৌহ যবনিকার রেখা; যার বিস্তৃতি শুরু হয়েছে বাল্টিক থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত।
তুরস্কও দিন দিন ন্যাটো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে একইসাথে আঙ্কারা জানে, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার আধিপত্য মোকাবিলায় এই জোটে থাকাই তার জন্য বেশি লাভজনক।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নয়া বিভাজনের এই রেখাকে আরও দূরে পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা যায়। ইরানের সীমান্ত থেকে মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলি পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার চীন সাগর পর্যন্ত।
এর একদিকে রয়েছে এশিয়ায় পশ্চিমাদের মিত্র শিল্পোন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহ, যাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টার আমেরিকা। আরেকদিকে, রয়েছে চীন ও ভারতের প্রভাবাধীন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলি। শেষোক্ত দেশগুলি মস্কোর আগ্রাসনের নিন্দা করেছে রয়েসয়ে।
ইউক্রেনে পুতিন যে সংঘাতের আগুন জ্বালিয়েছেন তার শিখা দুনিয়ার সব প্রান্তেই ছড়িয়ে পড়েছে। ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি অন্যান্য খাতও বাদ পড়েনি। রাশিয়া ও ইউক্রেন গমের শীর্ষ উৎপাদক। ২৬টি দেশ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল। বার্ষিক খাদ্য আমদানির অর্ধেকই তারা দেশদুটি থেকে করে। যুদ্ধের কারণে খাদ্যের বিশ্ববাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেয় আর তাতে দামও চড়ে রকেট গতিতে।
একারণেই, সুদূরের রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোয়–মিশর ও ইয়েমেনের শিশুদের অনাহারে থাকতে হচ্ছে। ভূগোলের শক্তি এভাবেই সর্বনাশা ও সর্বব্যাপী।
- সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ