ইউরোপজুড়ে যুদ্ধের আতঙ্ক, ইউক্রেনীয়দের পিঠে কি শেষ পর্যন্ত ছুরি মারা হবে?

ইউক্রেনে পশ্চিমাদের লক্ষ্য রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করে দেশটির জাতীয় সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার এবং 'অন্ধকার এক শক্তি'-র বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের জয় নিশ্চিত করা। গত মার্চে ওয়ারশ'তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অন্তত ইউক্রেন বিষয়ে এমন একটি লক্ষ্যই নির্ধারণ করেন এবং যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থনও পান।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- পশ্চিমারা কি আসলেই এসব কথায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে? ন্যাটো যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়ার আহ্বান ইতোমধ্যে প্রত্যাখান করেছে। অন্যদিকে, আসন্ন শীতে ইউরোপীয়রাও ইউক্রেনকে পেছন থেকে ছুরি মেরে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কি না- সেই প্রশ্নও উঠেছে।
যুদ্ধের প্রায় ছয় মাস হতে চলল। এর মধ্যে বহু বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা শোনা গেছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সেগুলোর ফারাক অনেক। সেই ফারাক যত বাড়ছে তত বেশি রক্ত ঝড়ে চলেছে। এদিকে যুদ্ধ নিয়ে জনআক্রোশও নতুন করে ভাবাচ্ছে। জ্বালানি, খাদ্যশস্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির কারণে জনসাধারণের চাপের মুখে রয়েছে গণতান্ত্রিক দেশগুলো।
আর সে কারণেই পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানদের ক্ষমতার ভীত নিয়েও তৈরি হয়েছে সংকট। ইউরোপের ঐক্য ইতোমধ্যে নড়বড়ে এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া যদি শেষ পর্যন্ত তাদের গ্যাস রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়- সেক্ষেত্রে তা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে আর কত সময় লাগবে?
বাইডেন যুদ্ধটিকে বিশ্বব্যাপী ভালো শক্তি বনাম খারাপ শক্তির মধ্যকার এক লড়াই হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি ইউক্রেনীয়দের বলেছিলেন, 'আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। শাস্তিস্বরূপ শিগগিরই ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেই রাশিয়া পিছু হটতে বাধ্য হবে'।
তার বক্তব্য শুনে বেশ আশাবাদী মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও রাশিয়াকে টলানো সম্ভব হয়নি।
সেই মাসেই বাইডেনের মতো বরিস জনসনও বলেন, 'ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসন নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে'। কিন্তু জনসনের দূরদর্শিতার ঘাটতি ছিল। তিনি বলেছিলেন, 'আমরা ক্রেমলিনকে একটি স্বাধীন দেশ খণ্ড–বিখণ্ড করে মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগের মাঝে ঠেলে দিতে দেখতে পারি না'। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য শুধু বসে বসে সব দেখেই চলেছে।
ব্রিটেনের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে এগিয়ে থাকা লিজ ট্রাস গত এপ্রিলে আরও সব অসম্ভব বাগাড়ম্বর করেছিলেন। তিনি ক্রিমিয়া খালি করার মাধ্যমে ২০১৪ সাল পূর্ববর্তী সীমান্ত ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি রাখেন রাশিয়ার সামনে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, 'আমরা দ্রুততার সঙ্গে আরও এগিয়ে যাব এবং রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে পিছু হটতে বাধ্য করব'। এখন প্রশ্ন হলো এই আমরা কারা? লিজ ট্রাস আর কোন দেশের সৈন্যরা?
এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ নিয়ে বাইডেন ইতোমধ্যে ৯.৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার কথা বলেছেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের সামরিক সহায়তার পরিমাণও ২.৩ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও অস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়েছে। এসব না থাকলে ইউক্রেন ইতোমধ্যেই হয়তো পরাজয় বরণ করে নিত।
তবে যেকোনো মূল্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে বাইডেন যে সংকল্প করেছেন তার অর্থ এই যে, রাশিয়া শেষ পর্যন্ত জিততে না পারলেও তাদের হারার সম্ভাবনাও নেই।
পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেই সক্রিয়ভাবে ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়ার সাহস করলে ভিন্ন কিছুও হতে পারত। কিয়েভে রাশিয়ার প্রাথমিক বিশৃঙ্খল অভিযানের সময় বড় সংখ্যক রুশ সেনারা বিমান হামলার ঝুঁকিতে ছিল। পেন্টাগনের আকস্মিক এক অভিযানেই পুরো আক্রমণের ঘটনা গোড়াতেই থামিয়ে দেওয়া যেত।
এখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবে সেজন্য স্রেফ বাইডেনকে দোষ দেওয়া চলে না। বাইডেনের বড় বড় কথার আড়ালে বরিস জনসন, ইম্যানুয়েল ম্যাক্রো এবং ওলাফ শলৎস ঢাকা পড়ে গেছেন বা নিজেদের আড়াল করেছেন।
এই ধরনের অবস্থা দেখলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যে তারা আসলেই রাশিয়াকে দমাতে মনেপ্রাণে আগ্রহী কি না।
সরাসরি সামরিক জয়লাভ যখন প্রায় অসম্ভব বলে মনে মনে হচ্ছে, তখন কিয়েভের হাতে প্রতিরোধ করা ছাড়া আর তেমন কোনো বিকল্পও নেই। দক্ষিণে পরাজয় একরকম নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও দোনেৎস্কের দুর্দান্ত প্রতিরোধ ও গত সপ্তাহে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের ঘটনার পর ধারণা করা যাচ্ছে- ইউক্রেন বছরব্যাপী দীর্ঘমেয়াদী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মুখোমুখি।
চাপের ফলে হয়তো যুদ্ধবিরতি বা অস্থায়ী শান্তি চুক্তি হতে পারে যাতে ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থির হয়। ইতালি ও অন্যান্য ডানপন্থী পপুলিস্ট দলগুলো যেকোনো ক্ষেত্রে সুবিধা নিয়ে আগ্রহী।
জার্মানিতে গণভোটে দেখা গেছে রাশিয়াকে ছাড় দেওয়ার পক্ষে ৫০ শতাংশ মত দিয়েছে। ইউরোপজুড়েই দেখা দিয়েছে বিভাজন। একদল যেমন ইউক্রেনের জন্য 'ন্যায়বিচার' চায়, আরেকদল চায় ইউরোপজুড়ে 'শান্তি'। দ্বিতীয় দলের মত কিন্তু কিয়েভের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে।
কিন্তু যুদ্ধের সমাপ্তি কোথায়? সম্ভবত এর উত্তর বাইডেন আবেগপ্রবণ হয়ে ওয়ারসোতেই দিয়েছিলেন। বক্তব্যের শেষে তিনি পুতিনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'ঈশ্বরের দোহাই, এই লোক ক্ষমতায় থাকতে পারে না'।
পুতিন চলে গেলেই যে তার তৈরি সংকট চলে যাবে এমনটাও না। তবে ধরে নেওয়া যায় যে সমাধান আরও সহজ হবে। আর এটাই হবে সম্ভবত ইউক্রেনীয়দের জন্য সুখী সমাপ্তির একমাত্র আশা।
তাই পুতিনকে ধরুন, তাকে সরান, তালাবদ্ধ করুন। এটা ছাড়া আর কোন কৌশলগত লক্ষ্য কাজ করবে বলা সম্ভব না।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান