ইসরায়েলের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী কারা, রপ্তানি স্থগিত করেছে কোন কোন দেশ?
ইসরায়েলে শক্তিশালী ও বাঙ্কার উড়িয়ে দিতে সক্ষম বোমার একটি চালান স্থগিত করেছে ওয়াশিংটন। সেই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন যে গাজার রাফাহ শহরে হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
গত বুধবার (৮ মে) মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের প্রতি তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
বাইডেন বলেছেন, রাফায় হামলা হলে সেখানকার লক্ষাধিক বাস্তুচ্যূত বেসামরিক নাগরিকের জীবন হুমকিতে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, ইসরায়েলের বোমা হামলায় ও স্থল অভিযানে গাজায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
তবে ইসরায়েল বলছে, বেসামরিক নাগরিকরা তাদের টার্গেট নন। হামাসের সদস্যরা বেসামরিক লোকজনের মাঝে লুকিয়ে আছে।
ইসরায়েলের এ দাবি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে হামাস।
যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলায় প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল যুদ্ধের জন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে, সেগুলো তারা কোথায় পাচ্ছে? কারা তাদের অস্ত্র সরবরাহ করছে? ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীই বা কে? এক প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে জানিয়েছে রয়টার্স।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটির প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই রয়েছে জার্মানি, তারপর ইতালি।
এদিকে কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের আশঙ্কা ইসরায়েল তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে সেসব অস্ত্র আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে। তাই এ বছর দেশ দুটি ইসরায়েলে তাদের অস্ত্রের চালানগুলো স্থগিত করেছে।
ইসরায়েলের অস্ত্র সরবরাহকারী দেশগুলোর বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো-
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের যে চালানটি স্থগিত করেছে, তার মধ্যে কয়েক কোটি ডলার মূল্যের বোমা রয়েছে।
যদিও ইসরায়েলে সরবরাহের জন্য ট্যাঙ্ক গোলা ও যুদ্ধাস্ত্রসহ কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অবশ্য এর অনুমোদন প্রক্রিয়াটিও বেশ ধীর হয়ে পড়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন সিনেট ফরিন রিলেশন কমিটির শীর্ষ রিপাবলিকান নেতা সিনেটর জিম রিশ।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ১০ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হয়। এ অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সহযোগিতা, সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য ৩৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য ৫ বিলিয়ন ডলার প্রদানের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্যমতে, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬৯ শতাংশ সামরিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছে ইসরায়েল।
জার্মানি
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ১০ গুণ বাড়িয়ে ইসরায়েলে ৩২৬.৫ মিলিয়ন ইউরো (৩৫১ মিলিয়ন ডলার) মূল্যের প্রতিরক্ষা রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে জার্মানি।
তবে এ বছরের শুরুতে গাজা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় জার্মান সরকার ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন কমিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
জার্মানির পার্লামেন্টের বামপন্থী এক নেতার প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১০ এপ্রিল জানিয়েছিল যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩২ হাজার ৪৪৯ ইউরো মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
জার্মানির সংবাদ সংস্থা ডিপিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জার্মানি প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং যোগাযোগ সরঞ্জামের উপাদান সরবরাহ করে থাকে।
এসআইপিআরআই-এর তথ্যমতে, জার্মানির ইসরায়েলে রপ্তানি করা অস্ত্রের মধ্যে ছিল ট্যাঙ্কবিরোধী বহনযোগ্য তিন হাজার অস্ত্র এবং স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য পাঁচ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ। ২০১৯-২৩ সালে জার্মানি ইসরায়েলের সামরিক সহায়তার প্রায় ৩০ শতাংশ প্রদান করেছে।
ইতালি
ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র গতকাল বৃহস্পতিবার নিশ্চিত করেছে যে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইতালি নতুন করে কোনো অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া স্থগিত করেছে। তবে আগে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সে চুক্তির আলোকে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে ইতালি।
সূত্রটি রয়টার্সকে বলেন, 'সবকিছু বন্ধ। গত নভেম্বরে সর্বশেষ চালানটি সরবরাহ করা হয়েছে।'
ইতালির আইন অনুযায়ী, যেসব দেশে যুদ্ধ চলছে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে মনে হচ্ছে, সেসব দেশে অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধ।
গত মার্চে প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইদো ক্রোসেত্তো বলেছিলেন, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না, সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরই আগে হওয়া চুক্তির আওতায় ইতালি ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
কেবল গত ডিসেম্বরেই ইসরায়েলে ১.৩ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে ইতালি। যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
এসআইপিআরআই-এর তথ্যমতে, ২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ইসরায়েলে রপ্তানি করা অস্ত্রের ০.৯ শতাংশ এসেছে ইতালি থেকে, যার মধ্যে রয়েছে হেলিকপ্টার ও নৌ কামান।
ব্রিটেন
ব্রিটেন ইসরায়েলের বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী নয়। ব্রিটিশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইসরায়েলে সরাসরি অস্ত্র না দিয়ে বরং কোম্পানিগুলোকে অস্ত্রের বিভিন্ন উপকরণ বিক্রির লাইসেন্স দিয়ে থাকে।
গত বছর ইসরায়েলে অন্তত ৪২ মিলিয়ন পাউন্ড (৫২.৫ মিলিয়ন ডলার) মূল্যের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানির লাইসেন্স অনুমোদন দেয় ব্রিটেন। এসবের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান, ছোট অস্ত্র গোলাবারুদ এবং বিমান, হেলিকপ্টার এবং অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরির উপকরণ।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক