ইউক্রেনে জোর করে নাগরিকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তির অভিযোগ উঠছে
রাশিয়াকে ঠেকাতে প্রচণ্ড যুদ্ধ লড়ছে ইউক্রেন। প্রতিনিয়ত ঘটছে হতাহতের ঘটনা। তাই নতুন সেনা সদস্যের দরকার দেখা দিচ্ছে, যেমনটা প্রায় সব যুদ্ধকালেই দেখা যায়।
ওলেক্সান্ডার ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর একজন রিক্রুটিং অফিসার। খারকিভের আশেপাশে তার মতো আরও এক ডজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব, রাস্তাঘাটে তরুণদের দেখলেই থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ আর কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা–তারা সামরিক বাহিনীতে ভর্তির যোগ্য কিনা।
যুদ্ধ বাধলে, বিশেষত তা যদি হয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই–তাহলে একটি দেশে সেনাবাহিনীতে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ শুরু হয়। ইউক্রেনেও দেশজুড়ে চলছে নিয়োগ কর্মসূচি। এর আওতায় জনপদগুলির সড়কে সড়কে টহল দিয়ে সম্ভাব্য সেনা সদস্যদের খোঁজা হচ্ছে। উপযুক্ত হিসেবে নির্বাচিতদের স্থানীয় রিক্রুটিং অফিসে গিয়ে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
তবে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিশেষ করে সড়ক থেকে পুরুষদের ধরে ধরে ভর্তির বিষয়টি নিয়ে উঠছে গোপনীয়তা ও স্বেচ্ছাচারীতার অভিযোগ। বলা হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে এটি সরকারি আইনভঙ্গ করে যারা সেনাবাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক তাদের বাদ দিয়ে যারা ইচ্ছুক নন–তাদেরকে ভর্তি করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যেই রিক্রুটার এবং যারা তাদের ফাঁকি দিতে চায়- এমন ব্যক্তিদের মধ্যে চলছে এক ধরনের চোর-পুলিশের খেলা।
গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকায় দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে নিজের পুরো নাম ও পদবী প্রকাশ করেননি ওলেক্সান্ডার। তবে তিনি বলেন, যারা যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক শুধুমাত্র সেই সকল পুরুষকেই তারা নিবন্ধনের নির্দেশপত্র দিচ্ছেন।
'আমরা সবাইকে জিজ্ঞেস করি যে, আগে থেকে তাদের কোনো ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে কিনা? তারা যুদ্ধে দেশের হয়ে লড়তে চায় কিনা- তাও জিজ্ঞাসা করি'- বলেন তিনি।
এই দাবি অস্বীকার করেন, সেনাবাহিনীতে ভর্তির নির্দেশনা পাওয়াদের অনেকেই। তাদের মতে, বিকল্প বেঁছে নেওয়া বা ভর্তি এড়ানোর কোনো সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। অন্যদিকে, যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুকদের অনেকেই বলেছেন, তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই দুষছেন তারা।
এরমধ্যেই তল্লাশি চৌকি, গ্যাস স্টেশন ও অন্যান্য জনসমাগম স্থলে সেনাবাহিনীতে ভর্তির নির্দেশনা জারি বন্ধ চেয়ে প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির কাছে এক পিটিশন আবেদন করেছেন ২৫ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয়। পিটিশনে সেনাবাহিনীতে যোগদানের একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালু করতে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
পিটিশনে লেখা হয়েছে, 'লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেকেই যুদ্ধে যোগ দিতে চায়। কিন্তু, দেশের বেশকিছু এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে যারা নিয়োগ দিচ্ছে–তাদের নিজেদেরই রয়েছে অভিজ্ঞতার ঘাটতি। একারণে ইচ্ছুকরা দেশসেবায় যোগদানের সুযোগ পাচ্ছেন না'।
নিয়োগ এড়াতে অনেকে মিথ্যেও বলছেন। এমন একজন হলেন খারকিভের বাসিন্দা ডেনিস। তিনি বলেন, 'রিক্রুটমেন্ট অফিসে গিয়ে বলেছি, আমার কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ নেই'। মিথ্যে বলেও তিনি ধরা পড়েননি, কারণ ইউক্রেনের অন্য অঞ্চলে তার সামরিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শাস্তির ভয়ে পুরো নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এই যুবক বলেন, 'আমি অনেককে চিনি যারা এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ানো নিয়োগদাতাদের ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য এমন মানুষদেরও চিনি যারা যুদ্ধে যেতে চান'।
ইউক্রেনে সেনা সার্ভিসে তরুণদের ভর্তির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বাদে সাবালক সব পুরুষকেই প্রশিক্ষণ নিতে হতো, বা অস্থায়ী নিয়োগ চুক্তি অনুসারে- কিছুদিন সেনাবাহিনীতে যুক্ত থাকতে হতো। তবে শর্ত হচ্ছে, দেশের প্রয়োজনে ডাক পড়লেই তাদের আবার ফিরতে হবে সৈনিক জীবনে। যেসব ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী পুরুষরা এ থেকে ছাড় পেতেন, সেগুলি হলো–বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান ছাত্রাবস্থা, শারীরিক অক্ষমতা বা অন্তত তিন সন্তানের জনক হওয়া।
এসব ব্যতিক্রম বাদে–১৮ থেকে ৬০ বছরের সব পুরুষকে সেনা সার্ভিসের জন্য নিবন্ধন করাতে হয়। এরপর তাদের মধ্যে থেকে যাদের ডাক আসে, তাদেরকে স্থানীয় নিয়োগকেন্দ্রে গিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়। পরীক্ষায় সব ঠিক থাকলে তাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তির উপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে এসব বিধিমালা পালন এবং তরুণ নাগরিকদের রেকর্ড অনুসরণ মহাসমস্যা হয়ে উঠেছে। সে কারণেই নেওয়া হচ্ছে এলোমেলো সব সিদ্ধান্ত।
সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, যাদের পূর্ব সামরিক অভিজ্ঞতা বা বিশেষ কোনো দক্ষতা রয়েছে–শুধুমাত্র তাদেরকেই এপর্যন্ত ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু, যুদ্ধ চলমান থাকায় নিবন্ধিত অন্যদেরও ডাকা হতে পারে।
অন্যদিকে সমালোচকদের মতে, সরকারি কর্মকর্তারা যতোটা দাবি করছেন– সেনাবাহিনীতে নিবন্ধন, ভর্তির প্রক্রিয়ায় ততোটা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না। বিষয়টি সেনাবাহিনীর আওতায় থাকায় পুরো প্রক্রিয়া গোপনীয়তার চাদরে মোড়া। প্রতিটি ধাপে নির্বাচনের মানদণ্ড নিয়েও রয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব।
অভিযোগের জবাবে, ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের সাবেক আইনি উপদেষ্টা ইয়েভহেনিয়া রিয়াবেকা বলেন, '(নিয়োগকেন্দ্রে হাজির হওয়ার) নির্দেশনা জারির বিষয়টি সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধভাবে করা হচ্ছে। সকল নাগরিকের দেশরক্ষার দায়িত্ব রয়েছে, তাদেরকে একটি নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার- এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া'।
তিনি বলেন, প্রতিটি নিয়োগকেন্দ্রকে সেনা ভর্তির নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তবে এসব সংখ্যার তথ্য 'সম্পূর্ণ গোপনীয়'।
সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে চান এমন ব্যক্তিদের আইনজীবী হচ্ছেন- আঁন্দ্রে নোভাক। তার মতে, নিয়োগকেন্দ্র রেকর্ড অনুসরণ করে কোনো নাগরিককে যদি উপযুক্ত বলে মনে করে, তখন তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য ডাকে। এরসঙ্গে যারা পথে পথে ঘুরে যাকে খুশি তাকেই হাজির হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে- তাদের কর্মকাণ্ডের রয়েছে বিশাল ফারাক। তার আইনি সংস্থা- মিলার অ্যাসোসিয়েটস শেষোক্ত প্রক্রিয়াটিকে অবৈধ বলে গণ্য করে বলে জানান তিনি।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে ভ্রাম্যমাণ নিয়োগদাতাদের গতিবিধির সার্বক্ষণিক তথ্য স্থানীয়দের জানিয়ে দিচ্ছে একটি ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের একটি চ্যানেল। এর সাহায্যে তাদের এড়িয়ে চলতে পারছেন অনেকে। চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা এখন ৬৭ হাজারেরও বেশি।
লাভিভ অঞ্চলের আরেকটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে আবার বাৎলে দেওয়া হচ্ছে সেনা সার্ভিস এড়ানোর উপায়। এমনকি পুরুষের কোন রোগগুলি থাকলে সেনাবাহিনীর অনুপযুক্ত ধরে নেওয়া হয় বা কীভাবে ভর্তির ডাক এলেও তাতে অসম্মতি জানানো যাবে–সব কিছুই ব্যাখ্যাসহ জানানো হচ্ছে।
যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে অসামান্য ঐক্য দেখা যায়। এসময় হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক নাম লেখান নিয়মিত সেনাবাহিনীতে। এর বাইরে দেশ প্রতিরক্ষার জন্য আমেরিকার ন্যাশনাল গার্ডের মতো টেরিটরিয়াল ডিফেন্স ফোর্স বা আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বাহিনীও রয়েছে ইউক্রেনে। এই বাহিনীর কিছু অংশকে প্রয়োজন অনুযায়ী লড়াইয়ে মোতায়েন করা হয়, আর বাকি ইউনিটগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বেসামরিক নিরাপত্তার নানান দায়িত্ব পালন করে।
রণাঙ্গনে রাশিয়ার সামরিক শক্তি মোকাবিলায় এই দুই বাহিনীর সংখ্যাও হয়ে পড়েছে অপ্রতুল। একইসঙ্গে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের মতে, চলতি বসন্তের শুরু থেকেই দৈনিক গড়ে ১০০ জন নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে প্রায় ৪০০ জন।
বলাইবাহুল্য, এই ঘাটতি পূরণে এখন লড়াইয়ে সক্ষম সব পুরুষকে খুঁজছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে অনূদিত ও সংক্ষেপিত