ধৈর্যশীল এবং আত্মবিশ্বাসী এক পুতিন, যুদ্ধকালীন সংকট থেকে যেন বেরিয়ে এসেছেন!

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গিয়েছিল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বদমেজাজি এমনকি কিছুটা ছন্নছাড়া হিসেবেও। বেশ কয়েকদিন গণমানুষের চোখ এড়িয়ে ছিলেন, পশ্চিমাদের নিউক্লিয়ার বোমার ভয় দেখিয়েছিলেন, এবং যুদ্ধবিরোধী রাশিয়ানদের 'স্কাম' বলে তিরস্কার করেছিলেন পুতিন।
কিন্তু জুন মাসে ভোল বদলে ফেলেন পুতিন। নিজের শক্তিশালী ভাবমূর্তি নিয়ে পুনরায় জনসমক্ষে আবির্ভূত হন তিনি। তাকে দেখা যায় আয়েশি, ধৈর্যশীল, ও আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে।
পুতিন কিছুদিন আগে নিজেকে রাশিয়ার প্রথম সম্রাট পিটার দ্য গ্রেটের সাথে তুলনা করেছিলেন। আরেকটি অর্থনৈতিক কনফারেন্সে তিনি জানিয়েছিলেন, পশ্চিমা অবরোধ দিয়ে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, বরং এতে তাদেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে। গত বুধবার পাঁচ দেশ সামিট মিটিং-এ গিয়েছেন পুতিন।
ইউক্রেনে আক্রমণের পর এটাই পুতিনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। এমনকি করোনাভাইরাসের পর এ প্রথম তিনি একদিনের বেশি সময় নিয়ে বাইরের দেশ ভ্রমণ করছেন। স্পেইনে ন্যাটো সামিটের রাশিয়ান প্রত্যুত্তর হিসেবে দেখা হচ্ছে এটিকে। এছাড়া এ পাঁচ দেশ সামিটের মাধ্যমে পুতিন এটাও প্রমাণ করতে চাইছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ চললেও ক্রেমলিন এখনো নিত্যদিনের কাজগুলো সাধারণভাবেই করে যাচ্ছে।
পুতিন চাইছেন বড়সড় একটি পরিবর্তন দেখাতে, এই ভ্রমণটি সেটারই সর্বশেষ পদক্ষেপ। যুদ্ধকালীন সংকট পরিস্থিতি থেকে দৃশ্যপটকে বদলে দিয়ে পুতিন চেষ্টা করছেন একজন স্থিতধী, পিতৃসুলভ নেতা হিসেবে রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বাঁচানোর কর্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কিয়েভে প্রাথমিক ব্যর্থতা ও পশ্চিমা অবরোধের ধাক্কা কাটিয়ে পুতিন এখন মনে করেন তিনি তার যুদ্ধপ্রক্রিয়া, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন।
হয়তো প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা গেছে, এবং সবমিলিয়ে অতটা খারাপ পরিস্থিতিকে পড়তে হয়নি পুতিনকে। তবে এখনো অনেক ঝুঁকিই পুতিনের ঘাড়ে ঝুলছে। ইউক্রেন এখনো যুদ্ধে হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো চিহ্ন দেখায়নি। ন্যাটো আরও বেশি সংঘবদ্ধ ও বর্ধনশীল। আর রাশিয়ার ভেতরে এক ধরনের গুমোট ভাব; যেখানে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এবং যুদ্ধের মৃত্যু-ধ্বংসের অনুরণন এখনো শেষ হয়নি।
'পুতিন বোঝেন তার বৈধতা, তার শক্তিশালী ও সচল থাকা এবং কাজ করা ও জেতার ওপর নির্ভরশীল,' বলেছেন পুতিনের সাবেক বক্তৃতালেখক ও বর্তমানে ইসরায়েলে বাস করা রাজনৈতিক উপদেষ্টা আব্বাস গ্যালিয়ামভ।
এ সপ্তাহে পুতিনের দেওয়া বার্তায় মূল আলাপ হচ্ছে রাশিয়া বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতা থেকে অনেক দূরে আর ন্যাটো সামিটে যতই ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া হোক না, তা নিয়ে রাশিয়ার বিশেষ মাথাব্যথা নেই।
কেবল ২৪ ফেব্রুয়ারির পর প্রথম দেশের বাইরে বের হওয়ার কারণে নয়, বরং মহামারির বিরুদ্ধে অসামান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও পুতিনের মধ্য এশিয়ায় এ ভ্রমণটি উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। মঙ্গলবার তাজিকিস্তানের দুশানবেতে নেমে দেশটির প্রেসিডেন্ট এমোমালি রাহমনের সঙ্গে দেখা করার পর তাজিকিস্তানে রাত কাটান তিনি। ২০২০ সালের জানুয়ারির পর এ প্রথম রাশিয়ার বাইরে রাত্রিযাপন করলেন পুতিন।
বুধবার কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পাঁচ দেশের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে তুর্কমেনিস্তান পৌঁছেন পুতিন। এ সামিটের বাস্তবিক তাৎপর্য অনেক, কারণ রাশিয়া চাইছে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, জ্বালানিসমৃদ্ধ জায়গাগুলোতে প্রভাব বাড়িয়ে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর এ অঞ্চলে সৃষ্ট শক্তিশূন্যতা পূরণ করতে।
তবে এ সামিট রাশিয়াতে পুতিনের জন্য প্রতীকী তাৎপর্যও বহন করে। কারণ তাদের সামনে পুতিন এখন একইসাথে কূটনীতিক কৌশল ও রাশিয়ার সফট পাওয়ার দুটোই উপস্থাপন করছেন। কাস্পিয়ান নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পুতিন আরও আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এমনকি তিনি কাস্পিয়ান ফিল্ম ফোরাম তৈরির জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন।
এরপর এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে পুতিন আবারও বলেছেন যুদ্ধ শেষ করা নিয়ে তার বিশেষ তাড়া নেই। 'কাজটা (যুদ্ধ) ভালোভাবে, স্বচ্ছন্দে যাচ্ছে, এটার সময় নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই,' বলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাশিয়ার নেতা আবারও ইঙ্গিত দেন তিনি পিছু হটবেন না। এসময় এক ভিডিওবার্তায় তিনি পুনরায় কিয়েভকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষারোপ করেন।
ক্রেমলিন বিশেষজ্ঞ তাতিয়ান স্তানোভায়া বলেন, 'কিছু তর্জনগর্জন ও আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ নেওয়ার পর পুতিন অন্যদের থেকে তার ফিডব্যাক পেতে চান। তিনি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন, নিজের মন খুলে কথা বলেন, রাখঢাক না রেখেই মতামত প্রকাশ করেন। এটা যেন অনেকটা তিনি আদতে কী কাজ করেছেন সেটা বাইরে গিয়ে অন্যদের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছেন।'
করোনা মহামারি ও পশ্চিমা অবরোধ, দুটোই পুতিনের বিচ্ছিন্নতাকে আরও বর্ধিত করেছে। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর বক্তৃতায় তিনি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের 'শঠতার সাম্রাজ্য' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তার কাজে বাধা দিলে 'কপালে অচিন্তনীয় দুঃখ' আছে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন পুতিন। এমনকি যেসব রাশিয়ান যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেছিল, রাশিয়ান সমাজ তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলবে বলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু সম্প্রতি হুমকিধামকি দেওয়া পুতিনের বদলে তার অন্যরূপ দেখা যাচ্ছে। এখন তিনি আয়েশি ভঙ্গিমায় জনগণের সামনে উপস্থিত হচ্ছেন।
তবে, এখন পর্যন্ত পুতিন যুদ্ধ প্রসঙ্গে অফিসিয়াল ঘোষণা দিয়ে মিলিটারি ড্রাফট চালু করবেন বলে যে অনুমান করা হয়েছিল তা হয়নি। আবার রাশিয়া পশ্চিমা পদক্ষেপগুলোতে শত্রুভাবাপন্ন বললেও পুতিনের পক্ষ থেকে সেগুলো নিয়ে কোনো শক্ত প্রতিশোধ দেখা যায়নি।
বরং মনে হচ্ছে পুতিনের কৌশল হলো বসে বসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। তিনি চাচ্ছেন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পশ্চিমারা হোঁচট খাক, আর যুদ্ধ করতে করতে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হোক।
স্তানোভায়া বলেন, 'সময়ের সাথে সাথে কিয়েভকে সবকিছু মেনে নিতে হবে, এমন বাজিই খেলছেন পুতিন। বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া দেখে পুতিন মনে করছেন, আপাতত মার্কিনীদের নিয়ে বিশেষ ভাবনা নেই, বরং অপেক্ষা করা যাক।'
তবে এ প্রত্যাশাতে ঝুঁকিতো রয়েই যাচ্ছে। পুতিন আগেও প্রত্যাশা করেছিলেন ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ান বাহিনীকে স্বাগতম জানাবে, কিন্তু তা হয়নি। এদিকে দেশের ভেতরেও তাকে লড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে।
আগামী বছর থেকে রাশিয়ার ভলগা বদ্বীপের আস্ত্রাখান অঞ্চল থেকে প্রথম কাস্পিয়ান ক্রুজ শিপ চলাচল শুরু করবে বলে জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ওই জাহাজের নাম: পিটার দ্য গ্রেট।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস