বিচারিক আদালতের অসঙ্গতিপূর্ণ রায়, ফিরতে হবে '৭২-এর সংবিধানে
রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার অধিবাসী মাজেদা বেগমকে নিয়ে এক ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটিত হলো। মাজেদা বেগমের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার অভিযোগ এনে অভিযোগপত্র দেয়। গ্রেফতারের পর মাজেদা বেগম হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে মাজেদা গলা টিপে শিশুটিকে হত্যার কথা বলে অথচ সুরতহাল রির্পোটে উল্লেখ করা হয়, শিশুটির গলায় রশি প্যাঁচানো ছিল। পুলিশ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করে, আসামী মাজেদা নিজের শ্বশুরকে ফাঁসানোর লক্ষ্যে শিশুটিকে হত্যা করে শ্বশুরের উপর দায় চাপাতে চায়। মাজেদা বেগমের স্বীকারোক্তিতেও প্রসঙ্গটির উল্লেখ রয়েছে।
বিচারিক আদালতে যখন মামলাটির বিচার কাজ শুরু হয় তখন মাজেদা বেগম তার ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬ সালে বিচারিক আদালত মাজেদা বেগমকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। মাজেদা বেগম তখন থেকেই কারাগারে।
এই মামলার যখন রায় ঘোষণা করা হয়, তখন মাজেদার সঙ্গে ছিল তার দেড়বছরের শিশু সন্তান। বিচারিক আদালত সন্তানসহ কারাবাসের অনুমোদন দেন। গত ৫ বছর মাজেদা শিশু সন্তানসহ কারাগারের কনডেম সেলে দিন গুনতে থাকেন।
ডেথ রেফারেন্স হিসেবে মামলাটি উচ্চ আদালতে আসলে মামলায় বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রথমত ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় মাজেদার স্বীকারোক্তির সাথে সুরতহাল প্রতিবেদনের কোন মিল নেই। খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়, জোরপূর্বক মাজেদার কাছ হতে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়।
তারপরও হত্যার মোটিভ হিসেবে শ্বশুরের উপর দায় চাপানোর যে গল্প তৈরি করা হয়, সেখানে গড়মিল ধরা পড়ে। শ্বশুরকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্য থাকলে লাশ শ্বশুরের ঘরের আশপাশে কোথাও রাখার কথা। কিন্তু লাশ উদ্ধার হয় বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটি ভগ্ন বাড়ি থেকে।
উচ্চ আদালত মামলার নথি দেখেই উল্লিখিত অসংগতিগুলো ধরতে পারেন। উচ্চ আদালত মাজেদা বেগমকে খালাস দিয়েছেন। রংপুরের গঙ্গাচড়ার এই মাজেদা বেগমকে আমরা কেউ চিনি না, চেনাড় কোনো কারণও নেই। মাজেদার যখন কারামুক্তি ঘটবে তখন তার সন্তানটি বয়স হবে সাড়ে ৬ বছর।
মাজেদার মুক্তি নিঃসন্দেহে আনন্দের খবর। কিন্তু এই আনন্দের মধ্য দিয়েই মাজেদা আমাদের পুলিশ, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট, আমাদের বিচারিক আদালত নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে গেলেন। আমাদের সভ্যতা, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের এগিয়ে চলা, আমাদের যতকিছু অহংকার—তা যেন নিমিষে নিভিয়ে দিলো।
বাংলাদেশের বিচার আদালতের এই ধরনের গড়মিলের ইতিহাস অনেক। এর প্রধান কী কারণ, তা সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের অনুসন্ধান করতে হবে। বিশেষ করে আমাদের সুপ্রিমকোর্টে যাদের উপর এ ধরনের তদারকির দায়িত্ব অর্পিত, তাদের করণীয় কী আছে তা ভাবতে হবে। কেবল আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে এ ধরনের বিচারকরা যদি ছাড় পেয়ে যান, তাহলে এ ধারা চলতেই থাকবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৩টি বিষয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে তাদের ভাষায় ১৪টি দুর্বল অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে (২০২১ সালের জুন পর্যন্ত) প্রায় দুই হাজারের উপরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কারাগারে জীবন-যাপন করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের যৌথ গবেষণায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : গুপ্তচরবৃত্তি, সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বেশ কিছু বিষয় বাদ দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৩টি বিষয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে।
২০১১ নভেম্বর মাসে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ছিল ১০০৯। দশ বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা পরিণত হয়েছে দ্বিগুণে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ভারতের মতো অনেক জনসংখ্যার দেশে বর্তমানে কারাগারে মাত্র ৪০৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছেন। সেই বিবেচনায় কী পরিস্থিতি বাংলাদেশের!
মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি এখন অনেকটা জনমতের উপর নির্ভর করছে। যেকোনো ঘটনায় দাবি ওঠে মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসি দিতে হবে। বিচার আদালতের বিচারকরাও যে এই দাবির দ্বারা প্রভাবিত, তা প্রমাণিত।
রংপুরের ঘটনাটি কিভাবে নিষ্পত্তি হবে, সেটিই আগামী দিনের প্রধান বিষয়। বিচার আদালতের বিচারক এবং ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সেটিও দেখতে হবে।
বিচারিক আদালতের এই রকম অসঙ্গতিপূর্ণ রায় দেওয়ার বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকার ফলেই, বিচারিক আদালতের বিচারকরা তাদের মনের মতো করে রায় প্রদানের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন।
শুধু ক্রিমিনাল আদালতে নয়, বরং আমাদের সিভিল আদালতের ক্ষেত্রেও এমন বহু ঘটনা ঘটে। সুতরাং, বর্তমানের দ্বৈত শাসনের আদালতকে ১৯৭২-এর মূল সংবিধান অনুসারে একক তত্ত্বাবধানে দেওয়া, অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্টের একক নিয়ন্ত্রণে দেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।