৮৬ বছরের পুরোনো পাঠকপ্রিয় ম্যাগাজিন 'রিডার্স ডাইজেস্ট' যেভাবে বন্ধ হয়ে গেল
প্রতিষ্ঠার ৮৬ বছর পর অবশেষে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা কোম্পানি রিডার'স ডাইজেস্ট। মূলত চলমান 'অর্থনৈতিক সংকট' এর কারণেই কোম্পানিটি এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
ম্যাগাজিনটির বর্তমান প্রধান সম্পাদক ইভা ম্যাকেভিক গতকাল (১ মে) সন্ধ্যায় লিঙ্কডইন-এ এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি জানান, তাদের ব্রিটিশ সংস্করণ 'ম্যাগাজিন প্রকাশনা জগতে চলমান পরিস্থিতির' বাস্তবতায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব বিখ্যাত ম্যাগাজিনটির প্রায় ১ হাজার ২০০ ইস্যু প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বহু বিশ্বনেতা, কিংবদন্তি অভিনেতা ও সংগীতশিল্পীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
ইভা ম্যাকেভিক বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত কোম্পানিটি সমসাময়িক ম্যাগাজিন প্রকাশনা জগতের আর্থিক চাপ সহ্য করতে পারেনি এবং ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।"
প্রায় ১৪ বছর আগে কোম্পানিটি ১২৫ মিলিয়ন ডলারের পেনশন তহবিলের ঘাটতি সংকটে পড়েছিল। প্রতিনিয়ত ধুঁকতে থাকা ম্যাগাজিনটি ২০১৪ সালে পুঁজিপতি মাইক লাকওয়েলের কাছে বিক্রি হওয়ার আগে বেটার ক্যাপটিওলেরও সহযোগিতা নিয়েছিল, যিনি 'বব দ্য বিল্ডার' কার্টুন সিরিজের মাধ্যমে টিভি কোম্পানি থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছিলেন।
ম্যাগাজিনটির প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিউইট ওয়ালেস ও তার স্ত্রী লীলা। ১৯২২ সালে গ্রিনউইচ গ্রাম থেকে এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়েছিলেন ওয়ালেস। ঐ সময়টাতে অসুস্থ অবস্থায় তিনি শত শত নিবন্ধ সংগ্রহ শুরু করেন এবং ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।
ওয়ালেসের ধারণাটি মোট ১৮টি কোম্পানি প্রত্যাখ্যান করলেও তিনি মনোবল হারাননি। বরং তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে এগিয়ে যান এবং এটি পরবর্তীতে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হয়।
প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকে ম্যাগাজিনটির পাঠকসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। একইসাথে ১৯৩৮ সালে যুক্তরাজ্যে এটির প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ম্যাগাজিনটির পাঠক সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ মিলিয়ন। একইসাথে মোট ১৩টি ভাষায় ৪০টি ভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্করণের এটি প্রকাশিত হতে থাকে।
ম্যাগাজিনটি দীর্ঘ ইতিহাসে গর্ব করার মতো বহু কাজ করেছে। ১৯২৪ সালের প্রথম দিকে এটি তামাক ব্যবহারকে অকাল মৃত্যুর সাথে তুলনা করে একটি গল্প ছাপিয়েছিল। ম্যাগাজিনটি ১৯৫২ সালে 'ক্যান্সার বাই দ্য কার্টন' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিল। ধারণা করা হয়, এটির প্রভাবে ধূমপানের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছিল।
ম্যাগাজিনটির 'দ্য রিডার্স ডাইজেস্ট গ্রেট ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস' নামের একটি ব্রিটিশ ধারণা ১৯৬১ সালে প্রকাশ করেছিল। এটি ছিল সংবাদের জগতে এক যুগান্তকারী বিষয়। কেননা এটিতেই প্রথমবারের মতো প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক ছবি ও টেক্সট একসাথে সংযোজিত করা হয়েছিল।
ম্যাগাজিনটি সবসময় নিজেদের মানের ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে একটি বই প্রকাশের কথাই ধরা যাক। বইটি প্রকাশের আগমুহূর্তে তাদের মনে হয় যে, এটির মান যথেষ্ট ভালো হয়নি। তাই পরবর্তীতে এটি প্রায় ৫ লাখ শব্দ পরিবর্তন করে এবং ৫০০-এর বেশি পৃষ্ঠা নতুন করে যুক্ত করে৷
১৯৮৬ সালে রিডার্স ডাইজেস্ট ইউকে লন্ডনের কিউ গার্ডেনে কার্পেট তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ১.৫ মিলিয়ন বাল্ব রোপণ করে নিজেদের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে। বর্তমানেও সেগুলো বহুগুণ বেড়ে চলেছে। এমনকি ব্রিটেনের তৎকালীন রানি এলিজাবেথও 'দায়িত্বশীল ও বিনোদনমূলক সাংবাদিকতার অর্ধ শতাব্দী' পূরণের জন্য প্রকাশনা সংস্থাটিকে জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিল।
পরবর্তীতেও ম্যাগাজিনটির সাথে রানীর সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৮৮ সালে এটি রানির ৬০ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি প্রতিকৃতি প্রকাশ করে। বাকিংহাম প্যালেসের বিবৃতি অনুযায়ী, 'তিনি এটা খুব পছন্দ করেছিলেন।' লন্ডনের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারির স্থায়ী সংগ্রহশালায় আজও এই প্রতিকৃতিটি টানানো রয়েছে।
২০০০ সাল নাগাদ রিডার্স ডাইজেস্ট ইউকে মাসে এক মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি করছিল। আবার ২০০৫ সালে এর যুক্তরাজ্যের টিম নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত এক সাক্ষাৎকারে নেয়। যেখানে শান্তিতে এ নোবেল বিজয়ী নিপীড়নের মধ্যে থেকেও মানবতা প্রতিষ্ঠায় তার পথচলা তুলে ধরেন।
আধুনিক সময়ে ম্যাগাজিনটি শ্যারন অসবোর্ন, রিকি গারভাইস, ইদ্রিস এলবা এবং জুডি ডেঞ্চের মতো সেলিব্রিটিদের গল্প নিজেদের প্রচ্ছদে তুলে ধরেছে।
গত বছর রিডার্স ডাইজেস্ট রক তারকা রড স্টুয়ার্টের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সেখানে তিনি মেনোপজ সম্পর্কে তার প্রচারণা, ইউক্রেনীয়দের সাহায্য করা এবং কাতার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের জন্য ১ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি প্রস্তাব পাওয়া নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। একইসাথে লন্ডনের মেয়র সাদিক খানের রাজনীতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে ভাবনাও তাদের এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে।
ম্যাগাজিনটির সুসময়ে তারা আর্থিকভাবে এতটাই সচ্ছল ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সদর দফতর নিজেদের সাংবাদিকদের সম্মান দিতে তারা দেয়ালে ম্যাটিস, রনোয়ার এবং ভ্যান গঘের মূল কাজ টানিয়ে রাখতো।
দুঃখজনকভাবে আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতা, ইন্টারনেটের প্রসার এবং বিপণন কৌশলে যুগের সাথে তাল মেলাতে না পারায় প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছে ম্যাগাজিনটি।
রিডার্স ডাইজেস্টের কানাডিয়ান সংস্করণটি গত বছরের শেষের দিকে 'বিজ্ঞাপন বিক্রিতে রাজস্ব হ্রাস, উৎপাদন ও বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধি এবং ভোক্তাদের পড়ার অভ্যাসের পরিবর্তন' এর কথা বলে নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান