সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর: ইউএনও’র সৃজনশীল উদ্যোগে এক চত্বরেই ১৩ সেবা
এক চত্বরেই রয়েছে নারী, শিশু, বেকার ও দর্শনার্থীদের জন্য নানা সেবা। রয়েছে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, শারিরীক ও মানসিক গঠন এবং চিত্তবিনোদনের সুযোগ। ৬০ ডেসিমেল জমির এই চত্বরে আছে কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং সেন্টার, পাবলিক লাইব্রেরি ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ডিসপ্লে সেন্টার, শিশু একাডেমি, মিনি শিশু পার্ক, বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম, সেলুন, রেস্টুরেন্ট, অ্যাম্পিথিয়েটার ও মার্কেট।
সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা বিশ্বম্ভরপুরে এতোসব সুযোগ ও সেবা নিয়ে গড়ে ওঠা এই অনন্য উদ্যোগের পোষাকি নাম 'উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার'। আর এটি নির্মাণ করছেন বিশ্বম্ভরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ। ইতোমধ্যেই তার বিভিন্ন সৃষ্টিশীল ও নান্দনিক উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তার উদ্যোগ নিয়ে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় 'সুনামগঞ্জের এক উপজেলা যেভাবে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠল!' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
উপজেলাকে সাজিয়ে তোলার পর এবার দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হয়েছেন ইউএনও জাদিদ। তাই শিশুদের বিকাশ এবং নারী ও যুবকদের কর্মসংস্থানে গড়ে তুলেছেন 'উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার'।
উদ্যোগটি প্রসঙ্গে ইউএনও সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, "বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা জেলার মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। এখানে কর্মসংস্থানের কোন সুযোগ গড়ে উঠেনি। শরীরচর্চা ও বিনোদনের কোন সুযোগ নেই। শিশুদের মানসিক বিকাশেরও ব্যবস্থা নেই। ফলে শিশু ও তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। যুবকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েও বেকার থাকতে হচ্ছে। আর উদ্যোক্তা নারীরা যথাযথ বিপণনের অভাবে নিজেদের তৈরি পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না।"
তিনি বলেন, এই তিন শ্রেণীর কথা চিন্তা করেই 'উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টার' নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে তরুণ-তরুণীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিশুদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশের জন্য একটি শিক্ষা ও বিনোদনমূলক পরিবেশ তৈরি এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী উদ্যোক্তাদের আর্থ সামজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের টাউন সেন্টার দেখে এরকম কিছু করার প্রেরণা পেয়েছেন জানিয়ে ইউএনও বলেন, "যুক্তরাজ্যে থাকাকালে দেখেছি তাদের বিভিন্ন শহরে টাউন সেন্টার রয়েছে। যেখানে একসাথে অনেকগুলো সেবা পাওয়া যায়। তার আদলেই এই মাল্টিপারপাস সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে।"
সম্প্রতি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা কমপ্লেক্সের অনতিদূরে হাওরের সড়কের পাশেই সরকারি খাস জমিতে গড়ে উঠেছে এই মাল্টিপারপাস সেন্টার। পাশেই হাওর, যাতে সবুজ রূপ দিয়েছে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। সবুজের পাশেই খাড়া হয়ে আছে নান্দনিক নির্মাণশৈলীর লাল রংয়ের একেকটা ভবন। সবগুলো ভবনেরই নির্মাণকাজ শেষ। কেবল ইনডোর শিশুপার্ক এখনও নির্মাণাধীন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আদলে এই মাল্টিপারপাস সেন্টারটি পরিচালিত হবে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫ জনের মাধ্যমে কম্পিউটার ক্লাব ও ফ্রিল্যান্সিং সেন্টার পরিচালিত হবে। এই সেন্টার পরিচালনার জন্য তাদের ক্ষুদ্র ঋণও দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের পাঁচজন শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরি ও ল্যাংগুয়েজ ক্লাব। লাইব্রেরির সদস্যপদ গ্রহণ করেও এখানে যে কেউ বই পড়ার সুযোগ পাবেন আর ন্যূনতম ফির মাধ্যমে ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ও বাংলা ভাষা শুদ্ধ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নেয়া যাবে।
প্রদর্শনী কেন্দ্রে থাকবে উপজেলা নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পোষাক ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪ জন নারী উদ্যোক্তা পরিচালনা করবেন বিউটি পার্লার। পার্লার পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তাদের ক্ষুদ্রঋণও দেওয়া হয়েছে। এ দুটির তত্ত্বাবধানে রয়েছেন উপজেলার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৪ জন তরুণকে দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে আধুনিক সেলুন।
শিশু একাডেমিতে শিশুদের সঙ্গীত, আবৃত্তি ও নৃত্যের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এটি পরিচালনা করবে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি। ইনডোর পার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড। আর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে একজন তরুণ উদ্যোক্তার মাধ্যমে পরিচালিত হবে জিমনেসিয়াম। মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট পরিচালিত হবে অস্থায়ী চুক্তির ভিত্তিতে। মার্কেটে শিক্ষাসামগ্রী ছাড়াও পর্যটকদের জন্য সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিস পাওয়া যাবে। এছাড়া উন্মুক্ত মিনি অ্যাম্পিথিয়েটারে আয়োজন করা হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
এই কমপ্লেক্সের নারী উদ্যোক্তাদের ডিসপ্লে সেন্টারের বিক্রয় কর্মী মিনহা আক্তার জানান, এখন ১০ জন উদ্যোক্তার তৈরি পণ্য এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা ও পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হবে।
তিনি বলেন, যেসব পণ্য এখানে রয়েছে সেগুলোর উদ্যোক্তাদের মোবাইল নাম্বার এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। কোন পণ্য গ্রাহকের পছন্দ হলে তিনি উদ্যোক্তার সাথে যোগাযোগ করে চাহিদামত পণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন।
বিউটি পার্লারের একজন কর্মী বলেন, "রূপসজ্জার প্রশিক্ষণ নিলেও এতোদিন বেকার ছিলাম। কারণ এখানে কোন পার্লার নেই। এখানে আমার মত আরো কয়েকজন কাজের সুযোগ পেয়েছে।"
১০ ফেব্রুয়ারি এই মাল্টিপারপাস সেন্টারের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী।
ইউএনও মো. সাদি উর রহিম জাদিদ জানান, মাল্টিপারপাস সেন্টার নির্মাণে মোট ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। টিআরসহ উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে উদ্ধৃত টাকা, সংসদ সদস্যের বরাদ্দ ও স্থানীয়দের অনুদান থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখানকার সবগুলো প্রতিষ্ঠানই নূন্যতম ভাড়ায় স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এই ভাড়ার টাকার একটি অংশ এখানকার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হবে। আরেকটি অংশ উপজেলা শিক্ষা ট্রাস্টে জমা হবে।
২০২০ সালে বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন জাদিদ। এরপর থেকেই উপজেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও একে পর্যটক আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি।
ইউএনও জাদিদের প্রশংসা করে বিশ্বম্ভরপুরের দিগেন্দ্র বর্মন সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ বিমলাংশু রায় বলেন, "তিনি খুবই করিৎকর্মা ও সৃষ্টিশীল মানুষ। অনেক কাজ করছেন। সরকারি কর্মকর্তারা সাধারণ এমন হন না। অনেকেই আসেন যান। কিন্তু তিনি অন্যরকম।"