আমাদের হাঁটার রাস্তায় কেন হাঁটা যায় না!
ঢাকার ফুটপাত ধরে হাঁটতে গেলে প্রায়ই আমি হয় ছিটকে পড়ি, নইলে একপর্যায়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। একটা লম্বা সময় জুড়ে ভাবতাম, এ সমস্যা বুঝি আমার একারই! কিন্তু একদিন এবড়ো-খেবড়ো, উঁচুনিচু, অমসৃণ ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় আমার এক বন্ধুকেও এ নিয়ে অভিযোগ করতে শুনলাম।
দু'জনে মিলে ফুটপাতের এমন একটা পয়েন্ট বা অংশ খোঁজার চেষ্টা করলাম যেখানে বিনা আয়াসে চলা সম্ভব। কিন্তু না, দুইজনের কেউই সে যাত্রায় সফল হলাম না।
আসলে উন্নত, পরিকল্পিত যেকোনো শহরের ক্ষেত্রেই হাঁটাচলার জন্য যথাযথ পরিষেবার উপস্থিতি খুব জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে দেশের কোনো শহরেই সে পরিষেবা নেই।
ফুটপাত যেকোনো শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর একটি। শুধু পথচারীদের হাঁটার সুবিধার্থেই নয়, বিভিন্ন সড়কের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। শহরাঞ্চলে হাঁটার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতে সহায়তা করে ফুটপাত।
তবে সময়ের সাথে শহরগুলো যেভাবে বর্ধিত হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবহনের সবচেয়ে মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ রূপ-হাঁটার-প্রসারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ঢাকায় শান্তিপূর্ণভাবে হাঁটার জন্য যথাযথ ওয়াকওয়ের দেখা মেলা ভার। ওয়াকওয়ের একটি অংশ থেকে আবাসনের সম্মুখভাগ দেখা যাবে, থাকবে গাছ কিংবা তৃণভূমি। ওয়াকিং বেল্ট হিসেবে পরিচিত এ পরিসরেই থাকবে পথচারীদের জন্য আলাদা জোন, যাকে আমরা সচরাচর ফুটপাত বলে থাকি।
একজন স্থপতির চোখে ঢাকার ফুটপাতের ১০টি সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হলো এখানে-
১। জোনিংয়ের অভাব
ঢাকার ফুটপাত ব্যবহারের সময় আপনার হাঁটার গতিতে কি ছন্দপতন ঘটে? ভ্রু কুঁচকে আশেপাশে তাকালেই বুঝতে পারবেন, এর কারণ ফুটপাতে বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জোন ভাগ করা নেই এখানে। বেশিরভাগ ভবনের সম্মুখভাগ এবং অন্যান্য কাঠামো ওয়াকওয়েতে সরাসরি নেমে এসে অপ্রয়োজনীয় বাধার সৃষ্টি করে।
গ্লোবাল আরবান ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, একটি ওয়াকওয়ে তিনটি জোনে বিভক্ত থাকা উচিত।
যেকোন কাঠামোর সামনে আট-ফুট পরিমাণ জায়গা ছাড়তে হবে, যার মধ্যে পড়বে ভবনের সামনের অংশও; এটি আসলে বাইরের অংশের সাথে ভবনের 'বাফার জোন' হিসেবে কাজ করবে।
পরবর্তী আট-ফুট জায়গা হবে পথচারীদের হাঁটার জোন। এটি শুধুই নিরবচ্ছিন্ন চলাফেরার কাজে ব্যবহৃত হবে।
শেষের চার ফুট জায়গা গাছ এবং অন্যান্য স্থাপনা কিংবা হকারের জন্য বরাদ্দ থাকতে পারে।
২। উঁচুনিচু, বন্ধুর পথ
আমাদের শহরগুলোতে মসৃণ এবং ফাটলমুক্ত ফুটপাত খুঁজে পাওয়া ভার। ফুটপাতের এসব এবড়ো-থেবড়ো পৃষ্ঠ ধরে চলার সময় মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকে না; অনেকের তো পা-ই মচকে যায়।
ফুটপাতের জন্য এমন সমতল পৃষ্ঠ থাকতে হবে যা একই সাথে শক্ত অথচ মসৃণ হবে; যার ওপর দিয়ে পথচারী তো বটেই, হুইলচেয়ারও অনায়াসে পার হতে পারবে। ফুটপাতের ওপর সুসংবদ্ধ মসৃণ টাইলস ব্যবহার করলে অন্ধদের চলার জন্যও সহায়ক হবে।
নিরবচ্ছিন্ন পথচলার জন্য হাঁটার পথে ম্যানহোল এবং গ্রেটিংসও এড়ানো উচিত। আঁকাবাঁকা পাথর, অসমতল কংক্রিট, ইটের টুকরা পথচারীদের পায়ে চাপ সৃষ্টি করে।
৩। উচ্চতায় অসামঞ্জস্যতা
হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলেন আপনি সহসাই ফুটপাতের লেভেল থেকে কয়েক ধাপ নিচে নেমে গেছেন। কোনো একটি বাড়ির প্রবেশপথ মাড়িয়ে আবার হয়তো ফুটপাতের ওপরে উঠে পড়লেন। ফুটপাতের লেবেলগুলোর উচ্চতার এই ব্যবধান কখনও কখনও এক ফুটের মতোও হতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে বয়স্ক আর শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুগে। হাঁটার সময় এমন অস্বস্তি দীর্ঘমেয়াদে হাড়ের ক্ষতি করতে পারে। আমি এমন অনেককে চিনি, যারা উঁচুনিচু পৃষ্ঠে হাঁটার সময় অসাবধানতাবশত আঘাত পেয়েছেন পায়ে।
৪। হকার
রাস্তার হকারদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই কেনাকাটা করেছেন, এদের ব্যবসা জমে ওঠে ফুটপাতের ওপরেই। কিন্তু তাদের ব্যবসায় জায়গা করে দিতে ওয়াকওয়েতে যতখানি অবশিষ্ট থাকে, তাতে হাঁটতে ভালোই বেগ পোহাতে হয়।
এই ছোট ছোট ব্যবসায় উদ্যোগগুলি সুষ্ঠু শহরের বৈশিষ্ট্য হিসেবেই গণ্য হতে পারে, যদি ফুটপাতের নকশা করার সময় তাদের জন্য স্থান নির্ধারিত করা থাকে।
৫। যত্রতত্র বৈদ্যুতিক খুঁটি আর গাছ
ঢাকার ফুটপাতে প্রতিদিন চলতে-ফিরতে বৈদ্যুতিক খুঁটি, এলোমেলোভাবে লাগানো বড় গাছ, বেরিয়ে থাকা গাছের শিকড় আর আরো নানান প্রতিবন্ধকতা আমাদের সামনে পড়ে যায়।
এর সমাধান কিন্তু জটিল কিছু নয়: বিদ্যুতের তারগুলো মাটির নিচ থেকে টানানো যায়। গাছগুলো পরিকল্পিত এবং সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা যেতে পারে। সবশেষে গাছের গোড়াগুলোকে ট্রি গ্রেটস বা লোহার ঝাঁঝরি দিয়ে ঢেকে রাখা যায়।
ট্রি গ্রেটগুলোকে একই সমতলে স্থাপন করতে হবে; ছিদ্রের মধ্য দিয়ে সড়কে জমা থাকা পানি ভেতরে প্রবেশ করবে যা গাছের পুষ্টি যোগাবে।
৬। ছাউনির অভাব
প্রখর রোদে ফুটপাতে আমরা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার অভাব বোধ করি তা হলো, একটি শীতল ছায়াযুক্ত হাঁটার পথ। ঘাস, গুল্ম আর ছায়া প্রদানকারী বড় বড় গাছ আছে এমন গ্রিন বেল্ট সড়কে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এটি ট্র্যাফিক লেন থেকে ফুটপাতকে পৃথককারী বেড়া হিসাবেও কাজ করবে। গাছপালা শুধু ছায়াই প্রদান করবে না, উপরি পাওনা হিসেবে চারপাশ শীতলও রাখবে।
৭। আলোর অভাব আর অপরিচ্ছন্নতা
ওয়াকওয়ের জন্য নিরাপত্তা এবং পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাতের বেলা অন্ধকার ফুটপাতে হাঁটার সময় অনিরাপত্তায় ভোগা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাবে মানুষ ফুটপাতে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাতে রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ময়লার ঝুড়ি থাকতে হবে। নিজেদের শহরটি পরিচ্ছন্ন রাখতে আসলে নিজেদের এগিয়ে আসার তো কোনো বিকল্প নেই।
৮। বিশ্রামের জায়গা কই!
দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর ক্লান্তি এসে ভর করে কখনো। বাস স্টপের নামে কিছু কিছু জায়গায় এলোমেলো বেঞ্চ পড়ে থাকতে দেখা যায় (সব এলাকায় নয় যদিও)। এমনিতে হাঁটার রাস্তা দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুটের বেশি হওয়া উচিত নয়। যদি এটি ২০০ ফুট অতিক্রম করে, তাহলে ১০০ ফুটের ব্যবধানে বেঞ্চ বা বিশ্রামের জন্য চেয়ারের বন্দোবস্ত থাকা উচিত।
৯। অবৈধ পার্কিং
ওয়াকওয়েতে গাড়ি পার্কিংয়ের চর্চা এখন হরহামেশাই দেখা যায়। একটি এলাকায় যানবাহনের জন্য অবশ্যই নির্ধারিত এবং উপযুক্ত পার্কিং প্লেস থাকতে হবে।
১০। পয়ঃনিষ্কাশনে ঘাটতি
বর্ষাকালে দেখা যায়, সড়কে সড়কে ড্রেনের মুখ ভরাট হয়ে বৃষ্টির পানি আটকে পানিনিষ্কাশনের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সেই পানি উপচে সড়কে উঠে এলে চলাচলে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়।
এজন্য ড্রেনের মুখ কমপক্ষে এক ফুট চওড়া হতে হবে যেন অতিরিক্ত পানি সহজেই প্রবাহিত হতে পারে।
একটি শহরকে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, আনন্দদায়ক এবং একই সাথে টেকসই রাখা সম্ভব যদি এতে অর্গানিক উপায়ে সুপরিকল্পিত এবং সু-সংযুক্ত নেটওয়ার্ক থাকে যা তার নাগরিকদের হাঁটার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করে।
বর্তমান সময়ে শহরের অধিবাসীরা যেসব পরিবেশগত, আর্থ-সামাজিক এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তার অনেকটুকু সমাধান শহরের নকশা প্রণয়নের সময় কেবল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব।