কেন ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে কম বাসযোগ্য শহরগুলোর একটি?
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় কোনো শহরের বসাবসযোগ্যতা মূল্যায়ন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামো। বিস্ময়করভাবে, অবকাঠামো বিবেচনায় ঢাকা প্রায়ই যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর দামেস্কের কাছাকাছি অবস্থানে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে, গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকা বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত দামেস্কের চেয়ে কম স্কোর পাচ্ছে। অবকাঠামো ছাড়া বাকি বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ।
মেট্রো রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পগুলোতে প্রচুর অর্থ ঢেলেও, ঢাকা এখনো বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে বাসযোগ্যতায় নিচের দিকে অবস্থান করছে।
অবকাঠামো খাতে ইআইইউ বিবেচনা করে সড়ক যোগাযোগের মান, গণপরিবহন, আন্তর্জাতিক সংযোগ, ভালো মানের আবাসন, জ্বালানি ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং টেলিযোগাযোগ।
২০১৯ সালে অবকাঠামোতে ঢাকার স্কোর ছিল ২৬.৮ এবং দামেস্কের স্কোর ছিল ৩২.১। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে ইআইইউ এই সূচক প্রকাশ করেনি। তবে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে রহস্যজনকভাবে ঢাকা ও দামেস্কের অবকাঠামোগত স্কোর আগের মতই ছিল — ঢাকার ২৬.৮ এবং দামেস্কের ৩২.১।
দেশের নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, মানসম্পন্ন অবকাঠামোর অভাব — যা একটি মেগাসিটির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন — ঢাকার এমন অবস্থার জন্য দায়ী।
উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার প্রধান সড়কগুলো মানসম্পন্ন, কিন্তু শহরের পরিকাঠামোর পুরো চিত্র বিবেচনায় নিলে দেখা যায় এখানে ফুটপাতের অভাব, বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়ি চলে, গণপরিবহন ব্যবস্থা অদক্ষ ও ভেতরের সড়কগুলোর অবস্থা বেহাল।
স্বাস্থ্যসেবাতে ২০২৩ সালে ঢাকার স্কোর ৪১.৭। চলতি বছর ছাড়া এই বিভাগে এর আগের বছরগুলোতে দামেস্কের কাছাকাছি ছিল ঢাকার স্কোর। ওই সময় স্কোর ছিল ২০২২ সালে ২৯.২, ২০২১ সালে ১৬.৭ এবং ২০১৯ সালে ২৯.২১।
মাত্র একটি বিভাগ ঢাকার মান বাঁচিয়েছে। সেটা হলো স্থিতিশীলতা। এ বিভাগে ঢাকার গড় স্কোর ৫০ এর উপর ছিল।
ঢাকার মতো একই প্রকৃতির শহরগুলোর সঙ্গে তুলনায় দেখা যায়, বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ৬০.২ স্কোর নিয়ে দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের অবস্থান ১৪১ তম। ভারতের অন্য শহরগুলোর মধ্যে চেন্নাইয়ের স্কোর ৫৯.৯, আহমেদাবাদের ৫৮.৯ এবং বেঙ্গালুরুর ৫৮.৭। অন্যদিকে ৪৩.৮ স্কোর নিয়ে ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। তাহলে ঠিক কোথায় পিছিয়ে ঢাকা?
সহজ পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুতি
সহজ পরিকল্পনা হলো সর্বোত্তম পরিকল্পনা — এই ধারণা নিয়ে ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা তৈরি হয়। সেখানে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনা ছিল গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা, পাবলিক বাসকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ঢাকা একটি মেগাসিটি হওয়ায় প্রতিদিন অনেক লোক শহরে হেঁটে চলাফেরা করে, তাই পথচারীদের জন্য উন্নত ব্যবস্থা রাখা।
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, কিন্তু এসবের বদলে দেশে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি মেট্রোরেলের পরিবর্তে মানসম্মত গণপরিবহন এবং ফুটপাথ নিশ্চিত করি, তাহলে আমরা পরিবহন সমস্যা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারব। যেখানে মেট্রোরেলের মাধ্যমে সমাধান হয় ৬ থেকে ৭ শতাংশ।
আদিল মোহাম্মদের মতো একই বক্তব্য আরেক নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিবেরও। তিনি বলেন, বড় প্রকল্পের পরিবর্তে বোগোটা, বলিভিয়া বা অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো যা করেছে তা করা উচিত ছিল। আমাদের শহরগুলো আরও গণপরিবহন এবং ফুটপাথবান্ধব হওয়া উচিত ছিল।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর নয়
ইকবাল হাবিব ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের শহর র্যাঙ্কিং পদ্ধতিতে মৌলিক ত্রুটি আছে বলে জানান। ঢাকার মতো একটি কোলাহলপূর্ণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ শহরের সঙ্গে মেলবোর্ন বা ভিয়েনার মতো মনোরম শহরগুলোর তুলনা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইকবার হাবিব বলেন, এমন একটি দেশ খুঁজুন যেখানে ১০ শতাংশ মানুষ ১ শতাংশ জমিতে বাস করে এবং জিডিপিতে ৩২ থেকে ৩৪ শতাংশ অবদান রাখে।
তবে বিষয়টির জন্য ঢাকার ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার কারণ নেই। ইকবাল বলেন, ঢাকার বেশ কয়েকটি মৌলিক সমস্যার একটি হলো এখানে সর্বজনীন বিষয় অগ্রাধিকার কম পায়।
তিনি বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, আমাদের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য। প্রায় ১০ শতাংশ লোক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। আমি যদি ১০ শতাংশ লোকের জন্য এত বড় প্রকল্প তৈরি করি, তাহলে বাকি ৯০ শতাংশ কিন্তু এতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। যেখানে আমরা (এক্সপ্রেসওয়ের) এক শতাংশ খরচ দিয়ে ফুটপাথ-কেন্দ্রিক উন্নয়ন গ্রহণ করতে পারি। মানুষ হেঁটে শহরে ঘুরে বেড়াতে পারে।
গবেষণা মতে, শহরের প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ এক থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল করে। উপযুক্ত ফুটপাথসহ পর্যাপ্ত গাছ শহরে একটি মনোরম হাঁটার পরিবেশ দিতে পারে। তবে সবুজায়নেও ঢাকা খারাপ অবস্থায় আছে।
সবুজায়ন ও জলাশয়ের প্রতি অবহেলা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তি প্লস সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে ঢাকা উত্তরের ৪৭ শতাংশ অংশ সুবজ ছিল। ২০০২ সাল নাগাদ হয় ৩১ শতাংশ, ২০১২ সালে ১৮ শতাংশ ও ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৬ শতাংশে।
একইভাবে, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৯৯ সালে ঢাকার ১৪ শতাংশ এলাকা ছিল জলাশয়, ২০১৯ সালে যা সংকুচিত হয়ে হয়েছে ৪ শতাংশের কিছু বেশি।
২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের এক লাখ একরের বেশি জলাশয়ের মধ্যে ২২ শতাংশ হারিয়ে গেছে।
টিবিএস-এর সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকা মহানগরে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি জলাশয় সরকারী ও বেসরকারী কাজের মাধ্যমে ভরাট করা হয়েছে।
এছাড়া, রাস্তা ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে রূপগঞ্জে ৪১ শতাংশ, কেরানীগঞ্জে ২১ শতাংশ, সাভারে ১৫ শতাংশ এবং গাজীপুরে ১৭ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাশয় হ্রাস পেয়েছে। শহরের প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা ২০১৯ সালে কংক্রিট কাঠামো দ্বারা আচ্ছাদিত, যা দুই দশক আগে ছিল ৬৪ শতাংশ।
১৯৯৫ সালে তৈরি ঢাকার অবকাঠামো পরিকল্পনায়, আবাসিক এলাকাগুলোকে শিল্প এলাকা থেকে আলাদা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারী সংস্থাগুলো শেষ পর্যন্ত এলোমেলোভাবে শিল্প কারখানা তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিটি আইনে পরিবেশ ও নদী দূষণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সংস্থাগুলোর অবগতিতেই এগুলো ঘটছে।
আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, যদি ২০ বছর আগে আমরা পরিকল্পনা করতাম যে, ঢাকার কোনো পুকুর এবং খাল ধ্বংস করতে দেব না, বরং সেগুলো কেন্দ্র করে আমাদের বাকি পরিকল্পনা হবে, তাহলে আমাদের পানির চাহিদা বাড়লেও জলাশয় কমত না।
তিনি বলেন, 'আবাসন ব্যবসায়ীরা নির্বিচারে ঢাকার আশেপাশের জলাশয়গুলো ভরাট করে। এগুলো প্রতিরোধে আইন থাকলেও তারা ভরাট করে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ সবকিছুর ওপর রাজত্ব করছে।'
'সবচেয়ে' বাসযোগ্য শহর
বাসযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে থাকা ভিয়েনা, মেলবোর্ন এবং সিডনির দিকে তাকালে দেখা যায়, অবকাঠামোগত দিকে সবগুলো শহর পূর্ণ স্কোর পেয়েছে।
আর অন্যসব বিভাগে ১০০-এর কাছাকাছি স্কোর করেছে। সে হিসেবে ত্রিপোলি, লাগোস ও দামেস্কের মতো ঢাকার স্কোর শোচনীয় অবস্থা প্রকাশ করে।
ইআইউ'র মতে, শহরের 'স্থিতিশীলতা, ভালো সংস্কৃতি এবং বিনোদন, নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো, এবং অনুকরণীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা' ভিয়েনার ধারাবাহিক সাফল্যে অবদান রেখেছে।
ভিয়েনার বিশ্বমানের গণপরিবহন খাত ঈর্ষণীয়। হাঁটতে চাইলে কিংবা সাইকেল চালালে শহরের সব জায়গাতে পাওয়া যাবে দারুণ অভিজ্ঞতা। শহরের ট্রাম, মেট্রো কিংবা গণপরিবহনগুলো দক্ষ, নির্ভযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং ভিড়ও দেখা যায় কম।
ভিয়েনায় সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সামাজিক আবাসন কর্মসূচি আছে, যা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সহ বাসিন্দাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নিশ্চিত করে। এছাড়া এটি বিশ্বের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহর। ন্যূনতম বায়ু দূষণের পাশাপাশি, বেশিরভাগ লোকেরা গণপরিবহন বেছে নেয়। ভিয়েনা বিশ্বের অন্যতম সবুজ শহরও।
সুশাসনই দ্রুত সমাধান
নগর পরিকল্পাবিদদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাসযোগ্যতা সূচকের স্কোর স্থায়ীভাবে মাঝারি পর্যায়ে উন্নীত করতে দ্রুত সমাধান কী হতে পারে?
তারা বলেন, প্রথমত ঢাকার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে সবগুলো সংস্থা জবাবাদিহিতার আওতায় আসছে এবং তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে।
আদিল বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শাসন ব্যবস্থার উন্নতি করা। আমরা যদি সংস্থাগুলোকে কার্যকর করতে পারি, মানুষজনকে সম্পৃক্ত করতে পারি এবং আমাদের গ্রহণ করা পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন করি, তাহলে একটি পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, 'আমরা মনে করি, অবকাঠামোই চ্যালেঞ্জ। এটা সম্পূর্ণ ভুল। নতুন অবকাঠামোর পরিবর্তে ঢাকায় সুশাসন, সবুজায়ন বৃদ্ধি এবং প্রকৃতিভিত্তিক পরিকল্পনার কথা ভাবা উচিত।'
ইকবাল হাবিব বলেন, জনসংখ্যা বিবেচনায় ঢাকায় পর্যাপ্ত অবকাঠামো রয়েছে। তবে আমরা এই শহরে ১৮ গুণ বেশি মানুষকে বসবাসের সুযোগ দিয়েছি।
বিকেন্দ্রীকরণই সমাধান
বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকায় মানুষের আগমন কমাতে না পারলে ঢাকাকে বাঁচাতে কোনো পরিকল্পনাই যথেষ্ট হবে না।
ইকবাল হাবিব বলেন, সম্পদ কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একটি অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, খাবার ইত্যাদিতে ঢাকাই সেরা, এমন মানসিকতা পরিবর্তনে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সমগ্র জনসংখ্যা ঢাকা ধারণ করবে এই ত্রুটিপূর্ণ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। বরং জনপদের ভিত্তিতে আমাদের জনসংখ্যার সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অসীম জনসংখ্যা ধারণ করার ক্ষমতা ঢাকার নেই।