বেঙ্গল মিটের সাফল্য অনুসরণ করে বাজারে এখন বেঙ্গল ফিশও
পুকুরে মাছ চাষ থেকে শুরু করে প্রসেসিং (প্রক্রিয়াজাত) পর্যন্ত একটি নিয়ন্ত্রিত-নিরাপদ সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দিয়ে নতুন পরিচিতি তৈরি করছে বেঙ্গল মিট। প্রতিষ্ঠানটি 'মিট প্রসেসর' হিসেবে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার দীর্ঘসময় পর স্থানীয় বাজারে 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশ প্রসেসর' হিসেবেও নতুন পরিচিতি পাচ্ছে।
আমেরিকা-প্রবাসী মাজহারুল ইসলাম তার দুই বন্ধুকে নিয়ে হালাল, স্বাস্থ্যকর এবং মানসম্পন্ন 'সেইফ মিট' রপ্তানির লক্ষ্যে ২০০৬ সালে বেঙ্গল মিটের যাত্রা শুরু করেন। যদিও লোকসান গুনতে থাকায় অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ২০১১ সালে মালিকানায় আসে পরিবর্তন।
প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো করতে না পেরে স্থানীয় বাজারেই মনোযোগী হয় এবং ব্যবসাতেও ভালো করতে থাকে। এই সময়ে প্রক্রিয়াজাত গরুর মাংস বিক্রি করেই পরিচিতি পায় বেঙ্গল মিট। একে একে তালিকায় যুক্ত হয়- মুরগি, খাসির মাংস ও কিছু ফ্রোজেন ফুড।
প্রতিষ্ঠানটির নামের মধ্যে 'মিট' শব্দ থাকায় প্রথম দিককার ভাবনায় মাছের বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিতই ছিল। পাবনায় তৈরি করা প্রসেসিং ইউনিটেও শুরুর দিকে ছিল না ফিস প্রসেসিং ইউনিট, যা পরবর্তীতে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রসেসড মিটের ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়ে মাছের ভাবনা শুরু করলেও বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়।
নিরাপদ মাছ উৎপাদনকারী ও নিয়মিত সরবরাহ করার মত সোর্সিং গড়ে তুলতে না পারায় প্রসেসিং এর তালিকায় মাছ আসতে আসতেই পেরিয়ে যায় দেড় দশক।
অবশেষে ২০২১ সালের শেষে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা 'ওয়ার্ল্ড ফিশ'-এর সাথে সমন্বয় (কোলাবরেশন) করে প্রতিষ্ঠানটি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের উৎপাদিত মাছ ধীরে ধীরে বাজারে আসতে শুরু করে। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটি এখন মাছ প্যাকেটজাত করছে 'বেঙ্গল ফিশ' ব্র্যান্ড নামে।
বেঙ্গল মিটের হেড অব মার্কেটিং শেখ ইমরান আজিজ বলেন, "বিফ থেকে পোল্ট্রি, তারপর মাছ। যেহেতু আমরা নিরাপদ প্রোটিন উৎস নিয়ে কাজ করছি তাই আমাদের সোর্সিং-টা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। যে কারণে আমরা অনেক আগেই মাছ নিয়ে চিন্তা করলেও সেইফ সোর্সিং না পাওয়ায় সেটা পিছিয়ে পড়ে।"
প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে প্রায় ৫ টন মাছ নিজস্ব আউটলেট এবং অংশীদার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করছে।
মিঠা পানির মাছের মধ্যে গুলশা, বাটা, রুই, কাতলা, শিং ও পাবদা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ব্ল্যাক টাইগার প্রন, রূপচাঁদা সহ কয়েক পদের সামুদ্রিক মাছও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য তালিকায়।
নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় মানুষ যখন মাছ কাটাকুটি নিয়ে চিন্তিত, তখন বেঙ্গল মিট একেবারে সব ধরনের প্রসেসিং শেষ করে রান্নার উপযোগী মাছ ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। ফেসবুক ভিত্তিক কয়েকজন ব্যক্তি বা গ্রুপ মাছ প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করলেও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল গ্রেডে এখন পর্যন্ত বেঙ্গল মিটই প্রসেসড ফিশ বিক্রি করছে।
তবে বেঙ্গল মিটের মাছ সংগ্রহের ধরনটা একটু আলাদা। তারা তাদের নিজস্ব 'কন্ট্রাক্ট ফার্মার' ছাড়া মিঠা পানির মাছ অন্য কোনও উৎস থেকে সংগ্রহ করে না। মাছ উৎপাদনে নিরাপদ যত ধাপ রয়েছে, তার সবগুলোই একেকজন মাছচাষী পালন করেন ওয়ার্ল্ড ফিশের তত্ত্বাবধানে থেকে। নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় এসব চাষীদেরকে।
একইভাবে গরুর মাংস সোর্সিং এর ক্ষেত্রেও বেঙ্গল মিট কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের সঙ্গে কাজ করে।
বেঙ্গল মিট জানায়, মাছগুলোর বেশিরভাগেরই উৎপাদন রাজশাহী, বগুড়া, নাটোরের মতো উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকার কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের পুকুরে।
নাটোরের মাছচাষী রাজিব কুমার সরকার গত ১৮ বছর ধরে মাছ চাষ করলেও বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ফিশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেঙ্গল মিটে মাছ সরবরাহ করছেন। তিনি বলেন, "নিরাপদ ও মানসম্মত মাছ উৎপাদনে তিনটা ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। স্ট্যান্ডার্ড পুকুর, মানসম্মত পোনা ও ভালো খাবার- এগুলো হলে সেখান থেকে মানসম্পন্ন মাছ আশা করা যায়। অন্যদিকে সবসময় ভালো দাম পাওয়ার কারণেও আমরা নিরাপদ মাছ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছি।"
চাষীদের কাছ থেকে মাছ আনার পর পাবনার কাশিনাথপুরে তৈরি করা প্রসেসিং ইউনিটে এর গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। এর জন্য রয়েছে সুসংবদ্ধ ল্যাবরেটরি, যেখানে প্রয়োজনীয় সব টেস্ট করানো যায়। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখায় ল্যাবটি সম্প্রতি আইএসও সনদ পেয়েছে।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ২৫টি আউটলেট সহ ইউনিমার্ট, ঢালি সুপার শপ, আগোরা প্রভৃতিতে তাদের মাছ বিক্রি হচ্ছে। তালিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ হিসেবে রুইয়ের কথা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির বিপণন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা।
বেঙ্গল মিটের কর্মকর্তারা জানান, বাজারের লাইভ ফিশের সঙ্গে বেঙ্গল মিটের প্রক্রিয়াজাত করা মাছের দামের পার্থক্য ৩৫-৪০ শতাংশ। এর কারণ মাছের সোর্সিং, প্রসেসিং ও সাপ্লাই চেইনের কারণে বাড়তি একটা খরচ রয়েছে।
শেখ ইমরান আজিজ টিবিএসকে বলেন, "বাজার থেকে এক কেজি রুই মাছ কিনলে প্রসেস করার পর ১৫০-২০০ গ্রাম কমবে। কিন্তু বেঙ্গল ফিশের ১ কেজি মানে প্রসেস করার পরের এক কেজি। এই বাইরে প্রসেসিংয়ের একটা খরচ রয়েছে।"
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা ভ্যারাইটি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। সেফ প্রডাকশন না পেলে ভ্যারাইটি বাড়ানোর সুযোগ নেই। তবে যেটুকু বাজারে সরবরাহ করছি, সেটা থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি।"
জানা যায়, বেঙ্গল মিট তাদের মোট প্রক্রিয়াজাতকৃত গরুর মাংসের ৮০ শতাংশ স্থানীয় মার্কেটে এবং ২০ শতাংশ রপ্তানি করছে। মাছ রপ্তানির চিন্তা থাকলেও এখনই সে দিকে মনোযোগ দিতে চায় না প্রতিষ্ঠানটি।
শেখ ইমরান আজিজ বলেন, "স্থানীয় মার্কেটে আমাদের মাছের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা পূরণে আমাদের আরও অনেক কাজ করার রয়েছে। রপ্তানির চিন্তা থাকলেও সেটা এখনই নয়।"
জানা যায়, নতুন উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতার অভাব, ঋণ সুবিধা পেতে পর্যাপ্ত কোলেটারেল (জামানত) না থাকা, স্থানীয় বাজারে মাংসের দাম রপ্তানিমূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় যাত্রা শুরুর পর থেকেই টানা কয়েক বছর লোকসান গুনতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
টিকে থাকতে বারবার ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করেও একে স্থিতিশীল করা যায়নি। ২০১১ সালে বেঙ্গল মিটে বিনিয়োগ করে এনভয় গ্রুপ। এ সময় নতুন ও পুরনো পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং সমপর্যায়ে এনে রপ্তানি বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারকেও প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে ব্যবসার ধরন পাল্টে যাত্রার প্রায় এক যুগ পর এসে লাভের মুখ দেখে প্রতিষ্ঠানটি।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রসেসিং ইউনিট সহ প্রায় ৭০০ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে।