বেঙ্গল মিট: এনভয়ের সঙ্গে মিলে দীর্ঘদিনের লোকসানি প্রতিষ্ঠান এখন আলো ছড়াচ্ছে
তাজা, হালাল, স্বাস্থ্যকর এবং মানসম্পন্ন 'সেইফ মিট' রপ্তানির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিল বেঙ্গল মিট। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব, ঋণ সুবিধা পেতে পর্যাপ্ত কোলেটারাল না থাকা, স্থানীয় বাজারে মাংসের দাম রপ্তানিমূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় শুরু থেকে লোকসান গুণতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
এ অবস্থায় ২০১১ সালে বেঙ্গল মিটে বিনিয়োগ করে এনভয় গ্রুপ। এ সময় নতুন ও পুরনো পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং সমপর্যায়ে এনে রপ্তানি বাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারকেও প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে ব্যবসার ধরন পাল্টে যাত্রার প্রায় এক যুগ পর এসে লাভের মুখ দেখে প্রতিষ্ঠানটি।
এখন বেঙ্গল মিটের লক্ষ্য এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ভালো একটি 'ব্যালেন্স শিট' তৈরি করা এবং কোম্পানিকে টেকসই করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা।
বেঙ্গল মিটের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোভিডের আগেই আমরা লোকসান কাটিয়ে লাভে এসেছি। তবে প্যান্ডেমিকের সময় তা আবারও কিছুটা নিম্নমুখী হলেও এখনও লাভের ধারাতেই অব্যাহত আছে।'
তিনি বলেন, 'স্থানীয় বাজারকে প্রাধান্য দেয়া, বাজারের ট্রেন্ড অনুযায়ী নতুন নতুন পণ্য সংযোজন আমাদের ব্যবসাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে গেছে। একইসঙ্গে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে সুনাম তৈরি হয়েছে।
আমেরিকা-প্রবাসী মাজহারুল ইসলাম তার দুই বন্ধুকে নিয়ে তাজা, হালাল, স্বাস্থ্যকর এবং মানসম্পন্ন 'সেইফ মিট' রপ্তানির লক্ষ্যে ২০০৬ সালে শুরু করেছিলেন বেঙ্গল মিটের। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব, ঋণ সুবিধা পেতে পর্যাপ্ত কোলেটারাল না থাকা, স্থানীয় বাজারে মাংসের দাম রপ্তানিমূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ায় শুরু থেকে লোকসান গুণতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর বেঙ্গল বিদেশি ক্রেতাদের জন্য পাইকারি মাংস উৎপাদন করতে থাকে।
টিকে থাকতে বারবার ঋণের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করেও প্রতিষ্ঠানটিকে স্থিতিশীল করা যায়নি। অবশেষে এনভয় গ্রুপ বিনিয়োগ করার পর লাভের ধারায় ফেরে বেঙ্গল মিট।
গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, রিয়েল এস্টেট, ও ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে ৪০টি ব্যবসা আছে এনভয় গ্রুপের। শিল্পগোষ্ঠীটির বার্ষিক টার্নওভার ৪০০ মিলিয়ন ডলার, কর্মীসংখ্যা প্রায় ২১ হাজার।
এনভয় গ্রুপ মালিকানায় আসার পর বেঙ্গলে বেশ কিছু বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তনগুলো কাজে আসে, ধীরে ধীরে লাভের মুখ দেখতে থাকে বেঙ্গল মিট। বর্তমানে বেঙ্গলের ৮০ শতাংশ পণ্য জেলা-স্তরের ৪০টি আউটলেটের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। আর ২০ শতাংশ পণ্য দুবাই, মালদ্বীপ ও কুয়েতে রপ্তানি হয়।
বেঙ্গল মিট এখন গরুর মাংস, খাসি, মুরগি ও অন্যান্য পাখির মাংস (হাঁস, কবুতর, কোয়েল) উৎপাদন ও বিক্রি করে। তরকারির জন্য ব্যবহৃত সাধারণ মাংসের পাশাপাশি স্টেকের মাংস, প্রক্রিয়াজাত মাংস, রেডি টু কুক-মেরিনেটেড মাংস, হিমায়িত স্ন্যাকস, কোল্ড কাট এর প্রধান পণ্য।
বর্তমানে বেঙ্গল মিট প্রতি বছর ৪০০ টন 'সেইফ মিট' উৎপাদন করছে, যা দেশে ও বিদেশে বিক্রি করা হয়।
কার্যক্রম বাড়ানোর অংশ হিসেবে বেঙ্গল এখন ওয়ার্ল্ডফিশ-এর সঙ্গে কাজ করছে এমন চাষিদের কাছ থেকে মাছ সোর্সিং করা শুরু করেছে। শিগগিরই মুরগির উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করছে কোম্পানিটি।
বেঙ্গলের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণ মাংসের তুলনায় সেইফ মিটের উৎপাদন খরচ ১০-১৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু তারপরও বাজারে সাধারণ মাংসের দাম বিবেচনায় 'সেইফ মিট'কেও ক্রেতার নাগালে রাখতে হয়।
ধাক্কা কাটিয়ে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াল বেঙ্গল মিট
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করলেও নানা বিপত্তিতে পড়তে হয় বেঙ্গল মিটকে। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তিগত উন্নয়নেই বেশিরভাগ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। জামানতের অভাবে ঋণ না পাওয়া, বিদেশি মানদণ্ড মেনে পণ্য প্রক্রিয়াজাত করলেও রপ্তানিতে নানা জটিলতা তৈরি হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি কোম্পানিটি।
তবে উদ্যোক্তা মাজহারুল ইসলাম হাল ছাড়েনি। মালয়েশিয়া, দুবাই ও অন্যান্য দেশ থেকে সম্ভাব্য ক্রেতাদের নিয়ে এসে তাদেরকে দেখান কীভাবে মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। কোম্পানি যখন লোকসান দিচ্ছিল, তখনও তিনি মাংস প্রক্রিয়াকরণের মান বজায় রাখতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে নিয়োগ দেন।
২০১৪ সালের পর উদ্যোক্তাদের কয়েকজন বেঙ্গল মিট থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু তারপরও মানের সঙ্গে আপস করেননি মাজহারুল ইসলাম। বরঞ্চ নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করেন।
অবশেষে নতুন বিনিয়োগকারী পেয়ে যান মাজহারুল। ইন্দোনেশিয়া থেকে হালাল সনদ জোগাড় হয়েছে। এখন নতুন বিনিয়োগকারীরাই প্রতিষ্ঠানটির দেখভাল করছে।
বেঙ্গল মিটের মাংসকে 'সেইফ মিট' বলার কারণ
বেঙ্গল মিটের কর্মকর্তারা জানান, 'সেইফ মিট' নিশ্চিত করার জন্য তাদের পশুকে চাপমুক্ত পরিবেশে পালন করানো হয়। এর জন্য পশুর জন্য যেখানে হয়, সেখানেই তার পালন ও প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। এ প্রক্রিয়ার মূলমন্ত্র হলো, 'ক্যারি দ্য মিট, নট অ্যানিম্যাল'। অর্থাৎ শুধু মাংস স্থানান্তর করা যাবে, পশু নয়। কারণ যেকোনো ভ্রমণ ও পরিবেশ পরিবর্তনেই পশুর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এতে পশুর শরীরে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা মাংসের মানে প্রভাব ফেলে।
বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এএফএম আসিফ বলেন, 'বেঙ্গল মিটের শুরুটা হয়েছিল শুধু রপ্তানির উদ্দেশ্য নিয়ে। যে কারণে প্রসেসিং ইউনিটটিও তৈরি করা হয় সেই স্ট্যান্ডার্ডে। যেখানে গরু সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে মাংস বিক্রি পর্যন্ত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।'
তিনি জানান, প্রাথমিক অবস্থায় বাহ্যিকভাবে পশুর কোনো রোগবালাই আছে কি না, তা দেখা হয়। এরপর পশু জবাই করার পর ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঝুলিয়ে রাখার পর পশু চিকিৎসক পরীক্ষা করে ক্লিয়ারেন্স দিলে তবেই মাংস কাটাকাটি শুরু হয়। পশু চিকিৎসকদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল সাপ্লায়ারকে গরুর দাম দেওয়া হয়।
চাপ কমানো, জীবাণুমুক্ত করাসহ কিছু কাজ বেঙ্গল মিট করে কন্ট্রোল এনভায়রনমেন্টের মধ্যে। এ সময় চিলিং এরিয়ার মধ্যে পশুকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। এরপর কসাইরা যখন কাজ করবে, সেই পরিবেশের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়া যাবে না।
পশু জবাই করার পর মাংস জীবাণুমুক্ত করে প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করা হয়। এজন্য কারখানা এবং বিক্রয়কেন্দ্রে সবসময় নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়, যাতে মাংসের পুষ্টি উপাদান ঠিক থাকে।
আসিফ বলেন, খামারিরা এখন মান ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে অনেক সচেতন। 'তারা আমাদেরকে বিশ্বাস করে।' এছাড়াও বেঙ্গল মিট সারা বছর গরু নেবে, এই বিশ্বাস থেকেই অনেক তরুণ উদ্যোক্তা গরু পালন করছেন বলে জানান তিনি।
মাংসের শক্তি
বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তারা কারখানা স্থাপনের জন্য গবাদিপশু পালনে প্রসিদ্ধ পাবনা অঞ্চলকে বেছে নেন। সেখানেই প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের পাশাপাশি ৩০ একর জমিতে শুধু উন্নতমানের ঘাস উৎপাদন ও গবেষণা চলছে।
বেঙ্গল মিট শুরুর দিকে বেপারিদের মাধ্যমে গরু সংগ্রহ করত। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরু নিয়ে আসত। কিন্তু এখন তৃণমূল পর্যায়ের খামারিরাই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট সময় পরপর গরু দিয়ে যান।
কোম্পানিটির সাপ্লাই চেইনে এখন ১ হাজারের বেশি খামারি রয়েছেন। সারা বছর ধরে তারা বেঙ্গল মিটের চাহিদার প্রায় অর্ধেক গরুর জোগান দেন। আর বেঙ্গল মিটের নিজস্ব খামারে সবসময় ৫০০ থেকে ১ হাজার গরু থাকে।
বেঙ্গলের সিইও আসিফ বলেন, 'খামারিরা জানে আমরা বেশি টাকা দেব না, তবে মিনিমাম লাভটা দেব এবং এটা গ্যারান্টেড। হঠাৎ করে মার্কেট অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে, ওই টাকাও আমরা দিই না। আবার বাজার পড়ে গেছে, তা আমরা বিবেচনায় নিই না । এমনভাবে কস্টিং করি, যাতে খামারির লাভটা থাকে। কারণ আমি তার কাছ থেকে সবসময় গরু নিচ্ছি, তাই তাদের পাশে আছি।'
গরু বাছাইয়ের জন্য একসময় প্রচুর শ্রম দিতে হলেও সে কাজ এখন অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। কারণ যারা গরু সরবরাহ করে, তাদের সবাইকে বেঙ্গল মিটের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশনা অনুযায়ী গরু পালন করে তারা।
এছাড়াও খামারিদের সহায়তা করতে এবং নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে খামারি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ও বেঙ্গল মিট একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে আইপিডিসি থেকে খামারিরা ঋণ পান এবং সেই ঋণ পরিশোধে গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করে বেঙ্গল মিট।
আসিফ বলেন, 'আমাদের ওপর ভরসা করেও এখন অনেক খামার তৈরি হচ্ছে। কারণ এখানে বিশ্বাসের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। আমাদের লেনদেন নিয়ে কোনো টেনশন করতে হয় না।'
তিনি জানান, তাদের কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা পশুর ছয়টি বায়ুবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করছে।
বেঙ্গল মিটের পরিশোধিত মূলধন ১১৬ কোটি টাকা হলেও বর্তমানে এর ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। বেঙ্গল মিটে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-র মতো লোক চাকরি করছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বেঙ্গল মিট কি কেবল অভিজাতদের জন্য?
বেঙ্গল যখন স্থানীয় বাজারে মনোযোগ দেয়, তখন তাদের লক্ষ্যবস্তু করে পাঁচ তারকা হোটেলগুলোকে। এই হোটেলগুলো রেড মিট আমদানি করত। সেই আমদানির বিকল্প হয়ে দাঁড়ায় বেঙ্গল মিট। অনেক হোটেলই এখন তাদের কাছ থেকে মাংস নেয়।
কিন্তু খুচরা মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে গ্রাহক বাড়ানো এখনও চ্যালেঞ্জিং বলে জানান আসিফ।
তিনি বলেন, 'সেইফ মিট উৎপাদনের জন্য যে বাড়তি খরচ হয় এটা সবাই পরিশোধ করতে চায় না, যখন দেখে বাসার পাশেই ৬০-৭০ টাকা কম দামে মাংস পাওয়া যাচ্ছে।' এছাড়াও কোল্ড-চেইন রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক বেশি বলে জানান আসিফ।
এই বাধা দূর করতে সাশ্রয়ী খরচে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আনতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে বেঙ্গল মিট।
এছাড়াও অনেক নীতিগত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বলেও জানায় বেঙ্গল মিট। তারা যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে যায় তখন তাদের প্রক্রিয়াজাতকারক হিসেবে দেখা হয়, খামারি হিসেবে নয়। এর ফলে তাদেরকে সুদ দেওয়া হয় প্রক্রিয়াজাতকারক হিসেবে, চাষি হিসেবে নয়। কিন্তু বেঙ্গল মিটের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি তৃণমূল পর্যায়ের খামারিদের একটি বর্ধিত সংস্করণ।
বেঙ্গলের জন্যে আরেকটি সমস্যা হলো বাজারে গরুর মাংসের নামে চলতে থাকা ভারতীয় মহিষের মাংস। এই মাংস গরুর মাংসের তুলনায় সস্তা এবং এর প্রধান ক্রেতা রেস্তোরাঁগুলো।
ভারতীয় গরু আসা বন্ধ না হলে এবং গরুপালন কমে গেলে পুরো শিল্পেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ কারণে হিমায়িত বাফেলো আমদানিতে কড়াকড়ি করার দাবি জানায় বেঙ্গল মিট।
আসিফ বলেন, 'শেয়ারহোল্ডার ও অর্থদাতারা ইমোশনালি জড়িত থাকায় বেঙ্গল এখনও টিকে আছে। নইলে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যয়ের কারণে অনেক আগেই তাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল।'