বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ান ভিএফএক্স শিল্পী আরমানের হলিউডে পৌঁছানোর গল্প
গত বছরের শেষ দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত, মার্ভেল স্টুডিওর ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র 'স্পাইডারম্যান: নো ওয়ে হোম' ছিল দর্শকদের জন্য এক নস্টালজিয়াপূর্ণ আনন্দের খোরাক। এমনকি কেউ কেউ এও দাবি করেন, কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াল থাবায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলচ্চিত্র শিল্প যখন মুখ থুবড়ে পড়ার পথে, তখন স্পাইডারম্যান সিরিজের সিনেমাই এই খাতকে রক্ষা করেছে।
'স্পাইডারম্যান: নো ওয়ে হোম' নিশ্চয়ই এতদিনে প্রচুর বাংলাদেশি দর্শকেরও দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু রূপোলি পর্দার আড়ালের কলাকুশলীদের আমরা কজনই বা চিনি! এদেরই একজন ছিলেন আরমান হক, যার শেকড় রয়ে গেছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক আরমান হকের একজন ভিএফএক্স শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প শুনতে তার সাথে আলাপচারিতায় মেতেছিল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
২৫ বছর বয়সী আরমান হক ভিএফএক্স ও অ্যানিমেশন শিল্পে পারদর্শী একজন মেলবোর্নভিত্তিক লাইটিং আর্টিস্ট। মোরাল স্টুডিওস নামের একটি স্বতন্ত্র অ্যানিমেশন স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরও তিনি। এই স্টুডিওর লক্ষ্য হলো, অনুপ্রেরণাদায়ক, শিক্ষামূলক ও বিনোদনধর্মী গল্প বলার মাধ্যমে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটানো।
স্পাইডার-ম্যান এর মতো একটি হাই-বাজেটের ফ্র্যাঞ্চাইজি যে অপেশাদার কাউকে বেছে নিবে না, সে তো বলাই বাহুল্য। তাই আরমান হকেরও ইতোপূর্বে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আরমান বলেন, "আমার করা কিছু প্রিয় প্রজেক্টের মধ্যে রয়েছে- জুমানজি: দ্য নেক্সট লেভেল, সামনে মুক্তি পাবে ফেংসেন ট্রিলজি এবং পিটার র্যা বিট ২। এছাড়া কোকা-কোলার কিছু বিজ্ঞাপনে কাজ করেও মজা পেয়েছি, এর মধ্যে ছিল তাদের মাসকট আফু এবং আজিয়াও।"
গল্প বলতে এবং গল্প বলার জন্য নতুন নতুন সৃজনশীল ও প্রযুক্তিগত উপায় উদ্ভাবন করতে ভালোবাসেন আরমান হক। এর বাইরে আর্চারি এবং ঘোড়ায় চড়া তার প্রিয় শখ। এমনকি অবসর সময়ে একজন আর্চারি ইনস্ট্রাক্টর হিসেবেও কাজ করেন তিনি।
"আমার যতদূর মনে পড়ে, আমার অনেক আগে থেকেই শিল্প-কলা ও নকশার প্রতি আগ্রহ ছিল। মার্ভেলের প্রথম দিককার ঘোস্ট রাইডার এবং আসল স্পাইডারম্যান ট্রিলজি দেখেছিলাম আমি। পর্দায় সেসব ছবির অসাধারণ ইফেক্টের কাজ দেখে মুগ্ধ হতাম আমি, জানতে চাইতাম কিভাবে একটা চরিত্রের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বা ভিলেনের মাথা বালু দিয়ে তৈরির দৃশ্য দেখানো হচ্ছে!", বলেন আরমান।
মাত্র ১২ বছর বয়সে নিজের প্রথম থ্রিডি সফটওয়্যার: থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স ডাউনলোড করেন আরমান হক। সেসময় বইপত্র ধার করে এবং এবং অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখে সফটওয়্যারের জন্য কাজ শিখতেন তিনি।
"সেসময়ই আমি আমার দক্ষতাকে আরো জোরদার করার সুযোগ পেয়েছি এবং ধীরে ধীরে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছি", বলেন এই শিল্পী।
তবে শুরুর দিকে লাইটিং বা আলোর কাজের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না আরমান। সেসময় বিভিন্ন শো এবং গেমসের জন্য চরিত্র ও আবহ তৈরি করতে পছন্দ করতেন তিনি। বছর দুয়েক যাবত ভিএফএক্সের কাজে যুক্ত থাকার পর তিনি বুঝতে পারেন, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট তৈরিতে লাইটিং এর গুরুত্ব কত বেশি!
আরমানের ভাষ্যে, "এই বিষয়ে কাজ করতে শুরু করার পর আমি বুঝতে পারলাম, ফাইনাল লুকের ক্ষেত্রে আলোর সঠিক ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পুরো প্রক্রিয়ায় লাইটিং একটা মজার অংশও বটে। এ পর্যায়ে গিয়েই আপনি প্রথমবারের মতো পুরো শটটা ফুটিয়ে তুলতে দেখবেন। আর এ প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তির মধ্যে একটা দারুণ ভারসাম্য বজায় থাকে।"
স্পাইডার-ম্যানের সর্বশেষ চলচ্চিত্রে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের ব্যবহারকে বিশ্বসেরা বলা যায়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে একজন ভিএফএক্স বিশেষজ্ঞ নিজেই একজন শিল্পী, যিনি যেকোনো ডিস্টোপিয়ান গল্পকে বাস্তব রূপে প্রকাশ করতে পারেন। স্পাইডার-ম্যানই আরমানের প্রথম মার্ভেল চলচ্চিত্র, তাই এরকম প্রতিভাবান দলের সাথে কাজ করতে পেরে ভীষণ আনন্দিত ছিলেন তিনি। এ অনুভূতিকে এক কথায় 'স্বপ্নের মতো' বলে আখ্যা দেন তিনি।
"স্পাইডার-ম্যানের মতো একটি গল্প যার জন্য বিশ্বের এত এত মানুষ অপেক্ষায় ছিল এবং এত মানুষ ছবিটি ভালোবেসেছে, সেখানে বড় পর্দায় আমাদের টিমের কঠোর পরিশ্রমের প্রতিফলন দেখতে পারাটা ছিল অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি। এরকম একটি প্রজেক্টে কাজ করা মানে অসংখ্য সমস্যার সমাধান করা এবং নতুন নতুন কাজ শেখা", বলেন আরমান।
স্পাইডার-ম্যান চলচ্চিত্রে কাজ করার পাশাপাশি আরমান লুমা পিকচারস এর সাথেও যুক্ত আছেন। মার্ভেল ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে দীর্ঘদিনে সম্পর্ক রয়েছে লুমা পিকচারস এর এবং মেলবোর্নভিত্তিক সেরা ভিএফএক্স স্টুডিওগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। লুমা পিকচারস এর লাইটিং টিম এই প্রজেক্টে কাজ করার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দক্ষ শিল্পীদের এনে এক ছাদের তলায় জড়ো করে।
"আমাদের শুধু যে অস্ট্রেলিয়ার শিল্পী ছিল তা নয়। দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইতালি এবং অন্যান্য দেশ থেকে আগত শিল্পীরাও ছিল এই দলে", বলেন আরমান।
তিনি আরো যোগ করেন, "যেসব চলচ্চিত্র এবং টিমের সাথে আমি কাজ করেছি, এর সবগুলোই আমার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। কঠিন কঠিন বা চ্যালেঞ্জিং শটগুলোর ক্ষেত্রে আমার সুপারভাইজার প্রায়ই আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন। আমাদের টিমওয়ার্ক খুব ভালো ছিল এবং অনেক সহায়তা পেয়েছি।"
আরমানের বাবা একজন বাংলাদেশি; মূলত ঢাকাতেই ছিল তার পরিবার। তিনি বলেন, "আমি বেড়ে উঠেছি একজন মুসলিম হিসেবে এবং সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির চমৎকার সব খাবার আর পোশাকও ছিল এর অংশ।"
২০০৪ সালে মামার বিয়ে উপলক্ষে শেষবার বাংলাদেশে এসেছিলেন আরমান। এরপর তার সব আত্মীয়স্বজনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন।
"আমার পরিবারের সবাই-ই বিদেশে চলে এসেছে, আমি প্রায়ই তাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে যাই। তবে বাংলাদেশে যেতে পারলে আমার খুবই ভালো লাগবে।"
একজন এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে কাজ করা তার ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা জানতে চাইলে আরমান বলেন, "আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে এশিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িনি। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে।"
তবে আরমান স্বীকার করলেন, বিদেশে টিকে থাকতে গিয়ে অনেক অভিবাসীকেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তার প্রত্যাশা, তারাও যেন নিজেদের প্রাপ্য সুযোগটুকু পায়।
আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে এসে নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানালেন আরমান হক।
তিনি বলেন, "আসন্ন হলিউড চলচ্চিত্র 'থর: লাভ অ্যান্ড থান্ডার'-এ আমার কাজ দেখতে পাবেন আপনি। অ্যানিমেশন সম্পর্কিত প্রজেক্টে আরো বেশি কাজ করার কথা ভাবছি আমি। এছাড়া আরো দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাই নিজের কাজের ক্ষেত্রে। সুযোগ পেলে একদিন নিজের অ্যানিমেটেড প্রজেক্ট প্রযোজনা করার ইচ্ছাও আছে।"