মঙ্গলে মানব বসতি: কল্পনা নাকি ভবিষ্যৎ?
এলিসা কারসন। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই কিশোরী প্রস্তুত হচ্ছেন সেই ছোটবেলা থেকে। স্বপ্নের লাল গ্রহ মঙ্গলে যাবেন তিনি। শুধু এলিসাই নন, মঙ্গলে বসতি স্থাপনের কল্পনা যুগ যুগ ধরে দেখে এসেছেন পৃথিবীর বহু জ্ঞানী-গুণী। সাধারণ মানুষের মধ্যেও মঙ্গল গ্রহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কেন? কেন মঙ্গল নিয়ে মানুষের মধ্যে এতো বাড়তি আগ্রহ? এর শুরুই বা হয়েছিলো কবে? বুধ, শনি বা বৃহস্পতি নয়, কেন মার্স নিয়েই এতো এত গল্প, কবিতা আর চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে?
চলুন না, আজ মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে মানুষের কর্মকান্ডগুলোর উপরে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক!
মঙ্গল নিয়ে জল্পনা
মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে যে ভাবনা মানুষের মনে, তার শুরু খুব একটা আগে হয়নি। ১৮৭৭ সালের কথা। ইতালিয়ান জ্যোতির্বিদ জিওভানি শিয়াপারেলি সেবার গ্রহটিকে প্রথম বিভক্ত করেন তিনটি স্থানে। নাম দেন যথাক্রমে লাইসিয়াম, এডেন এবং ইউটোপিয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, মঙ্গল গ্রহের উপরিভাগে সমুদ্র ও প্রকৌশলবিদ্যায় দক্ষ একদল প্রাণের তৈরি খাল খুঁজে পাওয়া যাবে।
জিওভানির চিন্তাকেই আরো একটু সামনে এগিয়ে নিয়ে যান অ্যারিজোনার জ্যোতির্বিদ পারসিভাল লোয়েল। ১৮৯৫ সালে তিনি জানান যে, মঙ্গলে বিস্তৃত সেচ ব্যবস্থা তৈরি করেছে এমন প্রাণীকে খুঁজে বের করতে পারবেন তিনি। খুব দ্রুতই এই চিন্তাগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে এডগার রাইস বারোসের লেখা জন কার্টার উপন্যাসটি এই চিন্তাকে আরো নাড়া দেয়। উপন্যাসে এমন একটি টাইম পোর্টালের কথা লেখা হয় যেটি পৃথিবী ও বারসুম বা মঙ্গল গ্রহের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই উপন্যাসেরই দ্বিতীয় কিস্তি 'দ্যা গডস অব মার্স(১৯১৪)'-তে মঙ্গল গ্রহের সমুদ্র ও সমুদ্রতটের কথা বলেন তিনি। তবে এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে, লেখক এডগারের কল্পনার মঙ্গল গ্রহ ছিল প্রায় পৃথিবীরই মতো। মঙ্গলের প্রাণীরা কীভাবে নিজেদের গ্রহের উপরিভাগের পানির উৎসকে লুকাচ্ছে, সেটা নিয়েও যুক্তি দেখিয়েছিলেন তিনি। একইসাথে উপত্যকা, বন ইত্যাদি নিয়েও কথা বলেন তিনি।
মানুষের দ্বিতীয় বাড়ি
১৯৬০ সালে মঙ্গলে জীবন আছে ধারণা করা হয়। মানুষ এরপর থেকে সবসময়ই মঙ্গলে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখলেও, ১৯৬৫ সালে 'ম্যারিনার ৪' মঙ্গল ঘুরে পৃথিবীতে এসে নতুন তথ্য জানায়। সেই তথ্যানুসারে, মঙ্গল একটি ধাতব ও প্রাণহীন গ্রহ। এডেন থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এই গ্রহকে শীতল নরকের সাথেও তুলনা করা হয়।
ঠিক এরকমই প্রাণহীন এক গ্রহকে দেখানো হয় ২০১১ সালে, অ্যান্টি উইরের 'দ্যা মার্শিয়ান'এ। সেখানে বেঁচে থাকাটাও ছিল চলচ্চিত্রের নায়কের জন্য অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ। অক্সিজেনেটর ভেঙ্গে গেলে তার মৃত্যু হবে, পৃথিবী থেকে নিয়ে আসা পানির উৎস না থাকলে মৃত্যু হবে, মার্স ল্যান্ডার হ্যাবিটেন্ট ভেঙ্গে গেলে নায়ক বিস্ফোরিত হবে। আর যদি এর কোনটাও না হয়, তাহলেও একটা সময় ক্ষুধার যন্ত্রণায় মৃত্যু হবে তার।
তবে এতকিছুর পরেও মঙ্গল গ্রহ ও সেখানে বসতি গড়া নিয়ে ভাবনা থামেনি মানুষের। কিম স্ট্যানলি রবিনসনের ১৯৯০ সালে লেখা 'রেড মার্স', 'গ্রিন মার্স' এবং 'ব্লু মার্স' বা 'মার্স ট্রিলজি'তে খুব নিশ্চিতভাবে ২০২৬ সালে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের কথা বলা হয়। সেখানে মানুষের বসবাসের জন্য টেরাফর্মিং ও অক্সিজিনেটেড আবহাওয়ার কথা বলা হয়। একই মঙ্গলকে নিয়ে লেখা হলেও নতুন গ্রহে মানুষ কিভাবে নতুন করে থাকবে সেটা নিয়ে নতুন ধারণা প্রদান করেন লেখক।
উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের পালা শেষ করে বাস্তবে বিখ্যাত আবিষ্কারক এবং উদ্যোক্তা ইলন মাস্কও ইতিমধ্যেই মঙ্গল গ্রহে ৮০,০০০ মানুষের এক বসতি স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। এ যেন অনেকটা রে ব্রাডবারির লেখা ১৯৫০ সালের উপন্যাস 'দ্যা মার্শিয়ান ক্রনিকলস'এর মতো। এই বইয়েও লেখক পৃথিবী থেকে মঙ্গলে স্থানান্তরিত আংশিক কিছু জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন। তবে সেই জনগোষ্ঠীকে মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দারা মেরে ফেলেছিল এবং একইসাথে মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দারাও এক মহামারীতে মারা যায়। পরবর্তীতে সেখানে বসতি গড়ে নতুন এক প্রজন্ম।
মঙ্গল গ্রহ আসলেই কেমন হবে, সেখানে কখনো মানুষ বসতি গড়তে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে এখনো। তবে যদি 'লাইসিয়াম' বা 'ব্লেড রানার'এর কথানুযায়ী ভবিষ্যতের পৃথিবী বদলে যায়, সেক্ষেত্রে নতুন এক ঘরের সন্ধান করাটা যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!