টিকাদান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কোভিড বিলিয়নিয়ারদের প্রাচুর্য উবে যাচ্ছে
স্বাস্থ্য সেবা খাতে করোনাভাইরাস মহামারি অনেক ধনী ব্যবসায়ীকে বিপুল সম্পদশালী করে তোলে। তবে, যত দ্রুত এই স্ফীতি এসেছিল, নানান দেশের টিকাদানে সঙ্গে গতি আসার সঙ্গে সঙ্গে- ঠিক ততো দ্রুতই তা অদৃশ্য হচ্ছে।
কোভিড টেস্ট কিট প্রস্তুতকারক সিজেন ইঙ্ক এবং সাবকিউটেনাস ইঞ্জেকশন প্রযুক্তির সরবরাহক অ্যালটিউজেন ইঙ্ক এমন দুটি বড় কোম্পানির আদর্শ উদাহরণ। গেল বছর পুঁজিবাজার মূল্যায়ন বাড়ায় কোম্পানি দুটির প্রতিষ্ঠাতারা বিলিয়নিয়ারে পরিণত হন। তারপর অবশ্য টিকাদানে গতি আসার সাথে সাথে উভয় সংস্থার শেয়ারমূল্যে দেখা দেয় ৪১ শতাংশের নাটকীয় পতন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স সূত্র সৌভাগ্যের এই অবনতি নিশ্চিত করে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে মালয়েশিয়ার গ্লাভস প্রস্তুতকারকদের ক্ষেত্রে। এই শিল্পে গেল বছরের আগস্ট নাগাদ উদয় হয় নতুন পাঁচ বিলিয়নিয়ারের। বিশেষ করে, পৃথিবীময় কোভিডের কারণে সুরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদা বাড়ায় ব্যাপক কাটতি ছিল তাদের পণ্যের। তবে গেল মাসে খুচরা বাজারে সুরক্ষা সরঞ্জামের বিক্রি বাড়া সত্ত্বেও মালয়েশিয় গ্লাভস প্রস্তুতকারক শিল্প প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূল্য ৪০ শতাংশ কমেছে। সঙ্গে উধাও হয়েছে কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতাদের অর্জিত ৯শ' কোটি ডলারের ঐশ্বর্য।
এদিকে ফাইজার ইঙ্ক, বায়োএনটেক এসই এবং মডের্না ইঙ্কের মতো টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর বাজার উত্থানে যারা বিলিয়নিয়ার হয়েছিলেন; তাদের অনেকেই সম্পদমূল্য ধরে রাখতে সমর্থ হলেও, সিংহভাগের ভাগ্য ততোটা প্রসন্ন হয়নি। ঘটনাটি পুঁজিবাজার আকস্মিক দর নির্ধারণের চাঞ্চল্যকে নির্দেশ করে। এর মধ্য দিয়ে, মহামারির অস্থির সময়ে মূলধনী বাজারেও যে আকস্মিক স্ফীতি ও সংকোচনের মধ্যে দিয়ে যায়, সেটাই যেন উঠে এসেছে। কিছু কোম্পানির শেয়ারমূল্য মাত্র একদিনের ব্যবধানে লক্ষ্য করেছে ২০ শতাংশ উত্থান বা পতন। এই সুযোগে অবশ্য অনেক কোম্পানির পরিচালক আরও শেয়ার কিনে সংস্থায় নিজের অংশীদারিত্ব বা নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সফল টিকাদান কর্মসূচির কারণে মহামারির অচলাবস্থা দূর হওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসা ও সুরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদাও কমতে থাকবে। ফলে কোভিড বিলিয়নিয়ার খ্যাত নতুন ধনীরাও প্রভাবিত হবেন।
"পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে ওঠা মাত্র টেস্ট কিট বা জৈব প্রযুক্তির আকস্মিক চাহিদার মাধ্যমে তৈরি হওয়া সম্পদ আগামীদিনে আর বাড়বে বলে মনে হয় না," বলেন দ. কোরিয়ার সিউল ভিত্তিক বাণিজ্যিক সংস্থা পর্যবেক্ষক সিইওস্কোর- এর প্রেসিডেন্ট পার্ক জু-গান। অবশ্য, তিনি মনে করেন মহামারির সময় তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক পরিষেবার যে প্লাটফর্মগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাদের নির্বাহীরা আরও ধনী হবেন।
বাস্তবতা এটাই, টিকা বদলে দিচ্ছে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট শিল্পের বাস্তবতা। বিশেষ করে, উন্নত দেশে হাসপাতাল ব্যবস্থায় রোগীর চাপ কমামাত্র দূর হবে স্বাস্থ্য সরঞ্জামের আধিপত্য। ইতোমধ্যেই, তা দেখাও যাচ্ছে বাজার মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে।
মহামারির প্রথম দিকে পুরো বিশ্বেই ছিল; টেস্ট কিট, সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং নানা প্রকার ওষুধের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন। যার সুবাদে সিজেন, অ্যালটিউজেন এবং টপ গ্লাভ কর্পের মতো কোম্পানি তাদের ব্যবসা জোরদার করার সুযোগ পায়।
গেল বছরের জানুয়ারির শেষদিকে সবার আগে করোনার টেস্ট কিট তৈরি করেছিল সিজেন। অ্যালটিউজেন তাদের ইঞ্জেকশন প্রযুক্তির লাইসেন্স উৎপাদনের সুযোগ দেওয়ার ফলে সহজলভ্য হয় রোগীরা নিজে নিতে পারবে এমন ওষুধের ব্যবহার। অন্যদিকে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাবার গ্লাভস প্রস্তুতকারক তাদের উৎপাদন বিপুল হারে বৃদ্ধি করে। বর্তমানে তারা বার্ষিক ৯১ বিলিয়ন সুরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করলেও, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ- তা ১১০ বিলিয়নে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
আলোচিত কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য গেল বছরে কমপক্ষে ৫০০ শতাংশ বাড়ে, যা ছিল দরবৃদ্ধির সর্বোচ্চ ঘটনা। সিজেন- এর মূল্যায়ন আগস্ট নাগাদ ৯১৯ শতাংশের উত্থান লক্ষ্য করে। মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে কোম্পানিটি। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চিকিৎসা সরঞ্জাম সহায়তার অনুরোধ করার পর, দ. কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে রাজধানী সিউলে সিজেন- এর সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন।
রাষ্ট্রপতির সফরের মুহূর্তকে স্মরণ করে সিজেন প্রতিষ্ঠাতা চুন জং-ইয়ন স্থানীয় একটি দৈনিককে গত জুনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, "জীবনে কখনো এত বড় চাপের সম্মুখীন হইনি।"
তবে সব সুসময়ের হয়তো শেষ থাকে, টেস্ট কিটের ব্যবসাও সেই পরিণতি এড়াতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত বিশ্বের নানা দেশে টিকাদানে গতি আসার সাথে সাথেই ব্যাপক পরিমাণে কমছে সিজেন- শেয়ারের বাজারদর। এমনকি উচ্চ মুনাফা সত্ত্বেও সে প্রবণতা বন্ধ হয়নি। যেমন; ২০২০ সালে সিজেন এর মুনাফা ১০গুণ বাড়ে, আর তৃতীয় প্রান্তিকে অ্যালটিউজেন অর্জন করে দ্বিগুণ লাভ; কিন্তু, আগামীতে এই প্রবৃদ্ধি হার ধরে রাখা যাবে না – বিনিয়োগকারীদের এমন অনুমান থেকেই বাজার মূল্যায়ন কমেছে।
প্রতিষ্ঠাতা চুন ও তার পরিবারের সদস্যরা মিলে সিজেন এর ৩১ শতাংশ অংশীদারিত্বের মালিক। বর্তমান বাজার দরে তাদের সম্পদমূল্য ৮৪ কোটি ডলার, গেল বছর তা ছিল ১৬০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেক প্রাচুর্য হারিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে, অ্যালটিউজেন মুখ্য নির্বাহী পার্ক সুন-জায়ে ও তার পরিবার কোম্পানির ২৫ শতাংশ মালিকানার অধিকারী। তাদের অধীন শেয়ারমূল্য এখন ৮৩ কোটি ডলার, যা গেল বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে ১৪০ কোটি ডলার ছিল।
মালয়েশিয়া তথা বিশ্বের শীর্ষ গ্লাভস উৎপাদক- টপ গ্লাভ- এর প্রতিষ্ঠাতা লিম ওয়েই চাই ও তার পরিবারের সম্পদমূল্য গেল অক্টোবরের পর থেকে কমেছে ২২০ কোটি ডলার। অন্যান্য শীর্ষ উৎপাদক সুপারম্যাক্স কর্পের প্রধান নির্বাহী থাই কিম সিম, হারতালেগা হোল্ডিং বিএইচডি'র প্রতিষ্ঠাতা কুয়ান কাম হন এবং কোসসান রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ বিএইচডি'র নির্বাহী কিম কুয়াং সিয়া- এরা প্রত্যেকে ১২০ কোটি ডলার করে হারিয়েছেন। অন্যদিকে, রিভারস্টোন হোল্ডিং লিমিটেড এর ওং টিক সন- তার বিনিয়নিয়ার তালিকা থেকেই ঝড়ে পড়েছেন।
শুধু মালয়েশিয়ায় নয়, মহামারির এক পর্যায়ে পুরো বিশ্বে স্বাস্থ্য সরঞ্জামের সরবরাহক হয়ে উঠেছিল চীন। ফলে যেসব ধনীর জন্ম হয়; তাদের ভাগ্যও এখন দৌদুল্যমান বাজারের দোলাচালে। এদের মধ্যে; গজ ব্যান্ডেজ প্রস্তুতকারক- অলমেড মেডিকেল প্রোডাক্টস কো. নামক এবং সার্জিক্যাল মাস্ক উৎপাদক গুয়ানঝৌ ওন্ডফো বায়োটেক কো. অন্যতম।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ