বাংলাদেশের প্রথম নারী দমকলকর্মীদের গল্প
বাংলাদেশের ইতিহাসে কয়েকজন নারী দমকলকর্মীদের মধ্যে একজন প্রিয়াঙ্কা হালদারকে পুরুষ শাসিত সমাজে এই পেশা বেছে নেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছিলেন, "আমরা সক্ষম, আমাদেরও ক্ষমতা আছে, আমরাও এটি করতে পারি।"
তিনি দমকলকর্মীর পেশা বেছে নেওয়ার জন্য গর্ববোধ করছিলেন।
এক বসন্তের দিনে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রাজধানীর মিরপুরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং কমপ্লেক্সে কয়েকশ দমকলকর্মী তাদের বিকেলের মহড়ায় নিয়োজিত ছিল। তাদের মধ্যে ১৫ জন নারী দমকলকর্মী (দুজন মহিলা প্রশিক্ষক তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত) প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন।
বেশিরভাগেরই বয়স ১৮ থেকে ২১ এর মাঝে। তারা কমান্ডারকে পাশ কাটিয়ে একটি অ্যাঙ্গাস মোটর পাইপলাইন দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। তাদের মধ্যে দুইজন পাইপটি খুলে ফেললেন আর পাঁচজন সেটি তাদের কোমরে তুলে দৌড়াতে শুরু করলেন।
কমান্ডার চেঁচিয়ে উঠলেন, "তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি যাও।"
বিরতির সময় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি মহিলা প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বলেছেন। তারা সবেমাত্র অগ্নিকাণ্ডে জরুরিভাবে সাড়া দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো সম্পন্ন করেছেন। তাদের চুল ছোট এবং প্রচুর ঘামছিলেন। আদেশের পর তারা ডরমিটরি থেকে ক্যাপ আনতে ছুটে গেলেন এবং দ্রুত ফিরে এলেন।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/03/08/women_firefighters_2.jpg)
মেহেরপুর জেলার প্রিয়াঙ্কা হালদার তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তিনি বর্তমানে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি বালিকা কলেজে ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। মোহন হালদার ও শিলা হালদারের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা স্কুল থেকেই বিতর্ক ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
তিনি বলেন, "আমি আমার জেলায় অন্তত ১১৫টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে পেরেছি।"
এরজন্য এক কনের বাড়িতে তাকে আটকে রাখাও হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমি ফায়ার সার্ভিসে যোগ দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম।"
তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রিয়াঙ্কা বলেন, "২০১৭ সাল অথবা ২০১৮ সালে যখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমি একজন সহপাঠীর কাছ থেকে ফোনে জানতে পেরেছিলাম একটি শিশুকে তার অনুমতি ছাড়াই জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মেহেরপুর শহরে আমার বাড়ি থেকে কনের বাড়ি প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ছিল।"
তিনি আরো বলেন, "আমি সাইকেল চালিয়ে সেখানে যাই এবং পৌঁছানোর পরে মেয়েটির পরিবার আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। তা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আমরা বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি এবং মেয়েটি তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।"
প্রিয়াঙ্কা আরো বলেন, "এ কারণেই আমি ফায়ার সার্ভিসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি। যখন কারো প্রিয়জন আগুনে আটকে থাকে তখন আমরা তাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যাই। তাই আমি দমকলকর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি আমি ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের জন্য একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। আমি আবেদন করেছি এবং সফলভাবে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। আমি গর্বিত বোধ করি যে অনেক প্রত্যাখ্যানের পরেও আমি সফল হতে পেরেছি।"
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/03/08/priyanka_firefighter_0.jpg)
মাজেদা খাতুন (১৯) দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের ইছামতি ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। তিনি বলেন, "একদিন বিকেলে ফেসবুকে চালানোর সময় আমি একটি চাকরির সার্কুলার দেখতে পেলাম। আমার পাঁচ বোনের মধ্যে একমাত্র আমি দমকলকর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং কেউ আপত্তি করেনি। আমি চাকরির সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলো বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি ইতোমধ্যেই মনস্থির করে ফেলেছিলাম। জীবন রক্ষা করার সময় যদি আমাদের সাথে কোন ভুল হয়ে তাহলে আমার কোন অনুশোচনা থাকবে না।"
মাজেদা খুশি হয়ে বলেন, "ছয় মাসের প্রশিক্ষণের শুরুতে আমি মার্চ-পাস্টের ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য লড়াই করেছি। আমি প্রথমে আমার পা দিয়ে তাল মেলাতে পারতাম না। পা হয় খুব উঁচুতে উঠত বা বাম দিকে দূরে রাখতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি এটা সামলে নিয়েছি। আমি এখন ঠিক করে তাল মেলাতে পাড়ি এবং এখন আমি অনেক ভালো পারফর্ম করছি।"
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/03/08/mazeda_firefighter.jpg)
আরেক প্রশিক্ষণার্থী চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আসা নাজমুন নাহার দমকলকর্মী হিসেবে তার নিয়োগের খবর পাওয়ার মুহূর্তের কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, "আমি আমার বাবার সাথে ছাদে ছিলাম যখন আমার ভাই ফলাফলের কথা জানায়। তালিকা দেখে আমি প্রথমে আমার বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তারপর তার পা ছুঁয়েছিলাম এবং পরে আমার মায়ের সাথেও তাই করেছি।"
তিনি আরো বলেন, "আমি যখন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তখন আমার ভাই আমার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাই আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।"
কথোপকথনের সময় মাজেদা বলেন, "আমাদের সিনিয়র দমকলকর্মীরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন যেখানে নারী ভুক্তভোগীরা পুরুষ দমকলকর্মীদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে অস্বস্তি বোধ করতেন।"
নাজমুন নাহার সাহসের সাথে বলেছিলেন, "আমি আশা করি আমরা ১৫ জন নারী দমকলকর্মী এই মহিলা ভুক্তভোগীদের সহায়তা করতে পারবো এবং আমরা তাদের জীবন বাঁচাতে সজাগ থাকব।"
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/03/08/nazmun_nahar_fire_fighter.jpg)
ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে অস্ত গেছে। মহিলা প্রশিক্ষণার্থীরা তাদের ফায়ার ড্রিল সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে তাদের ডরমিটরিতে ফিরে যাচ্ছিলেন একটি নতুন স্বপ্ন নিয়ে- ১৫ জন মহিলা দমকলকর্মীদের নিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে৷