ছাতা জন্মলগ্ন থেকেই রাজকীয়!
ছাতা, যাকে কালেভদ্রে আমরা প্যারাসল বলেও ডেকে থাকি, তার ইতিহাস বহু পুরোনো। সূর্যের প্রখর তাপ থেকে সুরক্ষা দিতেই প্রথমে এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। রোদ হোক, বৃষ্টি হোক—যেকোনো দুর্দিনের সঙ্গী এটি।
এমনকি বাইবেলের কিছু জায়গায়ও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলে থাকেন যে বৃষ্টি এবং তুষারপাত থেকে রক্ষা পেতে জাপানে এর প্রথম উদ্ভব ঘটেছিল। তবে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায় যে চীন এবং মিসরেই প্রথম এর ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। শকুন্তলার নাটকীয় ছন্দেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রথমদিককার ছাতায় তালপাতা, প্যাপিরাস, ময়ূরের পালক ব্যবহৃত হতো আর স্রেফ সেসব সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের এসব ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। তবে তখনকার প্যারাসল বেশ ভারীও ছিল, তা বহন করতেও মানুষের প্রয়োজন হতো। অন্যদিকে চীনে প্যারাসল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের কঞ্চি এবং তাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পাতা এবং পালক দিয়ে।
প্যারাসলের উদ্ভব নিয়ে ধোঁয়াশা আছে অনেক। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, বৃক্ষের শাখায় বিদ্যমান বড় পাতাই মানুষের মনে ছাতার চিন্তা এনে দিয়েছিল। আবার অন্য এক দল বিশ্বাস করেন যে তাঁবু থেকেই ছাতার ধারণা মানুষের মনের কোনায় উঁকি দিয়েছে। তাঁবু বর্তমান সময়েও তার উপযোগিতা হারায়নি এবং অপরিবর্তিত অবস্থায় থেকে গেছে।
ছাতার নামকরণ—প্যারাসল থেকে আম্ব্রেলা
ইংরেজি আম্ব্রেলা শব্দটি ইতালীয় 'ওম্ব্রেলা' থেকে ধার করা হয়েছে। শব্দটির ল্যাতিন মূল আম্ব্রার অর্থ হলো ছায়া। তাই আম্ব্রেলা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ছোট্ট ছায়া, কাব্যিক একটি ঢং আছে শব্দটিতে। এ ছাড়া আম্ব্রেলা শব্দটির প্রয়োগ করে থাকেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। বিশেষ একধরনের পুষ্পবিন্যাসকে তারা এ নামে ডেকে থাকেন।
ইংরেজিতে শব্দটির তেমন কোনো রকমফের না থাকলেও জার্মান এবং ফরাসিরা গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষঙ্গটির জন্য যুতসই বেশ কিছু নাম বের করেছেন। যেমন রিগনশিয়াম, প্যারাপ্লুই, সনেনশিয়াম, প্যারাসল প্রভৃতি।
ফরাসি ভাষায় ছাতাকে বলা হয় প্যারাপ্লুই বা প্যারাসল, প্যারা শব্দের অর্থ সুরক্ষা এবং সল অর্থ হল সূর্য। অর্থাৎ সূর্য থেকে সুরক্ষা দেয় যেটি। ষোড়শ শতকে এসে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে এখানে। প্যারাসলে তেল এবং মোমের কভার যুক্ত করে দেওয়ায় মূলত তখন থেকেই প্যারাসল এবং ছাতার প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হতে শুরু করল। এ সময় থেকেই ইউরোপে নারীদের প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ হিসেবে ধীরেধীরে স্থান করে নিচ্ছিল এই ছাতা।
প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যের সভ্যতায় ছাতা
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে এশিয়ার পশ্চিমাংশের মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। মেসোপটেমিয়ার অ্যাসারীয় সভ্যতার রাজধানী নিনেভ নগরী। সেখানকার ভাস্কর্যে বারবারই উঠে এসেছে ছাতা। ইংরেজ ইতিহাসবিদ অস্টেন হেনরি লায়ার্ডের প্রদর্শিত একটি ছবিতে দেখা যায়, রাজা তার রথে বসে আছেন, সেখানে তার মাথার ওপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক ভৃত্য। সেটির চারপাশে পর্দা, নইলে সেটি দেখতে ঠিক এখনকার ছাতার মতোই।
ভ্রমণপিয়াসী এই মানুষটির মতে, পূর্বের দেশগুলোর কাছে ছাতা বা প্যারাসল ছিল মূলত রাজকীয়তার প্রতীক, শান্তি বা যুদ্ধ যেকোনো সময়ই এটি রাজার মাথার ওপর বিরাজ করত।
এর চারপাশে দেখা যায় রেশমের ঝাপ্পা, ওপরের দিকে এটি ফুল বা অন্যান্য অলংকারে সজ্জিত এবং সুশোভিত। পরবর্তী সময়ে এতে এম্ব্রয়ডারিকৃত লিনেন বা সিল্কও ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে সেসময় এটি স্রেফ রাজার জন্যই বরাদ্দ ছিল এবং অন্য কারও এটি ব্যবহারের অনুমতি ছিল না।
আবার মিসরে বিভিন্ন আকৃতির ছাতা দেখা গেছে। তালপাতা দিয়ে বানানো কিংবা রঙিন পালকে সজ্জিত সেসব ছাতা দেখতে অনেকটা পাখার মতো, একটি বড় হাতলকে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখনকার দিনে আমরা পোপদের পাশে যেরকম পাখা দেখতে পাই, অনেকটা সেরকম। স্যার গার্ডনার উইলকিনসনের মতে, মিসরে এর আলংকারিক সৌন্দর্যের চেয়েও এর প্রাত্যহিক উপযোগিতার দিকটিই বেশি প্রাধান্য পেত।
পারস্যের পার্সিপোলিসের খোদাই করা বিভিন্ন শিল্পে বারংবার উঠে এসেছে প্যারাসল। স্যার জন ম্যালকম 'হিস্ট্রি অব পার্সিয়া'তে লিখেছেন, পারস্যের কিছু ভাস্কর্যও বেশ মিসরীয় ঘরানার, সেখানে দেখা যায় রাজার মাথার ওপর ছাতা ধরে রেখেছে কোনো ভৃত্য।
এ ছাড়া তখত-ই-বস্তান, যেটি হয়তো ১২ শতক পুরোনো, সেটির পাথরের ওপর একটি হরিণ শিকারযজ্ঞ দেখতে পাওয়া যায়। রাজা সেখানে ঘোড়সওয়ার, একজন দাসের ছত্রছায়ায় তিনি অবস্থান করছেন। আবার অন্যান্য অনেক পূর্বাঞ্চলীয় দেশের মতো অ্যাসারিয়াতেও প্যারাসল বিভিন্ন উদ্ভট এবং মহিমান্বিত তাৎপর্যের কারণে ব্যবহৃত হয়েছে।
ড. মরিসনের মতে, তিনশ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ছাতা এবং প্যারাসলের কথা বইপত্রে উল্লেখ পাওয়া গেলেও এর আগে থেকে তা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চৈনিক উৎসব-পার্বণসম্পর্কিত প্রাচীন বই, চিউ-লিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তাতাররা চীন দখল করে নেওয়ার পর তাতারপ্রধান সম্রাটের ছেলেকে কয়েদি হিসেবে নিয়ে যান। শিকারে বের হলে তিনি শাস্তিস্বরূপ এই ছেলেকে দিয়ে ছাতা বহন করাতেন।
ছাতার সাথে এর জন্মলগ্নেই একটি রাজকীয় তাৎপর্যের ব্যাপার চলে এসেছে, একইসাথে এটি হয়ে উঠেছিল আরাধ্য। বর্তমান সময়ে এসে এই কথাটি হজম করাটাও আমাদের জন্য কিছুটা কঠিন। কারণ, আমরা ছাতাকে এখন প্রাত্যহিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেই অভ্যস্ত। তবে অনেক প্রাচীন সভ্যতার মানুষই নিজের দেবতাদের ছায়া দিতে এটিকে ব্যবহার করেছেন।
মিসরীয়রা তাদের দেব-দেবীকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য পালক কিংবা পদ্মপাতা ব্যবহার করতেন, যেটি একইসাথে ছায়াদানের কাজটিও করত। ছাতার অন্যতম পুরোনো সংস্করণের মধ্যে এটিও একটি। হিন্দু পুরাণেও দেখা গেছে, দেবতা বিষ্ণু পাতালপুরীর অনেক রাজ্যে ভ্রমণ করার সময় মাথার ওপর ছাতা রাখতেন।
গ্রিসে ছাতাকে নারীর ফ্যাশনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হত। একইসাথে ধর্মীয়ভাবেও এর বিশেষ তাৎপর্য ছিল। যেমন স্কাইরোফোরিয়ার মাড়াই উৎসবে অ্যাক্রোপোলিসে দেবীদের যাজিকারা একটি সাদা ছত্র ধরে রাখতেন। দেবতা বিষ্ণুর মতো গ্রিক দেবতা ডায়োনাইসাসও পাতালপুরীতে ভ্রমণের সময় হাতে রাখতেন একটি ছোট্ট ছাতা।
খুব সম্ভবত গ্রিস থেকে রোমেও প্যারাসলের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানে নারী-পুরুষ সবাই রোদের উত্তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা ব্যবহার করতেন। রোমান ধ্রুপদি সাহিত্য বা শিল্পে বারবার ছাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ভৃত্যদের মাঝে মনিবের ওপর ছাতা ধরে রাখাটাকে সম্মানের চোখে দেখা হতো, এমনটা ভাবাও খুব অসংগত হবে না।
কবিদের কবিতায় তা বারবারই প্রকাশ পেয়েছে। যেমন রোমান কবি ওভিড স্মরণ করছেন হারকিউলিসকে, যে ওম্ফালেকে রৌদ্রময় আকাশ থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যবহার করত একটি স্বর্ণাভ ছাতা।
অন্যত্র ওভিড প্রেয়সীর প্যারাসল ধরে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রেমিককে, যেটি হয়তো প্রেয়সীকে তার প্রতি আরেকটু অনুরক্ত করে তুলবে। তাছাড়া নাট্যমঞ্চে এর ব্যবহার দেখা যেত হরহামেশাই। বাতাসের কারণে প্রকাণ্ড তাঁবু খাটানো সম্ভব না হলে সেখানে সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে রক্ষা পেতে ছাতা ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
লেখককে বলতে শোনা যায়, যাত্রা শুরুর সময় হয়তো সুন্দর আকাশেরই দেখা পেলে কিন্তু হঠাৎ করে বর্ষণ শুরু হলে যেন ছাতা ব্যবহার করতে পারো, সেজন্য এটিকে হাতের নাগালেই রেখো।
কনস্টান্টিনোপল প্রতিষ্ঠার পর অনেক লোকের মাঝেই ছাতা ব্যবহার করার চল দেখা গেলেও রোমে এটিকে মূলত বিলাসদ্রব্য হিসেবেই দেখা হয়েছিল। লেখক প্লাইনি তালপাতা থেকে বানানো ছাতার কথা বললেও রোম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন উৎসবে যেসব ছাতা ব্যবহার হতো, তাতে জাঁকজমক থাকত অনেক বেশি। এমনকি ওভিডের ছন্দে ইতিমধ্যেই আমরা স্বর্ণমণ্ডিত ছাতার উল্লেখও পেয়েছি।
তবে ছাতাকে নারীত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখা হতো। অন্যদিকে ছাতা বহন করাকে দাসের একটি অন্যতম দায়িত্ব হিসেবেই পাওয়া যায়। প্রাচ্যজুড়ে প্রায় সবখানেই রাজকীয়তার পরিচায়ক হিসেবে ছাতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, কিংবা অন্তত উচ্চবর্গীয় মানুষের অনুষঙ্গ হিসেবেই এটি শোভা পেয়েছে বেশি।
ছাতার জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়
মধ্যযুগীয় ইউরোপে ছাতার ব্যাপারে তেমন কোনো বিবরণীই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ঐতিহাসিকেরা দ্বিধান্বিত যে এই মহাদেশে এই সরঞ্জামটি সেসময় আদৌ ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা। বরং বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ইউরোপবাসীদের মধ্যে সেসময় আলখেল্লার কথাই বেশি পাওয়া গেছে। অবশ্য ছাতা হাতে রাখা মানে এক হাত ব্যস্ত রাখা। আর মধ্যযুগের যুদ্ধ-বিগ্রহকালে সেটিও খুব যুক্তিসংগত ঠেকে না।
ষোড়শ শতকে এসে ইউরোপীয় ইতিহাসে ছাতার উল্লেখ পাওয়া গেলেও তা মূলত ইতালির ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রিবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইংল্যান্ড খুব সম্ভবত চীনের কাছ থেকে ছাতার ব্যবহার রপ্ত করেছিল, কারণ সপ্তদশ শতকের দিকে এসেই ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা লেখক এবং পর্যটকদের সাথে চীনের রাজপরিবারের চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছিল।
ফরাসি কূটনীতিক সিমন দে লা লুওবেয়ারের লেখা থেকে জানা যায়, সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে ফরাসি রাজদরবারে স্রেফ কিছু গণ্যমান্য সভাসদই ছাতা ব্যবহার করার অনুমতি পেতেন। রাজা ব্যবহার করতেন একটি বিশেষ ছাতা, যেখানে দু-তিনটি ছাতা জুড়ে দেওয়া হতো একটিতে। অন্যদিকে সভাসদরা তুলনামূলক সাধারণ ছাতা নিয়ে চলাফেরা করতেন।
ফরাসি বণিক ও পর্যটক জ্যঁ-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভার্নিয়ের তার 'ভয়েস টু দ্য ইস্ট'-এ লিখেছেন, মোগল সম্রাটদের সিংহাসনের দুপাশে শোভা পেত দুটো ছাতা। আবার রাজা আভার দরবারও ছাতা দিয়ে সুসজ্জিত ছিল।
মহরত্তার রাজপুত্রেরা যারা ভারতের পুনে কিংবা সাতারায় শাসন করতেন, তাদের উপাধিই ছিল ছত্রপতি—অর্থাৎ ছাতার অধিপতি। ভারতীয় কিংবা বার্মিজ রাজপুত্রদের ব্যবহৃত ছাতা ছিল বৃহদাকার এবং ভারী। সেটি বহন করতেও সার্বক্ষণিক পেয়াদার প্রয়োজন হতো। মহরত্তার সভায়ও সবাই ছাতা ব্যবহার করার অনুমতি পেতেন না।
১৮৫১-এ লন্ডনের হাইড পার্কে হওয়া মহাসমারোহে অংশ নেওয়া নাগপুরের মহারাজার ছাতাকে সিল্ক, স্বর্ণ এবং রৌপ্য দিয়ে সাজানো হয়েছিল। তবে বাংলা বা আসামের ভূখণ্ডে ছাতায় নতুন কোনো বিশেষত্ব দেখা যায়নি। এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশ সাদামাটা ছাতাই ব্যবহার করতেন।
আবার পারস্য এবং ভারতবর্ষের মতো চীনে স্রেফ রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছাতার ব্যবহার আটকে থাকেনি। ছাতা নিয়ে বিশেষ কোনো নিয়মকানুন জারি ছিল না। বরং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন যদিও তাতে পার্থক্য ছিল। বিশেষ দুটো রং—লাল এবং হলুদ চীনের রাজপরিবারের জন্য সংরক্ষিত ছিল। আর সাধারণ মানুষ নীল রঙের ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু সম্রাট শিকারে যাওয়ার আগে তার সামনে ছাতা হাজির করার মতো একটি নিয়ম জারি ছিল চীনেও।
সমাজের উঁচুতলার মানুষ বর্ষাকালে বাইরে বেরোবেন না, আর দরিদ্র শ্রেণির মানুষ বর্ষণ থেকে রেহাই পেতে নিজেদের বিশেষ পোশাককেই ব্যবহার করে থাকেন। তবু ধারণা করা হয়, চীনারাই প্রথম পানিপ্রতিরোধী ছাতা তৈরি করেছিল বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। কাগজের ছাতায় মোম এবং আঠা ব্যবহার করে তা বার্নিশ করত।
পশ্চিমের দেশগুলোতেও ছাতাকে তার এই ব্যবহারিক উপযোগিতার জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জার্মান পর্যটক এবং গণিতজ্ঞ কার্স্টেন নিবারের বিবরণে দক্ষিণাংশের আরবের কথা জানা যায়। ইয়েমেনের সানায় একটি সমাবেশের কথা বলছেন তিনি, এখানে ইমামের পেছনে বিভিন্ন গোত্রপ্রধান ইমামের পাশে একটি মাদাল্লা ধরে রেখেছেন, যেটি মূলত একটি বৃহদাকৃতির ছাতাবিশেষ।
মরক্কোর একটি বিবরণ থেকে জানা যায় যে স্রেফ সম্রাট নিজে এবং তার পরিবারের সদস্যেরাই এটি ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ মরক্কোতে এটি সার্বভৌমত্বের প্রতীকও বটে। তুরস্কে আবার ছাতার ব্যবহার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
তবে একটি প্রথার রেশ এখনো পুরো হারিয়ে যায়নি। সেটি হলো, সুলতান যে প্রাসাদে থাকতেন, তা অতিক্রম করার সময় তাকে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পথিককে ছাতা নিচু করে যেতে হতো। নতুবা কখনো কখনো দায়িত্বরত মূর্তিমান প্রহরীর কাছে সাজাও পেতে হতো।
মালগাড়ির নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী
ইংল্যান্ডে এবং বিশেষ করে লন্ডনে সাধারণত অনেক বৃষ্টি হয়। তবে অদ্ভুত কিন্তু সত্যি যে বৃষ্টি দ্বারা লন্ডনের ভদ্রলোকেরা অতিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও প্রথমদিকে হাতে ছাতা নিতে বহু বারণ ছিল তাদের। ব্রিটিশ ব্যবসায়ী এবং পর্যটক জোনাস হ্যানওয়ে প্যারিস থেকে ১৭৫০-এর পর লন্ডন ফিরে যখন একমাত্র লন্ডনের পুরুষ হিসেবে ছাতা হাতে রাস্তায় হাঁটলেন, তখন শুরুতে তাকে নিয়ে খুব ঠাট্টা-তামাশা করা হল। এর আগপর্যন্ত তা নারীর অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হলেও তিনিই বৃষ্টির দিনে লন্ডনের রাস্তায় পুরুষদের জন্য ছাতা হাতে নিয়ে ঘোরার ট্রেন্ডটি দাঁড় করিয়ে দিলেন।
কিন্তু ইংরেজ এবং ফরাসিদের দ্বৈরথ-বিরোধের কথা কে না জানে! তাই ইংরেজরা মেনে নিতে পারছিল না যে একজন ইংরেজ ভদ্রলোক ফরাসি কোনো উদ্ভাবনকে হাতে নিয়ে লন্ডনের রাস্তায় এভাবে হেঁটে চলবেন। তবে হ্যানওয়ে মালগাড়ির চালকদের রোষের মুখে সবচেয়ে বেশি পড়েন। কারণ, বৃষ্টির দিনে তাদের গাড়ির যে একচ্ছত্র আধিপত্য একসময় বিরাজ করত, ছাতা এসে তার অনেকটাই নষ্ট করে দেবে। এটি তাদের ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। তাই শুরুতে হ্যানওয়েকে বেশ তিরস্কার-ভর্ৎসনার মধ্যে পড়তে হয়েছিলও। কিন্তু বৃষ্টির দিনে ছাতা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা দ্রুতই বুঝতে শুরু করে ইংরেজরা।
ছাতায় পাতলা ইস্পাতের ফ্রেম ব্যবহার করার বুদ্ধিটি এসেছিল স্যামুয়েল ফক্স নামক একজন ইংরেজের মাথায়। আবার উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ছাতার স্বয়ংক্রিয় বৈশিষ্ট্যটির উদ্ভাবন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এতে করে একটি বোতাম চাপলে ছাতাটি খুলে আসে। বর্তমান সময়ের ছাতায়ও আমরা এটির ব্যবহার করি।
ছাতা—ফ্যাশনের নতুন অনুষঙ্গ
সপ্তদশ শতকে ইউরোপে ছাতা হয়ে উঠল জনপ্রিয়। বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের বুর্জোয়া সমাজে। ফরাসি বিপ্লবের সময় এটি হয়ে উঠল ফ্যাশনের একটি অংশ। কারিগরেরা আবলুস কাঠের মতো ভালো কাঁচামাল ব্যবহার করে আরও সুন্দর এবং মসৃণ ছাতার হাতল তৈরির দিকে মনোযোগ দিলেন।
তবে এসব কাঁচামাল ব্যয়বহুল। পরবর্তী শতকে এসে ছাতা হয়ে উঠল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মূল্যবান সরঞ্জামটি যেন চুরি না যায়, তাই বহু আবিষ্কারও লক্ষ করা গেল সেসময়। তালা, সাইরেন, এমনকি অস্ত্রও কখনো কখনো লুকানো থাকত এতে। ছাতা ব্যবহার হতে শুরু করল বহুবিধ কাজে।
প্রথমদিককার ইউরোপীয় ছাতাগুলোতে যে নীতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। ফাঁপা এবং নমনীয় কিন্তু শক্ত কাঁচামাল ব্যবহার করে দেখতে অনেকটা তিমির হাড়ের মতো একটি প্রাথমিক গড়ন দেওয়া হয়েছিল। এখানে যে কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে বহুলাংশে পরিবর্তন এলেও সেই মূল গড়নটি এখনো অপরিবর্তিত।
এতে কাঠ, ইস্পাত, রুপা, লেদার, অ্যালুমিনিয়াম এবং এখন ফাইবার গ্লাসের ব্যবহার লক্ষ করা গেছে—অর্থাৎ দিনকে দিন ছাতার হাতলকে হালকা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একসময় অয়েলক্লথ ক্যানভাসের খুব চল থাকলেও ইদানীং আরও কার্যকর এবং প্রতিরোধী শক্ত নাইলনের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে।
হালআমলের ছাতা
ফোল্ডেবল অর্থাৎ ভাঁজ করা যায় এমন ছাতার আবির্ভাব ঘটল কেবল গত শতাব্দীতেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর থেকেই জার্মানির সলিগেন নগরীর হান্স হপ্ট ছাতা এবং তার হাতের লাঠিটিকে যুগপৎ ব্যবহার করতে পারতেন না। তাই তিনি ভাবতে শুরু করলেন, কীভাবে ছাতাটিকে তার পকেটবন্দী করা যায়।
ছাতায় টেলিস্কোপিক ফ্রেমজুড়ে দেওয়ার কারণে তা সম্ভবও হয়ে উঠল। হপ্ট তার এই উদ্ভাবনটির পেটেন্টও করিয়েছিলেন। অর্থাৎ আজকের দিনে যে আমরা ছাতা হ্যান্ডব্যাগে ভরে রাখতে পারি, এটিও সেই আবিষ্কারেরফলেই সম্ভব হয়েছে।
ব্যবসায়ী ফ্রিটজ ব্রেমশে এই সিরিজেই ছাতা তৈরি শুরু করলেন। যদিও মোটা দামে বিক্রি হতো, তবু 'কেনার্পস' নামক জার্মান এই ছাতা দ্রুতই বেস্টসেলার বনে গেল। তবে চীন থেকে ষাটের দশকে স্বল্পমূল্যে ছাতা প্রস্তুত করা শুরুর সাথে এই কাল্ট ব্র্যান্ডটির ব্যবসায় কাটতি পড়তে শুরু করে।
বর্তমানে চীন পৃথিবীতে ছাতার সবচেয়ে বড় প্রস্তুতকারক। কেবল চীনের শাংইউ শহরেই হাজারখানেক ছাতা নির্মাণকারী কারখানা আছে। আগেকার দিনেও চীন থেকে বহুসংখ্যক ছাতা ভারত, দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি করা হতো।
ছাতার গল্প অবশ্য এখানেই থেমে যায় না, আধুনিককালে এসেও কীভাবে এটিকে আরও আরামপ্রদ করা যায়, কীভাবে আরেকটু সুরক্ষা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে নতুন নতুন উদ্ভাবন এসেই চলছে। ছাতা যুগপৎভাবে দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য ফ্যাশন অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। আর একারণেই ছাতার বহু নতুন মডেলের আবির্ভাব ঘটেছে। যেমন স্বচ্ছ ছাতা, পকেটে ভরে রাখা যায় এমন ছাতা, উল্টো ছাতা এবং হাতের ছড়ির মতো ছাতা।