আইসক্রিম সূচকে সামাজিক মর্যাদা
সমাজবিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করার আগে কিংবা কার্ল মার্ক্সের শ্রেণি বিশ্লেষণ সম্পর্কে ধারণা পাবার আগেই আমার শৈশবে আইসক্রিমভিত্তিক একটি সামাজিক শ্রেণি সোপান অনুমান করতে পেরেছি; সেই শ্রেণিতে নিজের অবস্থানটা কোথায়, তা আইসক্রিম কেনা ও খাওয়ার সক্ষমতা দিয়ে নির্ধারণ করতে পেরেছি।
ঢাকার খানদানি এলাকাগুলোর বাইরে যে শহর, শহরের কেন্দ্রে হলেও আভিজাত্যের ছোঁয়া প্রতিষ্ঠিত হয়নি এমন একটি এলাকা গ্রিন রোডের ফার্মগেট লাগোয়া পশ্চিম পাশে রাজাবাজারে আমার জন্ম। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে। ষাটের দশকের শুরুতে রাজাবাজারের কোনো বাড়িতেই পাইপবাহিত পানি ছিল না, গ্যাস থাকার প্রশ্নই ছিল না; তবে স্ট্রিট লাইট ছিল এবং কিছুসংখ্যক বিত্তবান বাড়িতে বিদ্যুৎও ছিল। কাচের চিমনি কেনার স্মৃতি এখনো মিলিয়ে যায়নি।
সে সময় সিলিন্ডারের মতো একটি ছোট 'ফ্রিজিং প্লান্ট' কখনো হাতে ঝুলিয়ে কখনো বগলতলায় চেপে রেখে যে দু-একজন শিশুপ্রিয় ফেরিওয়ালা অসাধারণ ঠান্ডা ও পয়সার উপর স্বাদের তারতম্যনির্ভর কাঠি আইসক্রিম নিয়ে হাঁক দিতেন, তারা কখনো আইসক্রিম বলেননি, বলতেন 'আসক্রিম'। দু-একবার আসক্রিম বলার পর বলতেন মালাই আসক্রিম। তাদের সেই ফ্রিজিং প্লান্টে তিন ধরনের আইসক্রিম থাকত: দুই পয়সা দামের সাধারণ আইসক্রিমকে বরং জমাটবাঁধা মিষ্টি বরফ বলা যায়, খাবার পর ঠোঁট ও জিবে সবুজ, কমলা ইত্যাদি রং ধরত, সাদা শার্টে দু-চার ফোঁটা পড়তই, নির্ঘাত রঙিন দাগ হতো, এ জন্য শিক্ষকের বকা, কিংবা মায়ের মার বরাদ্দ থাকলেও একটা সদম্ভ ঘোষণা থাকত—এই শিশুর আইসক্রিম খাওয়ার সক্ষমতা আছে।
যখন আইসক্রিমের দাম দুই পয়সা, দুই পয়সার বর্গাকৃতি একটি মুদ্রাও ছিল, তখন ১৬ আনায় এক টাকা, এক টাকায় চৌষট্টি পয়সা। আইয়ুব খানের আমলেই (তার বিদায়কাল ২৫ মার্চ ১৯৬৯) মুদ্রার গুনতিতে কিছু পরিবর্তন এল, ৬৪-এর বদলে ১০০ পয়সায় এক টাকা, ছয় পয়সার এক আনা। দুই পয়সার পরবর্তী ধাপটি ঠিক দ্বিগুণ—এক আনা। এক আনার আইসক্রিম দুধেল সাদা, লম্বা সিলিন্ডারে কাঠি প্রবিষ্ট করা—দুধ মালাই কিংবা মালাই আইসক্রিম। পরবর্তী ধাপ আবারও দ্বিগুণ—একটি আইসক্রিমের দাম দু-আনাÑস্বাদে গন্ধে অবশ্যই এক আনার আইসক্রিমের চেয়ে উত্তম, এর ভেতরে কিশমিশ এবং বাদামের ছোট দু-এক টুকরোতেও কামড় পড়ত। এই আইসক্রিমের বড় বৈশিষ্ট নগ্নতা ঢেকে রাখা। বিশেষ ধরনের কাগজে আইসক্রিমটা ঢাকা, এ কাগজ কখনো গলত না। কাগজ মোড়ানো এই আইসক্রিম খেতে পারলে অভিজাত এলাকার বাইরের এলাকাসমূহের জন্য বিশেষ মর্যাদার বলে বিবেচিত হতো।
আইসক্রিমের চাহিদা বেড়ে যাবার পর হাতে বহন করা ফ্লাক্সতুল্য ফ্রিজিং প্লান্ট বাজার থেকে অপসৃত হতে থাকে। আসে আইসক্রিমের বাক্স, এটাও শীতলকারক, এর ভেতরে তিনটি পৃথক ধাপ—সবচেয়ে নিচের দিকে দু-আনা দামের, মাঝামাঝি জায়গায় এক আনা এবং উপরের দিকটাতে দুই পয়সার আইসক্রিম। কোনো কানো বাক্সে দুটো চেম্বার একদিকে সব দুই পয়সার আইসক্রিম, আরেক দিকে এক ও দু-আনার। আরও কিছুকাল পর ঈগলু ও বেবি আইসক্রিমের সাইকেল ভ্যান বাজারে এসে যায়। আইসক্রিম ভ্যানচালকেরা সামাজিক বিভাজন কিছুটা ভেঙে দেয়। তাদের অভিষ্ঠ ক্রেতা মূলত অভিজাত শ্রেণির হলেও হাতে সময় থাকলে এবং ভ্যানে আইসক্রিম থাকলে তারা রাজাবাজারের মতো এলাকাতেও চলে আসতেন। বিক্রি তেমন না হলেও আভিজাতরা কোন ধরনের আইসক্রিম খান, তা জানা হয়ে যায়।
দুই পয়সা থেকে দুই আনা—এই রেঞ্জ আমার বিবেচনায় মধ্য-মধ্যবিত্ত (মধ্যবিত্তের তিন বিভাজন: নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত) পর্যন্ত এসে যেত। উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের পছন্দ ছিল ছয় আনা দামের ঈগলু কিংবা সুস্বাদু প্রাণহরা বেবি আইসক্রিম।
ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া দিয়ে থাকতে হতো না, আমার বাবা কম বেতনের সরকারি চাকুরে হলেও অবসর গ্রহণ পর্যন্ত মাসের প্রথম দু-এক দিনের মধ্যে বেতন পাওয়াটা নিশ্চিত ছিল। আমি মিলিয়ে দেখেছি আইসক্রিম সূচকে আমি এক আনা দামের মালাই আইসক্রিম সূচকের সাথে বেশ খাপ খাই। সে সময় তিন মাত্রার এই হিসাবে নিজেকে যথেষ্ট দক্ষ মনে করলেও একটা বড় ধরনের গলতি যে আমার হিসাবে রয়ে যায়, তা ধরা পড়তে বেশ সময় লাগে। নাগরিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমার আইসক্রিম সূচকে আসতেই পারেননি—অর্থাৎ দুই পয়সারটাও কেনার সামর্থ্য অনেক পরিবারেরই ছিল না। এই সংখ্যাটিই সম্ভবত দুই পয়সা, এক আনা, দু-আনা তিন স্তরের যেকোনোটির চেয়ে বেশি।
ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হই, যত দামিই হোক, কাঠিতে লাগানো আইসক্রিম চুষে খাওয়াতে মর্যাদা নেই। আইসক্রিমের পৃথক কাপ আছে, চামচ আছে—যদি নিউমার্কেটের নোভেল ড্রিংক হাউস না থাকত, জানতে আরও অনেক বছর লেগে যেত। তবে গুলিস্তানকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত এসেই বেবি আইসক্রিম পার্লারে বসে আয়েশ করে আইসক্রিম খেতে শুরু করে। দেশ স্বাধীন হবার আট-নয় বছর পর খবর পাই, প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে সাবনুরিয়ান নামের একটি আইসক্রিমের দোকান হয়েছে, মেশিন থেকে কোনে আইসক্রিম নেমে আসে। আইসক্রিম খাওয়া শেষ হলে কিংবা খাবার সাথে সাথে বিস্কুটের উপাদান দিয়ে তৈরি কোনটাও খেয়ে ফেলা যায়। এটাই সম্ভবত ঢাকার প্রথম কোন আইসক্রিম পার্লার।
আইসক্রিমের জগতে স্বাদে ও বিচিত্রে পাশ্চাত্যের যে বিপ্লব, বাংলাদেশে তার ঢেউ লেগেছে। আইসক্রিমের ছড়াছড়ি। কিন্তু আইসক্রিম বঞ্চিত মানুষের হারটা কি যথেষ্ট কমেছে?
ষাটের দশকেই হাতিরপুলের কাছে একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে ঢুকে আইসক্রিম উৎপাদনপদ্ধতি দেখা এবং সৌজন্যমূলক দু-আনা দামের একটি আইসক্রিম পেয়ে যাবার আনন্দের স্মৃতি রয়েই গেছে; দেশ-বিদেশে হরেক রকম আইসক্রিম খাবার পরও এখনো মনে হয় সব স্বাদ ও মিষ্টতাকে ছাড়িয়ে গেছে আমার সেই এক আনা দামের মালাই আইসক্রিম। আর অতি সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইসক্রিম বানানোর যে লুঙ্গি পরা, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ের রাশভারী কারিগরকে দেখেছিলাম, তাকে সে সময় আলবার্ট আইনস্টইনের চেয়ে কম কিছু মনে হয়নি।
নোভেল ড্রিংক হাউসের মিনি সাইজের চেয়ারে বসে যেদিন প্রথম চামচে তুলে আইসক্রিম খাই, আমার প্রত্যাশা ছিল পরিচিতজনদের সেউ এসে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে দেখে বিস্মিত হোক—আমি যে বিত্তের দেয়াল ডিঙিয়ে নোভেল পর্যন্ত পৌঁছেছি, কেউই যদি না দেখলÑআমার এত দূর এসে কী লাভ!
আমি দেখিনি, কিন্তু আমার দূরসম্পর্কীয় একজন আত্মীয় দেখে আমার সম্পর্কে তার যে ধারণা হয়েছে, তা একজন স্কুলছাত্রের জন্য কখনো সম্মানজনক হতে পারে না—নির্ঘাত বাপের পকেট মেরেছে! তারপরও ভাবি, এটা কাঠি আইসক্রিম নয়, ক্রিস্টাল আইসক্রিম কাপ থেকে চামচে তোলা আইসক্রিম খেতে হলে একটু সম্মান যদি যায় তো যাক, আইসক্রিম তো আর কেড়ে নেয়নি।
- পাদটীকা: সেকালে আমার একটি কাঠি আইসক্রিমে অন্তত চার-পাঁচজনের কামড় তো পড়েছেই, তাদের দু-একজন মেয়েও ছিল, তাদেরটাতে কামড় কেমন করে ভুলি। তা কামড় ছিল না, ছিল চুম্বন! শেয়ার করা আইসক্রিমে তাদের ভণিতাহীন চুম্বনের স্বাদ আমি নিশ্চয়ই পেয়েছি। কিন্তু সেই মেয়েরা আজ কোথায়? আমার আইসক্রিম যে গলে যাচ্ছে:
আমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে
কেন নেসবিট
এই গরম রৌদ্রতপ্ত দিনে
আমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে
আমি দ্রুত চাটছি যদিও বা
টিপ টিপ করে পড়ে যাচ্ছে।
আমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে
ফোঁটা ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে
আমার আঙুলের উপর
আমার থুতনিতে, আমার ঠোঁটের উপর।
আমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে
আমি গলে যাওয়া থামাতে পারি না
এক দলা মাটিতে পড়ছে
আর শব্দ করছে চপচপ।
আমার আইসক্রিম গলে যাচ্ছে
পেছনে নদী হয়ে গেছে
কোনের ভেতরই ছিল আইসক্রিম
এখন দেখছি আমার জুতোয়।