পশ্চিমা অবরোধ আসবে জানা ছিল রাশিয়ার, অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রস্তুতি নিয়েছে এক দশক ধরে

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই অর্থনীতিবিদরা মস্কোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়ে আসছেন। কিন্তু যুদ্ধের সাড়ে তিন মাস কেটে যাওয়ার পরেও রাশিয়া অনেকাংশেই স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রেখেছে।
গত ৭ জুন ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন মুদ্রাস্ফীতি কমছে, একইসঙ্গে বেকারত্বের হারও স্থির রয়েছে। জ্বালানির বড় একটি উৎস হওয়ায় তেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশটি এখনও ব্যাপক আয় করে চলেছে। জ্বালানি ব্যবস্থা স্থিতিশীল থাকলে খুব স্বল্পসময়েই রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে রাশিয়ার স্থিতিস্থাপকতার মূল কারণ হলো দেশটি ২০১৪ সাল থেকেই নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ক্রিমিয়া দখলের পর অর্থনৈতিক ধাক্কার কারণে তখন থেকেই সতর্ক ছিল রাশিয়া।
আমেরিকান ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন (এবিএ)-র অর্থনৈতিক গবেষক ভেরোনিকা ক্যারিয়ন ১৩ জুন এবিএ ব্যাংকিং জার্নাল পোস্টে লিখেন, 'রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্গে রূপান্তর করেছেন পুতিন'।
তবে অনেকেই রাশিয়ার উপস্থাপিত পরিসংখ্যানগুলোতে আস্থা রাখছেন না। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইউরোপ, রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের ফেলো অ্যান্ড্রু লোহসেনের মতে, 'রাশিয়ার সরকার নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে'।
তবে এখনকার মতো রাশিয়া রিজার্ভ সংরক্ষণ ও বৈদেশিক মূলধন ছাড়াই বিভিন্ন খাতে যে স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে তা যে নিঃসন্দেহে দারুণ সেটা স্বীকার না করার উপায় নেই। নিষেধাজ্ঞা সহনশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে রাশিয়া যা যা করছে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
রিজার্ভ বাড়াচ্ছে রাশিয়া
ইউক্রেন আক্রমণের আগে রাশিয়া ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম রিজার্ভের অধিকারী। এর বাইরে দেশটিতে প্রায় ৬৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের স্বর্ণ মজুদ ছিল। ব্যাংক অব ফিনল্যান্ড ইন্সটিটিউট ফর এমার্জিং ইকোনমিক্স সূত্রে জানা গেছে এই তথ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মজুদই রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি রুবলকে স্থিতিশীল রাখায় সাহায্য করেছে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া প্রায় অর্ধেক মজুদের প্রবেশাধিকার হারায় বলে মার্চে জানান দেশটির অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশটিতে এখনও প্রচুর স্বর্ণ মজুদ রয়েছে।
২০১৪ সালের পর রাশিয়ার স্বর্ণমজুদ তিনগুণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রানুসারে, এর সবটাই দেশের অভ্যন্তরীণ ভোল্টে সংরক্ষণ করছে রাশিয়া। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর স্বর্ণের মাধ্যমে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও 'সুযোগসন্ধানী দেশগুলো' ঠিকই মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যের পথ তৈরি করে নিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এর বাইরে জরুরি তহবিলের জন্য রাশিয়া রিজার্ভ মজুদ বাড়ানোতেও মনোযোগ দিয়েছে। এপ্রিল ও জুনে দেশটি জরুরি রিজার্ভে ১২.৭ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে। নিষেধাজ্ঞার মাঝে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই তহবিল ব্যবহৃত হওয়ার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছে রাশিয়া সরকার।
বিদেশি ঋণ কমিয়ে এনেছে রাশিয়া
সঞ্চয় বাড়ানো ছাড়াও রাশিয়া বিদেশি তহবিল ছাড়াই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছে। গত আট বছর ধরে রাশিয়া কোমর বেঁধে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে চলেছে বলে জানান হাচিনস সেন্টারের সিনিয়র ইকোনমিকস স্টাডিজের ফেলো জিয়ান মারিয়া মিলেস-ফেরেতি। ফিসকাল অ্যান্ড মনেটারি পলিসিতে ৩রা মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেন, রাশিয়া এখন আন্তর্জাতিক বাজারে নিট ঋণদাতা।
ভ্লাদিমির পুতিন ঋণ নিতে পছন্দ করেন না বলে মনে করে রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ওয়েইস। রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ খুবই কম। জেপি মরগ্যানের অনুমান অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ দেশটির ৩৯ বিলিয়ন ডলারের দেনা ছিল। রাশিয়ার মোট জিডিপির মাত্র ১৭ শতাংশ এই বৈদেশিক জাতীয় ঋণ।
তবে এই মুহূর্তে রাশিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঋণ পরিশোধে উপযুক্ত মাধ্যম। নিষেধাজ্ঞার কারণে লেনদেনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান হলেই রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করবে। অন্যদিকে দেশটির নিজস্ব মজুদের মাধ্যমেই বাজেট, ব্যাংক ও করপোরেশনগুলোর চাহিদাপূরণ সম্ভব হবে বলে বিশ্লেষকদের মত।
অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া
আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম তৈরি হওয়ায় রাশিয়া অভ্যন্তরীণভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বৃহত্তম পণ্য উৎপাদক দেশটির অর্থনীতি সহজেই সংকোচিত হবে না বলে জানান বোস্টনভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কনসালটেন্সি লুমিস সেইলসের অ্যানালিস্ট হাসান মালিক।
বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম যা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আবদ্ধ অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে বলে মনে করে হাসান। দেশটি খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, গম ও নিকেল ও প্যালাডিয়ামের মতো ধাতুর বৃহত্তম উৎপাদক।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে তাদের পণ্য ও সেবা নিয়ে রাশিয়া ত্যাগ করলেও স্থানীয় রাশিয়ান বাণিজ্যগোষ্ঠীগুলোই সংস্থাগুলো গ্রহণ করছে ও দেশীয় পণ্যের মাধ্যমে বিদেশি পণ্য প্রতিস্থাপন করছে।
কিন্তু তারপরও রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য আগামী দিনগুলো খুব সহজ হবে না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২২ সালে রাশিয়ার অর্থনীতি ৮.৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকোচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে তা আরও ২.৩ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর এটিই রাশিয়ার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় পতন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়া কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার