ইউরোপ যখন ডানপন্থার দিকে, সেখানে যুক্তরাজ্যে কেন বামকেন্দ্রিক দলের ভূমিধস বিজয় হলো?
সাম্প্রতিক ইউরিপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে ডানপন্থীদের জয়জয়কার হলেও, পাল্টা চিত্র দেখা গেল যুক্তরাজ্যের সাধারন নির্বাচনে। মধ্য-বামপন্থী দল লেবার পার্টি যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ডানপন্থী কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবিতে ভূমিধস জয় পেয়েছে। দলটির নেতা কিয়ার স্টারমার হতে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
গত মাসের ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ডান ও কট্টর ডানপন্থী দলগুলোর রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে ডাপন্থিদের এমন উত্থান হয়েছিল যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ খারাপ ফলের জেরে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পর তাতে জয় পেয়েছে কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি।
এই সপ্তাহে নেদারল্যান্ডে কট্টর ডানপন্থী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধকালীন ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির পর ইতালি বর্তমানে তার সবচেয়ে ডানপন্থী নেতার নেতৃত্বে রয়েছে। এ নির্বাচনী সাফল্য এবং ক্ষমতায় পপুলিস্ট ডানপন্থী নেতাদের উত্থান ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য এখন আর খুব একটা বিস্ময়কর কিছু নয়।
ইউরোপ জুড়ে ডানপন্থীদের উত্থানের পেছনে প্রতিটি দেশেই ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। মন্থর অর্থনীতি, উচ্চ অভিবাসন হার, বর্ধিত জ্বালানি খরচ এবং কার্বন নিরপেক্ষতার হার শূন্যে নামিয়ে আনার মত বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। পপুলিস্ট রাজনীতিবিদরা প্রায়ই জাতীয় সংকটের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দোষারোপ করেন, যা জাতীয় বিতর্কে ক্রমবর্ধমান ইউরোস্কেপটিক অনুভূতিকে [ইউরোপীয় রাজনৈতিক মতবাদ, যা থেকে বিচ্ছিন্নতার পক্ষে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন] আরো উস্কে দেয়।
এখন প্রশ্ন জাগে, ইউরোপ জুরে ডানপন্থীদের উত্থানের মধ্যে কীভাবে যুক্তরাজ্যের সাধারন নির্বাচনে একতি মধ্য-বামপন্থী দিল নিরুঙ্কশ বিজয় পেল?
যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে লেবার পার্টির বিজয় সত্ত্বেও ফলাফল থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ ডানপন্থীরা এখনো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। কনজারভেটিভ পার্টির বড় পরাজয় সত্ত্বেও নির্বাচনী জরিপের প্রত্যাশিত ফলাফলের থেকে দলটি ভালো করেছে।
নাইজেল ফারাজের জনপ্রিয় ডানপন্থী দল রিফর্ম ইউকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। এর আগের নির্বাচনে দলটির একটিও সংসদীয় আসন না থাকা সত্ত্বেও ফারাজ নিজেই এখন নির্বাচনে একটি আসন সুরক্ষিত করেছেন। ফারাজের সাথে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুসম্পর্ক ছিল। ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পেছনে অনেকটাই কৃতিত্ব তার।
নির্বাচনে শুধু একটি আসনই জিতেননি ফারাজ, দলের সহকর্মীদের সাথে মিলে তিনি লেবার নেতা কেয়ার স্টারমারকে চ্যালেঞ্জ করবেন— এমনটাই ধারনা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। যদিও স্টারমারের উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় ফারাজের বিজয় তুলনামূলকভাবে সামান্য, কনজারভেটিভ পার্টির ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করতে পারার সম্ভাবনা তার রয়েছে। এমনকি কনজারভেটিভ পার্টিকে ভবিষ্যতে তিনি আরো ডানপন্থার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন।
মজার বিষয় হলো, ব্রিটিশ রাজনৈতিক পটভূমিতে ফারাজের উপস্থিতি অসাবধানতাবশত ডানপন্থী ভোটকে বিভক্ত করে স্টারমারকে উপকৃত করেছে। ব্রিটিশ রাজনীতি স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে, যেখানে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ভোটদান ব্যবস্থার [এক প্রকার নির্বাচনী ব্যবস্থা যেখানে কেবল একজন প্রার্থী বা একটি দল বিজয়ী হতে পারে] কারণে একটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ সবসময় নির্বাচিত আসনে রূপান্তরিত হয় না।
লেবার পার্টি যেসব নির্বাচনী এলাকায় জয়ী হয়েছে সেখানে রিফর্ম ইউকে-এর শক্তিশালী অবস্থানের অর্থ হলো, পার্লামেন্টে কট্টর-ডানপন্থীদের প্রভাব উপেক্ষা করা কঠিন। সম্ভবত তাদের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে।
যুক্তরাজ্য অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো একই সংকটে ভুগছে। যদি স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, তাহলে ইউরোপের অন্যত্র জনপ্রিয় ডানপন্থার প্রতিই ব্রিটিশ জনগণ আরো আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন বলেই ধারণা করা যায়।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়