হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট কে এই ইব্রাহিম রাইসি?
রোববার (১৯ মে) আজারবাইজান সীমান্তবর্তী এলাকায় জলাধার প্রকল্প উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি (৬৩)। হেলিকপ্টারে তার ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা। দুর্ঘটনায় হেলিকপ্টারের সব যাত্রীই প্রাণ হারিয়েছেন।
মনে করা হচ্ছিল, তিন বছর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া রাইসি ভবিষ্যতে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির উত্তরসূরি হবেন।
এ হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু বড় ধাক্কা হয়ে এল ইরানের জন্য। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের তীব্র বৈরী সম্পর্কের কারণে তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি।
ইব্রাহিম রাইসির ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের নিষেধাজ্ঞা ছিল। ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলার জন্য প্রতিবেশীদের পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দেন রাইসি।
বিচার ব্যবস্থা ও অভিজাত ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ রাইসির।
প্রথম জীবন
ইব্রাহিম রাইসির জন্ম ১৯৬০ সালে, ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশাদ-এ। রাইসির বয়স যখন পাঁচ, তখন তার বাবা মারা যান। তার বাবা ছিলেন ইমাম।
রাইসিও বাবার মতোই ধর্মপ্রাণ ছিলেন। ১৫ বছর বয়সে কুওম ধর্মীয় শিক্ষালয়ে পড়াশোনা করতে যান। ছাত্রজীবনে তিনি পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট শাহ-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অংশ নেন। শেষতক আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন শাহ।
বিপ্লবের পর রাইসি বিচার বিভাগে যোগ দেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তেহরানের পার্শ্ববর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। এছাড়া বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আয়াতুল্লাহ খামেনির অধীনে প্রশিক্ষণ নেন।
১৯৮৩ সালে মাশাদের শুক্রবারের নামাজের ইমাম আহমদ আলামোলহোদার মেয়ে জামিলেহ আলামোলহোদাকে বিয়ে করেন রাইসি। তারা দুই কন্যার জনক-জননী।
১৯৮৮ সালে পাঁচ মাসের জন্য তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কমিটির সদস্য ছিলেন। এই অতীতের জন্য বিরোধীপক্ষের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন রাইসি। ২০০৪ সাল থেকে ১০ বছর তিনি জুডিশিয়াল অথরিটির উপপ্রধান ছিলেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি।
পরে রাইসি ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ সভার উপচেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ ধর্মী নেতা নির্বাচনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এ সভা।
খোমেনির উত্তরসূরি আয়াতুল্লাহ খামেনির অধীনে তরতর করে উচ্চপদে উঠে আসেন রাইসি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই ও জয়
২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্যপন্থি হাসান রুহানির বিরুদ্ধে লড়েন কট্টরপন্থি রাইসি। কিন্তু সেই দফায় সফল হননি। ২০১৫ সালে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেছিলেন রুহানি। এ চুক্তির আওতায়, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করবে, বিনিময়ে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে।
রুহানির স্বাক্ষর করা এ পরমাণু চুক্তির কড়া সমালোচক ছিলেন রাইসি।
২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ৬২.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রাইসি। তবে ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম—৪৮.৮ শতাংশ। এছাড়া বেশ কয়েকজন সংস্কারপন্থি ও মধ্যমপন্থি নেতাকে ওই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে দেওয়া হয়নি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় অনেকেরই ধারণা, ওই নির্বাচনে রাইসির পক্ষে প্রভাব খাটানো হয়েছিল।
ততদিনে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যায় এবং ইরানের ওপর ফের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে ইরানের অর্থনীতি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া করোনা মহামারিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৯৭ হাজার ইরানির মৃত্যু হয়।
১৯৮৮ সালে ইরানে রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কমিটির সদস্য ছিলেন রাইসি। এ কারণে তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনাও রয়েছে।
১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগে ২০১৯ সালে মার্কিন ট্রেজারি রাইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
সংযোগ
ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রাইসির। খোমেইনি ও খামেনি দুজনের সঙ্গেই ছিল মিত্রতার সম্পর্ক।
সরকার, সামরিক বাহিনী ও আইনসভার সব শাখা এবং শাসকশ্রেণির ক্ষমতাধরদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন তিনি।
তবে অংশত নিষেধাজ্ঞার কারণে জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ায় রাইসির নেতৃত্বকালে ইরানে একবার জনবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
২০২২ সালের শেষদিকে নীতি পুলিশের ২২ বছর বয়সি হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর মানুষের বিক্ষোভ আরও বাড়ে। হিজাব না পরার জন্য নীতি পুলিশের মারধরের জন্য মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়।
কয়েক মাস ধরে চলে বিক্ষোভ। বহু নারী প্রতিবাদে তাদের হিজাব পুড়িয়ে বা খুলে ফেলেন, চুল কেটে ফেলেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৫০০ জনের মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ বন্ধ হয়। জাতিসংঘের একটি তথ্য অনুসন্ধানী মিশন এ বছরের মার্চে জানায়, বিক্ষোভ দমাতে হত্যা, অত্যাচার ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ইরান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাইসি
রাইসি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিপক্ষকে জবাব দিতে পিছপা হতেন না।
যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ রাইসি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচির গতি বাড়াবে, তবে তারা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আগ্রহী না।
রাইসি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে। সেইসঙ্গে পশ্চিমের সঙ্গে ইরানের বিরোধও বেড়েছে।
সম্প্রতি এপ্রিলে ইসরায়েলে চালানো ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায়ও সমর্থন দিয়েছেন রাইসি। সিরিয়ার দামেস্কে ইরান্সের দূতাবাসে 'ইসরায়েলের হামলায়' ইরানিয়ান সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ার জবাবে ইসরায়েলে এ হামলা চালিয়েছিল তেহরান। যদিও ইসরায়েল দামেস্কের ওই হামলার দায় স্বীকার করেনি।
ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার বিরুদ্ধে বারবার চড়া কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে ইরান। ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত রাইসির প্রতিটি কথা ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আগ্রহের কেন্দ্রে।
গত কয়েক বছরে ইসরায়েল-ইরানের বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে সিরিয়াতেও। এ সময় বেশ কয়েকবার ইরানের সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইরান।
অনেক বছর ধরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দিয়ে সিরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে ইরান। সামরিক ও কৌশলগত সহায়তা সিরিয়ায় নিজের প্রভাব বাড়িয়েছে তেহরান। সেইসঙ্গে লেবানিজ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকেও সহায়তা দিয়েছে ইরান।
দেশে-বিদেশে নানা চাপ সামাল দিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া রাইসি ছিলেন বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট।
তবে ইরানের সর্বস্তরের প্রভাবশালীদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্কের সুবাদে দ্বিতীয় মেয়াদেও প্রেসিডেন্ট পদে শক্ত প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হওয়ার পথেও এগিয়ে যাচ্ছিলেন ভালোভাবেই।