ভারতের জ্বালানি শিল্পে গোবর যেভাবে মূল ভূমিকায়
প্রতিদিনই প্রায় ৫০ কেজি কাঁচা গোবর সংগ্রহ করেন ভারতের মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা রুকমিনি বাবুরাও কাম্ভার। তার গোবর সংগ্রহের কাজটি কারো কারো কাছে প্রাথমিকভাবে জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রচেষ্টা বলে মনে হতে পারে। আসলে তা নয়, বরং এ কাজের উদ্দেশ্য হলো- বায়োমিথেন গ্যাস তৈরির জন্য এ গোবর ব্যবহার করা। খবর বিবিসির।
রুকমিনি ভারতের একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনের সদস্য। সংগঠনটি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের একটি গ্রামে ছোট্ট একটি আশ্রম পরিচালনা করে।
গত মার্চে আশ্রমটিতে একটি ব্যায়োগ্যাস রিয়্যাক্টর স্থাপন করা হয়। এ রিয়্যাক্টরের মাধ্যমে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রমের রান্নাবান্নার কাজে। তাই এখন আর রান্নাবান্নার জন্য আলাদা করে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে না। এতে অর্থও সাশ্রয় হচ্ছে। অথচ আগে আশ্রমের জন্য প্রতি মাসে ২০ লিটার জ্বালানি কিনতেন রুকমিনি।
এ বিষয়ে রুকমিনি বলেন, 'জ্বালানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এর চেয়ে বায়োগ্যাস একটি ভালো বিকল্প। এর জন্য কেবল জায়গা এবং গরু দরকার। আমাদের দুটোই আছে।'
যদিও এ কাজের জন্য রুকমিনিকে গোবর সংগ্রহ করতে হয়, হাত দিয়ে ধরতে হয়, তবে এতে তিনি কিছু মনে করেন না।
তিনি বলেন, 'ভারতের বেশিরভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিই প্রধান পেশা। তাই গোবর স্পর্শ করা খুব বড় কোনো বিষয় নয়।'
প্রথমদিকে অবশ্য কেউ কেউ তার এই কাজে সায় দেননি।
রুকমিনি জানান, শহরের কিছু নারী যারা এখানে থাকতে এসেছিলেন, প্রথম দিকে গোবরের গন্ধে তারা বিরক্ত হতেন। পরে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং আমাদের সহায়তা করতে থাকেন।
বায়োগ্যাস প্ল্যান্টগুলোতে যে প্রক্রিয়ায় গোবর থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়, তার নাম অ্যানেরোবিক ডাইজেশন। প্রথমে গোবর সংগ্রহ করে পানির সঙ্গে মিশানো হয়। এরপর সেটি একটি বায়ুরোধী ট্যাঙ্কে ঢালা হয়। মূলত তখন থেকেই মূল প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রাকৃতিকভাবে অণুজীব জৈব পদার্থকে ভেঙে ফেলে গোবরকে বায়োগ্যাসে (প্রধানত মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড) রূপান্তরিত করে।
এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন গ্যাসে মিথেন থাকে ৬০ শতাংশ।
সরকারি হিসাব মতে, ভারতের গরুগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন মিলিয়ন টন গোবর আসে। সরকার চায় এসব গোবর ও অন্যান্য কৃষি বর্জ্য মিথেন তৈরিতে ব্যবহার হোক।
বর্তমানে ভারতে মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা হয়ে থাকে। দেশটিতে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন আরও বাড়ছে।
বায়োগ্যাস শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য ২০২৫ সাল থেকে সরকার গ্যাস সরবরাহকারীদের এক শতাংশ বায়োমিথেনের সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস মিশানোর নির্দেশ দিয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে এ হার বেড়ে হবে ৫ শতাংশ।
ভারতের গ্যাস আমদানি কমানোর পাশাপাশি বায়োগ্যাস বায়ু দূষণ কমাতেও সহায়ক হতে পারে। এছাড়াও বায়োরিয়্যাক্টরের কাজ শেষ হওয়ার পর অবশিষ্ট উপাদানটি সার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তায় বড় বড় বায়োরিয়্যাক্টর তৈরি করা হচ্ছে।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় কমপ্রেসড বায়োগ্যাস (সিবিজি) প্ল্যান্টটি উত্তর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লেহরাগাগায় অবস্থিত। এটি ২০২২ সালের শেষের দিকে চালু করা হয়। এটি প্রতিদিন ৩০০ টন ধানের খড় থেকে ৩৩ টন বায়োগ্যাস উৎপাদন করতে পারে।
এদিকে অবস্থানগত কারণে পাঞ্জাবের লুধিয়ানা শহরে মানুষেরা গোবরকে বিপজ্জনক মনে করে থাকেন। শহরটির আশপাশ মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার গরু রয়েছে। এছাড়াও শহরটি দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের একটি কেন্দ্র। কিন্তু ডেইরি ফার্মের মালিকরা গোবরসহ বিভিন্ন বর্জ্য সরাসরি নর্দমায় ফেলে দেন। আর এতে নদীও দূষিত হচ্ছে।
লুধিয়ানায় একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে, যেখানে দিনে ২২৫ টন গোবর প্রক্রিয়া করা সম্ভব। এই প্ল্যান্টে গোবর সরবরাহ না করে যদি এভাবে নর্দমায় ফেলা চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজীব কুমার নামে এক ব্যক্তি আশেপাশের এলাকা থেকে গোবর সংগ্রহের কাজ করেন। তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে লোকজন বুঝতে পারত না যে কেন আমি তাদের কাছে বর্জ্য চাইছি। তারা আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। কিন্তু এখন এই বর্জ্যই তাদের আয়ের একটি পথ তৈরি করেছে।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক