গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা অস্বীকার ইসরায়েলের, তবে প্রমাণ স্পষ্ট: জেরেমি বোয়েন
১৯৯১ সালে প্রথমবার যখন আমি ইরেজ চেকপয়েন্ট দিয়ে গাজায় প্রবেশ করি, তখন একটি শেডে কয়েকজন বিরক্ত ইসরায়েলি সৈন্যে ছাড়া আর কাউকে চোখে পড়েনি।
আইডি চেক করার পর তারা দর্শনার্থীদের কাঁটাতারের একটি খোলা অংশ দিয়ে গাজায় গাড়ি প্রবেশের অনুমতি দেয়।
তারপর ক্রমান্বয়ে ওই ছাউনিটি একটি চকচকে টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। কংক্রিটের দেয়াল, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ইস্পাত গেট এবং কয়েক ডজন সিসিটিভি ক্যামেরা প্রভৃতি দিয়ে নিরাপত্তার চাদড়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত ইরেজ ক্রসিংয়ের মধ্য দিয়ে শুধু খুব বিশ্বস্ত এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্তদের গাড়ি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো। সাংবাদিকদের হেঁটে তাদের ব্যাগ হাতে নিয়ে যেতে বলা হতো।
৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইরেজে হামলা চালায়। তারা নিকটবর্তী সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের হত্যা করে এবং অন্যদের জিম্মি করে। এরপর থেকে এটি ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ছাড়া সবার জন্য বন্ধ রয়েছে।
আইডিএফ'র হামলায় ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন চ্যারিটির সাত কর্মী নিহত হওয়ার পরে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে শান্ত করতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরেজ ক্রসিংকে মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য ফের উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
উত্তর গাজার আনুমানিক তিন লাখ ফিলিস্তিনির কাছে সহায়তা পৌঁছানোর সহজতম পথ এটি।
ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) সতর্ক করে জানিয়েছে, আগামী চার সপ্তাহ বা তার মধ্যে এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
গাজায় জো বাইডেনের মানবিক দূত ডেভিড স্যাটারফিল্ড বুধবার বলেছেন, গাজার ২২ লাখ মানুষের সবাই না হলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন্ন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে।
৭ অক্টোবরের হামলার পরপরই ইসরাইল যে অবরোধ আরোপ করেছিল তার কারণে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
সেসময় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট বলেন, 'আমি গাজা উপত্যকা পুরোপুরি অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না, সব বন্ধ।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা মানুষরূপী পশুদের সঙ্গে লড়াই করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করছি।'
এরপর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইল সীমিত ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর পরিমাণ খুবই অপ্রতুল।
এদিকে ইসরায়েল দাবি করেছে, হামাসের ত্রাণ চুরি ও মজুদ এবং যা অবশিষ্ট ছিল তা বিতরণে জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণে গাজায় দুভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সমর্থকরা দুর্ভিক্ষের কথা বরাবর অস্বীকার করেছেন।
এদের একজন বোয়াজ বিসমাথ নামের এক সংসদ সদস্য আমাকে বলেছিলেন, 'গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি এবং শুধুমাত্র ইহুদিবিদ্বেষের কারণে ইসরায়েল বেসামরিক লোকদের অনাহারে রাখছে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।'
যদিও দুর্ভিক্ষের প্রমাণ স্পষ্ট!
জো বাইডেনকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ইরেজ ক্রসিং এখনও বন্ধ।
কাছে গিয়ে ইরেজ টার্মিনালের দিকে তাকালাম। কিছুতেই এর মধ্য দিয়ে গাজায় ঢোকা যাবে না। ট্রাক তো দূরের কথা, কোনো মানুষকেও আশেপাশে দেখলাম না।
ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার আরেকটি ক্রসিং খোলার ব্যাপারে আলোচনা করছে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণদাতা সংস্থাগুলো বলছে, প্রতিটি দিন গাজার অভ্যন্তরে মানবিক বিপর্যয়ে আটকে পড়া মানুষদের কাছে সহায়তার পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইরেজ বন্ধ করে দেওয়া সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টাকে বিলম্বিত করার কৌশল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, যেসব ইহুদি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় টিকে আছে, তারাও গাজায় সাহায্য পাঠাতে চায় না।
দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করার বিষয়টি মূলত জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী জমি দখলের জন্য আরব ও ইহুদিদের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন দ্বন্দ্বের আরেকটি রূপ।
এই সংঘাত শুধু গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েল ক্রমাগত ফিলিস্তিনের জমি দখল করা এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে হামাসের ইসরায়েলের অস্তিত্বের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে নয়; ওই ভূখণ্ড নিয়ে এই দুইপক্ষের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
গত ছয় মাসের তিক্ততা ও রক্তপাত দুই পক্ষের মধ্যেকার বিভেদকে আরও গভীর করেছে।
যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমি গত ছয় মাসে অনেক ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছি।
ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে কথা বলা কঠিন, অন্তত যখন তারা ইউনিফর্ম পরে থাকে। তবে যখন বেসামরিক জীবনে ফিরে আসে, তখন তাদের সাথে কথা বলা অনেক সহজ।
এছাড়া আইডিএফের মুখপাত্ররাও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানো বার্তাগুলো নিয়ন্ত্রণের কঠোর চেষ্টা করেন।
ছয় মাসের যুদ্ধের পর ইসরায়েলি সৈন্যদের বিশ্বাস এবং উপলব্ধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার এক অবৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টায় আমি দক্ষিণ ইসরায়েলের বেরশেবা শহরে নেগেভের বেন গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। এটি গাজা থেকে মাত্র ২৫ মাইল দূরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর চেইম হামেস আমাকে বলেন, 'তাদের শিক্ষার্থী, কর্মী, শিক্ষক এবং তাদের পরিবারের ১০০ জনেরও বেশি সদস্য ৭ অক্টোবর নিহত বা জিম্মি হয়েছেন।'
এরপর ২০ হাজার শিক্ষার্থী থেকে সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থীকে সংগঠিত করেন তারা।
মি. হামেস বলেন, 'যুদ্ধ সবসময়ই অবশ্যম্ভাবী ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'এখানকার হাসপাতালটি রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে, ক্রমাগত গাজা থেকে আহতদের বহন করে হেলিকপ্টারগুলো এখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে ক্লাস করে। তারা হেলিকপ্টারগুলোর আসা-যাওয়ার শব্দ শুনতে পায় এবং তাদের অনেকেরই বন্ধু এখনও ডিউটিতে রয়েছেন। সবকিছুতে এর প্রভাব পড়ছে।'
আমি তিনজন তরুণের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা কয়েক মাস ধরে গাজায় যুদ্ধ করেছে।
তারা তাদের পুরো নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
তাদের একজন ২৮ বছর বয়সী স্নাতকোত্তর বেন। তিনি টানেল উড়িয়ে দেওয়া একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটে কাজ করেন, মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছেন।
তিনি জানান, যতক্ষণ তিনি সেখানে (যুদ্ধক্ষেত্রে) ছিলেন, ততক্ষণ এটিকে তার ব্যক্তিগত বিষয় বলেই মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, '৭ অক্টোবরের কথা মনে আছে। আমার সব বন্ধু এবং গাজা স্ট্রিপের কিব্বুতজিমের কথা মনে আছে। মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আমার সব বন্ধুরা... কেউ কেউ এখনও জিম্মি। মূল কাজ হচ্ছে এমন যেন আর কখনো না ঘটে তা নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতাসীন সরকারের কথা অনুযায়ী হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা। যাতে আমাদের জনগণ নিরাপদে থাকে।'
কমব্যাট ইউনিটে কর্মরত ২৮ বছর বয়সী আরেক যুবক ওডেডও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এখানে সবাই কোনো না কোনভাবে যা ঘটেছে তার সাথে সম্পর্কিত। সবাই। সবাই অপহৃত কাউকে না কাউকে চেনে।'
প্যারাট্রুপ ব্রিগেডের একটি ইউনিটে কর্মরত ২৫ বছর বয়সী ইলান গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে হামাসের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থনের কথা জানান।
তিনি বলেন, 'অবশ্যই কিছু বেসামরিক লোক আছে যাদের এরসঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, তবে তাদের মধ্যে অনেকেই একেবারে সাধু না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি মনে করি তাদের অনেকেই নির্দোষ নয়, তবে যারা নিরপরাধ তাদের খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি মনে করি সবাইকে আঘাত করা উচিত।'
তিনজন ছাত্র সৈনিকই একমত যে যুদ্ধটি প্রয়োজন ছিল।
ওডেড বলেন, 'আমরা সবাই শান্তি কামনা করি। অবশ্যই আমি যুদ্ধ করার পরিবর্তে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে, আমার বন্ধুদের সঙ্গে কফি খেতে যেতে পছন্দ করি। যুদ্ধে যাওয়া কোনো মজার বিষয় নয়, তবে কখনও কখনও এটি প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। আর এই পরিস্থিতিতে, এটি জরুরি।'
৭ অক্টোবরের হামলার তিন সপ্তাহ পর তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস ইনডেক্স পরিচালিত একটি জরিপ অনুসারে, বেশিরভাগ ইসরায়েলি বলেছেন যে তারা এখন জো বাইডেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতাদের ধারণার বিরোধিতা করেন।
বাইডেন ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্ররা বলেছেন, এই দীর্ঘ সংঘাতের অবসানের একমাত্র উপায় হলো ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
বেন বলেন, এই যুদ্ধের কারণে তার চিন্তাভাবনা বদলে গেছে।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় আপনারা যদি ৬ অক্টোবর আমাকে এই প্রশ্ন করতেন, তাহলে আমিও নিশ্চিতভাবে এই বিষয়ে একমত হতাম। আমি হয়তো বলতাম একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করুন। তাদের সেখানে থাকতে দিন, আমরা এখানে থাকি। আমরা সবাই সহাবস্থান করব এবং সবকিছু সুন্দর হবে। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, আমরা যেমনটা চেয়েছি তারা তেমনটা চায় না।'
ইলান তার কথায় সম্মতি জানান।
তিনি বলেন,'ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা ততক্ষণ পর্যন্ত কার্যকর হবে না যতক্ষণ না তারা (হামাস ও ফিলিস্তিনিরা) আমাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্র থাকার কোনো স্বীকৃতি দেবে। আমি মনে করি দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের অনেকের আসল চাওয়া দুটি রাষ্ট্র নং, বরং একটি রাষ্ট্র, যা হবে শুধু তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র। আর আমাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। অবশ্যই আমি তাদের জন্যও একটি সুন্দর জীবন চাই। আর এই বোধ আসে শিক্ষা থেকে। তাদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হতে দীর্ঘ সময় লাগবে।'
অন্যদিকে, যুদ্ধ সম্পর্কে ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাজায় অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে এই ধারণা তাদের মধ্যে সর্বজনস্বীকৃত।
শিক্ষার কথা বলতে গেলে, গাজায় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইল। এতে শুধু স্থাপনার ক্ষতিই হয়নি, সামগ্রিকভাবে একটি দেশকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ।
উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষাবিদ গাজায় 'শিক্ষাহত্যার' নিন্দা জানিয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। গাজার ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোই ধ্বংস ও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
চিঠিতে ১১ অক্টোবর বিমান হামলা চালিয়ে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা এবং ১৭ জানুয়ারি আল-ইসরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যারাক ও আটক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার পর উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইসরাইলের নিন্দা জানানো হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা ধ্বংসের পাশাপাশি দেশটির কোনো শিশু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় কায়রোতে যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলছে। এই আলোচনায় সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ইসরায়েল ও হামাস উভয়েরই অবস্থান দৃঢ় এবং তারা নিজেদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়তে চায়নি। এটি সবার জন্য দুঃসংবাদ, বিশেষ করে গাজায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক এবং বেঁচে থাকা ইসরায়েলি জিম্মিদের জন্য।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি