আজ বিরল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ! দিন হয়ে যাবে রাত, বাংলাদেশ থেকে কি দেখা যাবে?
২০২৪ সালের প্রথম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দেখা মেলবে আজ সোমবার (৮ এপ্রিল) । মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার লাখ লাখ মানুষ আজ উত্তর আমেরিকা মহাদেশ অতিক্রম করা এ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সাক্ষী হবেন। খবর বিবিসির।
বলা হচ্ছে বিরল এ মহাজাগতিক ঘটনা তিনটি দেশ জুড়ে সমুদ্র পূর্ব দিকে অন্ধকারের একটি সংকীর্ণ পথ তৈরি করবে, দুপুর হয়ে যাবে রাতের মতো অন্ধকার।
মেক্সিকোর দিকে যাওয়ার আগে এই গ্রহণের ছায়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল স্পর্শ করবে স্থানীয় সময় ১১টা ৭ মিনিটে। আর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে দৃশ্যমান হবে স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ২৭ মিনিটে। মেক্সিকোতে পৌঁছানোর পর গ্রহণ কানাডার পূর্ব প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট।
এছাড়া ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, স্পেন, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও আইসল্যান্ডের নির্দিষ্ট স্থান থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে।
পূর্ণগ্রাস এ সূর্যগ্রহণ সরাসরি দেখা যাবে না বাংলাদেশ থেকে। কারণ এ সময় আমাদের এখানে রাত। তবে দেখা যাবে অনলাইনে, সম্প্রচার করবে নাসা।
ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী সোমবার দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নাসা এ ঘটনা লাইভ সম্প্রচার করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ থেকে ৮ এপ্রিল রাত ১১টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত দেখা যাবে এই দৃশ্য। এ ঘটনার লাইভ স্ট্রিম নাসার ইউটিউব চ্যানেলে ও নাসাপ্লাস ওয়েবসাইটে সম্প্রচার করবে। এছাড়া টেক্সাসভিত্তিক ম্যাকডোনাল্ড অবজারভেটরি (McDonald Observatory) নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলেও এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সরাসরি সম্প্রচার করবে।
পূর্ণ গ্রহণটি গড়ে প্রায় ১১৫ মাইল (১৮৩ কিলোমিটার) প্রশস্ত হবে। মহাদেশ অতিক্রম করার সাথে সাথে এটি বিভিন্ন সময় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাবে।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ তখন ঘটে যখন চাঁদ পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে চলে আসে এবং সূর্যের আলোকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে। অবস্থানের কারণে সূর্য আংশিক ঢাকা পড়লে তাকে বলা হয় আংশিক গ্রহণ। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ বিরলতম ঘটনা। বিজ্ঞানীদের মতে, গত ৫০ বছরের মধ্যে এবারের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সবচেয়ে দীর্ঘতম। এ ধরনের বিরল আরেকটি ঘটনা দেখতে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হবে ২০৪৪ সাল পর্যন্ত।
আর এ সুর্যগ্রহণের সাক্ষী হতে গোটা বিশ্ব থেকে উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন লাখ লাখ দর্শনার্থীরা।
বিজ্ঞানীদের কাছে , এই মূল্যবান কয়েক মিনিট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করার জন্য একটি দারুণ সুযোগ। এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা আছে গবেষকদের। গ্রহণের সময় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন, যেমন—রকেট ওড়াবেন সূর্যগ্রহণের পথে, চিড়িয়াখানায় দাঁড়িয়ে প্রাণী পর্যবেক্ষণ করবেন, বিশ্বজুড়ে রেডিও সংকেত পাঠাবেন এবং বিশাল ক্যামেরা নিয়ে মহাকাশে উঁকি দেবেন।
গ্রহণের সময় যখন উত্তর আমেরিকায় অন্ধকার নেমে আসবে, তখন সূর্যের আবহমণ্ডল বা করোনা নিয়ে গবেষণা করার বিরল সুযোগ পাবেন বিজ্ঞানীরা। টেক্সাসের ডালাসে, চিত্রগুলো ধারণ করার জন্য করোনার দিকে যন্ত্রগুলো তাক করে রাখা হবে। সূর্যের এই রহস্যময় অংশটি চৌম্বকীয় প্লাজমা দিয়ে গঠিত এবং এর তাপমাত্রা এক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি।
সৌর বায়ু এবং কেন করোনা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত তা বোঝার চেষ্টা করবেন ওয়েলসের অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাসার গবেষকরা।
'করোনাল ম্যাস ইজেকশন' নামে প্লাজমার যে বিশাল ঝাপটা সূর্য মহাকাশে ছুড়ে দেয় তাও ভালোভাবে দেখতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। এটির কারণে পৃথিবীর উপগ্রহগুলোর ওপর সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
অ্যাবেরিস্টউইথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিউ মরগান বলেন, 'এই চার মিনিটের সুর্যগ্রহণের জন্য প্রচুর অর্থ, সময় এবং যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হচ্ছে।'
সূর্যগ্রহণকে তাড়া করবে দ্রুতগামী জেট
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পৃথিবী থেকে ৫০ হাজার ফুট (১৫ হাজার ২৪০ মিটার) ওপর থেকে ছবি তুলতে ডব্লিউবি-৫৭ জেটকে সূর্যগ্রহণের পথ বরাবর উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
মেঘের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার কারণে তারা আরও কাছে থেকে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, মিস হওয়ার কোনও সুযোগই নেই। তাছাড়া সাধারণত পৃথিবীতে পৌঁছায় না এমন তরঙ্গদৈর্ঘের আরও ভালো ও পরিস্কার ছবি তুলতে সক্ষম হবে জেটটি।
গ্রহণের সময়, নাসার লক্ষ্য সূর্যের করোনার নতুন বিবরণ অধ্যয়ন করা এবং সম্ভবত সূর্য এবং নিকটবর্তী গ্রহাণুগুলোর চারপাশে একটি ধূলিকণার রিং শনাক্ত করা।
বিমানগুলোতে থাকা স্পেকট্রোমিটার নামে একটি যন্ত্র সূর্য থেকে উড়ে আসা সৌর পদার্থের বিস্ফোরণ সম্পর্কে আরও জানতে সহায়তা করবে।
পৃথিবীতে সর্বসাকুল্যে চার মিনিট সময়ের জন্য গ্রহণ পেলেও ঘণ্টায় ৪৬০ মাইল (৭৪০ কিলোমিটার) বেগে উড়তে থাকা বিমানগুলো চাঁদের ছায়ায় ৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড সময় কাটাবে।
রেডিও শোনার আয়োজন
সূর্যগ্রহণের কারণে দীর্ঘ-তরঙ্গ রেডিওর মতো যোগাযোগগুলো ব্যাহত হতে পারে।
সূর্য থেকে আসা শক্তি বায়ুমণ্ডলের ওপরের আয়নোস্ফিয়ার নামের একটি অঞ্চলকে চার্জ করে, যা গ্রহের চারপাশে রেডিও ট্রান্সমিশনকে সহায়তা করে। কিন্তু চাঁদ যখন সূর্যকে আটকে দেয়, তখন আয়নোস্ফিয়ার ও রেডিও ট্রান্সমিশনে প্রভাব পড়ে।
রেডিওতে এটি কী করে তা পরীক্ষা করার জন্য, শত শত অপেশাদার রেডিও অপারেটররা একসাথে এজন্য রেডিও শোনার আয়োজনে যোগ দেবেন। বিশ্বজুড়ে একে অপরকে সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করবেন এবং প্রতিযোগিতা করবেন কে কত বেশি যোগাযোগ করতে পারে!
পেনসিলভানিয়ার স্ক্র্যানটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাথানিয়েল ফ্রিসেলের মতে, এই ফলাফল বিজ্ঞানীদের জরুরি কর্মী, বিমান এবং জাহাজের ব্যবহৃত রেডিও যোগাযোগের পাশাপাশি জিপিএস আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করতে পারে।
ড. ফ্রিসেলের ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী থমাস পিসানো জানিয়েছেন, তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। রেডিও সরঞ্জামসহ ডেস্কে বসে তিনি সংকেত প্রেরণ করবেন এবং বিশ্বব্যাপী যতটা সম্ভব অপারেটরদের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করবেন।
তিনি বলেন, 'আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি নতুন তথ্যের জন্য'।
কচ্ছপ ও গরিলা পর্যবেক্ষণ
নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যাডাম হার্টস্টোন এ সময়টা অবশ্য টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থের চিড়িয়াখানায় কাটাবেন।
তিনি গরিলা থেকে জিরাফ থেকে গ্যালাপাগোস কচ্ছপ পর্যন্ত প্রাণীদের মধ্যে অদ্ভুত আচরণের সন্ধান করবেন। এর কারণ? শুনতে উদ্ভট লাগলেও ২০১৭ সালের গ্রহণের সময় কচ্ছপগুলো হঠাৎ করেই সঙ্গম শুরু করে।
অ্যাডাম বলেন, 'গতবার ফ্লেমিঙ্গোরা একটি সুন্দর কাজ করেছিল। গ্রহণটি যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন ফ্লেমিঙ্গোগুলো তাদের বাচ্চাগুলোকে পালের মাঝখানে জড়ো করে এবং তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ফ্লেমিঙ্গোরা কোনও সম্ভাব্য শিকারী সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল।'
এছাড়া, সূর্যগ্রহণের সময় গরিলাদের সার্কেডিয়ান ছন্দ ব্যাহত হওয়ায় হুট করে ওই সময় তারা ঘুমোতে চলে যায়।
টাউনি ফ্রগমাউথ নামের নিশাচর পাখি অন্ধকারে সাধারণত ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। কিন্তু ওইদিন গ্রহণের সময় ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে খাবারের সন্ধান শুরু করে। তারপর আবার হঠাৎ সূর্যের আবির্ভাবের সাথে সাথে ছদ্মবেশে ফিরে যায়।
তার মতে, আকস্মিক অন্ধকারে অনেক প্রাণী উদ্বিগ্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। তাই এ নিয়ে বিস্তর পর্যবেক্ষণ করবেন তিনি।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন