টানা দ্বিতীয় বছর চীনের জনসংখ্যায় পতন
টানা দ্বিতীয় বছরের ন্যায় জনসংখ্যা কমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে চীন। এই ঘটনা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিকাশ নিয়েও আশঙ্কা তৈরি করেছে। খবর বিবিসির
আজ বুধবার (১৭ জানুয়ারি) চীনের পরিসংখ্যান ব্যুরো জনসংখ্যা পতনের এ তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের শেষে দেশটির মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪০২ বিলিয়নে। ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে যা ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন কমে গেছে।
এমনকি সবশেষ জনসংখ্যা হ্রাসের এই ঘটনা– আগের বছরের চেয়েও দ্বিগুণ হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের শেষে ছয় দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনের জনসংখ্যা কমে যাওয়ার তথ্য জানানো হয়।
তবে দেশটিতে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়তে থাকায় এবং শিশু জন্মহার কমতে থাকায়– জনসংখ্যা হ্রাসকে প্রত্যাশিতই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবারে প্রকাশিত তথ্যমতে, সন্তান জন্মদানের হার কমে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ৬ দশমিক ৩৯- এ নেমে এসেছে; যা পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রতিবেশী – জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতোন উন্নত অর্থনীতির দেশের কাছাকাছি পর্যায়ের।
১৯৮০ সালে চীনের সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক সন্তান নীতি গ্রহণ করে। এরপরের কয়েক দশক ধরেই চীনে জন্মহার কমতে থাকে। পরবর্তীতে জনসংখ্যার ব্যাপক পতন ঠেকাতে ২০১৫ সালে এই নীতি বাতিল করা হয়। এমনকী নাগরিকদের দাম্পত্য জীবন শুরু করতে ও শিশু জন্মদানে উৎসাহ দিতে বিভিন্ন রকমের ভর্তুকি ও আর্থিক সহায়তার মতোন– প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০২১ সালে বিধিমালা আরো শিথিল করে চীন সরকার, এবং দম্পতিদের তিন সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
কিন্তু, এসব নীতি বেশ দেরিতে নিয়েছে চীন। ততোদিনে প্রভাব যা পড়ার তা পড়েছে। এবং, সরকারি নীতির পরিবর্তন আধুনিক শহরবাসী তরুণদের পারিবারিক জীবনে তেমন একটা উৎসাহিত করতে পারেনি। চীনের এসব মহানগরে জীবনযাপনের খরচ যেমন বিপুল, তার ওপর সন্তান পালনের ব্যয় যোগ হবে এমন উদ্বেগ রয়েছে বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীর। ক্যারিয়ারের কথা ভেবেও অনেকে সন্তান নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এদিকে চীনে টানা তিন বছর ধরে ছিল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে যার গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই অবস্থায়, কর্মজীবনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন সন্তান জন্মদানে সক্ষম নাগরিকরা।
বেইজিং নিবাসী ৩১ বছরের এক নারী ওয়াং চেংই বলেন, "আমি ও আমার স্বামী সন্তান নিতে চাই, কিন্তু এখন (লালনপালনের) খরচ বহন করতে পারব না।"
বিবিসিকে তিনি জানান, সন্তান লালনপালনের জন্য তাঁদের দুজনকে আরো তিন বছর ধরে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে। সন্তানের পড়াশোনার খরচটি মাথায় রেখেই এটি করা দরকার। কারণ ভালো স্কুলে পড়ানোর খরচও অনেক।
ওয়াং আরো বলেন, "বয়স বাড়ার আগেই আমি গর্ভধারণ করতে চাই, কারণ এটা আমার স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো। কিন্তু, হাতে যথেষ্ট অর্থ না থাকায়– আমাকে এটা পেছাতে হচ্ছে। এটি খুবই লজ্জাজনক, এনিয়ে দুশ্চিন্তায় মাঝেমধ্যেই আমি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি।"
জনসংখ্যার নতুন তথ্য প্রকাশের পরে অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছেন, শিশু জন্মহার দ্রুত কমে যাওয়ার পেছনে মহামারির অভিঘাতও দায়ী। এখানে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে বিশ্বের যেসব দেশে ব্যাপক অশিল্পায়ন ঘটেছে– চীনের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে চীনের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটি অনেক দ্রুত ঘটছে।
হংকং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা নীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিটেল-বাস্টেন বলেন, "এটি আকস্মিক কিছু নয়। (চীনে) শিশু জন্মহার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিম্ন– তাই এক পর্যায়ে জনসংখ্যা আর বাড়তে পারে না, তখন উল্টো কমতে শুরু করে।"
তিনি আরও বলেন, "(জনসংখ্যায় পতনের) বিষয়টি এখন প্রায় অবধারিত… চীনে জনসংখ্যা স্থবির থাকা অথবা পতনের নতুন একটি যুগ শুরু হয়েছে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান নতুন এই যুগের একটি বছরের তথ্য মাত্র।"
অর্থনীতি নিয়েও সুহালে নেই চীনের সাধারণ মানুষ। ২০২৩ সালে এমন অনেক ঘটনাই বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। মহামারির পরে– আবাসন খাতে গভীর সংকট, ভোক্তা ব্যয় হ্রাস এবং রেকর্ড সংখ্যক তরুণের বেকারত্ব যার মধ্যে অন্যতম। সামাজিকভাবে এসব ঘটনা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
চীনের নাগরিকদের জীবনে এসব বিষয় যে গভীর ছাপ ফেলেছে, বুধবার প্রকাশিত অর্থনৈতিক তথ্যেও সেই চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে মন্থর হয়েছে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। ২০২৩ সাল শেষে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২০ শতাংশ হারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৬ লাখ কোটি ইউয়ানে (সাড়ে ১৭ লাখ কোটি মার্কিন ডলার)।
মহামারির তিন বছরের হিসাব বাদ দিলে ১৯৯০ এর দশকের পরে গেল বছরেই অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল পারফর্ম্যান্স হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ থাকায় চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি রেকর্ড সর্বনিম্ন বা মাত্র ৩ শতাংশ হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসে তরুণদের বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল বলে জানায় চীন, জুনে যা ছিল ২১ দশমিক ৩০ শতাংশ। বেকারত্বের এই রেকর্ড উত্থানের পর চীন মাসিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করা বন্ধ রেখেছিল।
তবে উৎপাদনশীল জনসংখ্যাই হচ্ছে চীনের সাফল্যের চাবিকাঠি। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে যা কমে যাওয়ার চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে। ফলে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে এখন বয়স বাড়তে থাকা কর্মীদের ওপরই বেইজিংকে নির্ভর করতে হবে। একইসঙ্গে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সরকারের স্বাস্থ্য সেবা ও অবসর ভাতা বাবদ ব্যয় বাড়বে। ইতোমধ্যেই তেমনটা দেখাও যাচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনে অবসরে যাওয়া নাগরিকের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়ে ৪০ কোটিতে উন্নীত হবে বলে একটি প্রক্ষেপণে জানানো হয়েছে।
তবে একেবারেই নিরুপায় নয় চীন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও কর্মবাহিনীর এই রুপান্তরকে সমর্থন করার মতো যথেষ্ট সম্পদ ও সময় রয়েছে দেশটির।
অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিটেল-বাস্টেন, "অশিল্পায়ন হওয়া অন্যান্য দেশের চেয়ে ব্যতিক্রম নয় চীন, যারা এখন সেবাখাতের দিকে সরে এসেছে। ফলে এসব দেশের জনসংখ্যা আরো বেশি শিক্ষিত, দক্ষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েছে, যারা কারখানার কর্মী হওয়ার বদলে অন্যান্য ধরনের কাজ করতে চান।"
তিনি আরো বলেন, "চীনের সরকার এই বিষয়ে ভালোভাবেই অবগত, গত এক দশক ধরেই তাঁরা এই পরিবর্তনকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করছেন। আর এটা অব্যাহত থাকবে বলেও প্রত্যাশা রয়েছে।"
দীর্ঘদিন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের শিরোপা ছিল চীনের। কিন্তু, গতবছর সেই স্থান দখল করে ভারত। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা হলো ১ দশমিক ৪২৫ বিলিয়ন।