দোদি ফায়েদ: ডায়ানার মৃত্যুসঙ্গী অ্যান্টিহিরো হেরেছিলেন ব্রিটিশ অভিজাতদের বর্ণবাদের কাছেও
'আমাদের বিশেষ অতিথি কেমন আছেন?' ছেলে দোদিকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করলেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। দোদির ছোট্ট জবাবের পর ছেলেকে বলতে থাকলেন, তাদের বিশেষ অতিথি প্রিন্সেস ডায়ানাকে কীভাবে বিয়ের জন্য রাজি করাতে হবে। আর তা-তে দোদির কপাল কীভাবে খুলে যাবে। রাতারাতি মহাখ্যাতি আর বিত্তের মালিক হবেন তিনি। দোদি ব্রিটিশ রাজপরিবারের জামাই হতে পারলে তিনি তার বাবার সমান হয়ে উঠবেন, বাবার ব্যবসায় অংশীদারত্ব পাবেন — এসব কথাও বলতে ভুললেন না মিশরীয় ধনকুবের মোহাম্মদ আল-ফায়েদ।
নেটফ্লিক্সের দ্য ক্রাউন-এর ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত সিজনের তৃতীয় এপিসোডে ডায়ানাকে নিয়ে দোদি ফায়দে ও তার বাবা মোহাম্মদ আল-ফায়েদের কথোপকথন এটি। তবে যারা আল-ফায়েদকে চিনতেন, তারা বলেন ফায়েদ সিনিয়র কখনো ছেলেকে বিয়ের জন্য চাপ দিতেন না, তা সে যতই সুবিধা ওই বিয়ে থেকে পাওয়া যাক না কেন।
তবে একটা কথা নিশ্চিত যে, এমাদ আল-দিন মোহাম্মদ আবদেল মোনায়েম ফায়েদ ওরফে দোদি ফায়েদকে কখনো নিজের ব্যবসার জন্য উপযুক্ত উত্তরসূরী হিসেবে ভাবেননি মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। এল পাইস-এর সাংবাদিক এবং অভিজাততন্ত্র, সমাজ ও জীবনব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ মার্টিন বিয়াঞ্চি বলেন, বাবা হিসেবে মোহাম্মদ আল-ফায়েদ নির্দয়, স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্বপূর্ণ ছিলেন। 'পয়সার জন্য পরিবারকেও ব্যবহার করেছিলেন তিনি,' বলেন তিনি।
নেটফ্লিক্সের সিরিজে দেখানো ফোনকলটি ১৯৯৭ সালের আগস্টে ঘটেছিল। তার কয়েক সপ্তাহ আগে দোদি মালিবুর বাড়ি গোছাচ্ছিলেন, ও বাড়িতে তার ফিয়ঁসে, মডেল কেলি ফিশারকে নিয়ে ওঠান কথা ছিল দোদির। কিন্তু বাবা আল-ফায়েদ চেয়েছিলেন, ডায়ানার সঙ্গেই ছেলের বিয়ে হোক। তাহলে যে মর্যাদা তিনি গত দুই যুগ ইংল্যান্ডে বাস করে নানা চেষ্টাচরিত্র করেও পাননি, তা খুব সহজেই তার হাতের নাগালে এসে যেত।
১৯৭০-এর দশকে ইংল্যান্ডে এসে বাস করা শুরু করেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। ২৫ বছরের বেশি সময় বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্ট স্টোর ব্র্যান্ড হ্যারডস-এর মালিকানা তার ছিল। এ দোকানের খরিদ্দার ছিলেন ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজ। ফুলহাম এফসি নামক একটি ফুটবল দলও কেনেন আল-ফায়েদ। একসময় উইন্ডসরের ডিউক ও ডাচেসের আবাসস্থল প্যারিসের একটি বিলাসী বাড়িও কেনেন তিনি। এছাড়া স্কটল্যান্ডে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমির মালিকও হন মিশরীয় এই ব্যবসায়ী।
তবে এতকিছুর পরেও বাস্তবতাকে কোনোদিন বদলাতে পারেননি মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজের জীবনাচরণ তাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। এ অভিজাত মর্যাদা নিজেও পেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অভিজাত ইংরেজরা তাকে কখনো সে সুযোগ দিতে চাননি। এমনকি ইংল্যান্ডের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়নি আল-ফায়েদকে। দ্য ক্রাউন-এর গল্পে দেখানো হয়েছে, এ মর্যাদা অর্জনের জন্য ছেলে দোদিই আল-ফায়েদের শেষ আশা হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৮০-এর দশকে এক পোলো টুর্নামেন্টে ডায়ানা অভ ওয়েলসের সঙ্গে মোহাম্মদ আল-ফায়েদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ফায়েদদের পছন্দ ছিল না উন্নাসিক রাজপরিবারের, তাই ওই টুর্নামেন্টে খোদ রানি এলিজাবেথ না এসে তার স্থলে ডায়ানাকে পাঠানো হয়। খেলায় প্রিন্স চার্লসের বিপক্ষে প্রতিযোগিতা করেছিলেন দোদি ফায়েদ। বিয়াঞ্চি বলেন, আল-ফায়েদ ডায়ানার মাধ্যমে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।
লেডি ডি'র জগৎবিখ্যাত বয়ফ্রেন্ড হওয়ার আগে দোদি বাবার খরচে হলিউডে বেশ কয়েকটি সিনেমা প্রযোজনা করেছিলেন। প্রযোজক হিসেবে চ্যারিয়টস অভ ফায়ার (১৯৮১)-এর জন্য ৪টি অস্কারও যেতেন দোদি। এরপর ১৯৮৬ সালের হিট সিনেমা এফ/এক্স-এও কাজ করেন তিনি। ১৯৯১ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের হুক সিনেমার একজন নির্বাহী প্রয়োজক ছিলেন দোদি ফায়েদ। সিনেমাটি সে বছর অস্কারে চারটি নমিনেশন পায়। হুক-এর লন্ডন প্রিমিয়ারেই ডায়ানাকে দেখে প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলেন দোদি।
ছোটবেলা থেকেই বাবার বিত্তের সুবাদে প্রচুর অর্থ আর সুবিধার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন দোদি। সুইজারল্যান্ডের লে রোজি বোর্ডিং স্কুলে পড়েন তিনি। ছিলেন স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমির ছাত্রও (এ স্কুলেও উইলিয়াম ও হ্যারি পরে পড়েছিলেন)। ছোটবেলা থেকেই দরাজ হাত ছিল দোদির। বাবা আল-ফায়েদ সবসময় ছেলের খরচ জুগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন ছেলের কাছ থেকে বিলাসবহুল হোটেলের রুম সার্ভিসের বড় বড় বিল, এমনকি হ্যারডস থেকেও বিল আসতে শুরু করল, সেগুলো পরিশোধ করতে স্রেফ না করে দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ।
দোদি আর ডায়ানা একে অপরের সঙ্গে দেখা করা শুরুর পর পত্রিকাগুলো তাদের নিয়ে উঠেপড়ে লাগল। দোদি ওই মনোযোগ বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু নিজেরা খুব বেশি সময় একসঙ্গে থাকতে পারেননি, একে অপরকে ভালোমতো জানতে পারেননি। তার আগেই প্যারিসের কুখ্যাত ওই দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারান। পাপারাজ্জিদের কাছ থেকে দ্রুতবেগে গাড়ি নিয়ে পালানোর সময় একটি টানেলের ভেতর গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারান চালক।
মোহাম্মদ আল-ফায়েদ সবসময় বলে এসেছিলেন, দোদি-ডায়ানা এংগেজড ছিলেন। তবে ডায়ানার জীবনীকার, সাংবাদিক টিনা ব্রাউনের মতে, 'ডায়ানার দোদিকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না [...] তবে তিনি জানতেন, তাদের এ সম্পর্ক চার্লস ও রাজপরিবারের বাকি সদস্যদের ক্ষুব্ধ করবে।'
আল-ফায়েদের মুখপাত্র মাইকেল কোল জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর রাতে দোদি ও ডায়ানা একে অপরকে উপহার দিয়েছিলেন। ডায়ানা দোদিকে দিয়েছিলেন তার বাবার একটি কাফলিংক। আর দোদি ডায়ানার জন্য কিনেছিলেন রেপোসি কোম্পানির একটি চোখধাঁধানো হীরার আংটি।
ডায়ানার দুই পুত্র যুবরাজ উইলিয়াম ও হ্যারিও দোদির সঙ্গে তার মায়ের সম্পর্কে কখনো মেনে নেয়নি। পুরো পরিস্থিতিকেই নাটকীয়ভাবে প্রকাশ করেছেন নেটফ্লিক্সের চিত্রনাট্যকারেরা। তবে সেখানে বেশ স্পষ্ট করেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, হাল ফ্যাশনের একজন বিদেশির জন্য কাঠিন্যেভরা ইংরেজ অভিজাত সমাজে খাপ খাওয়ানো কতটা কঠিন ছিল।
দোদি ও ডায়ানার মৃত্যু আল-ফায়েদকে আবারও ব্রিটিশ রাজপরিবার ও অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আল-ফায়েদ দাবি করেন, ডায়ানা যেন কোনো মুসলমানকে বিয়ে করতে না পারেন, তাই এ দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। দুর্ঘটনার পর সবাই ডায়ানার মৃত্যু নিয়েই শোক শুরু করলেন; তার সঙ্গে যে আরও দুই জন — দোদি ও গাড়ির চালক হেনরি পল — নিহত হয়েছিলেন তা যেন সবাই ভুলেই গিয়েছিলেন।
দোদির মৃত্যুর পর আল-ফায়েদ শেষবারের মতো ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেবারও তার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। দুর্ঘটনার ছয় বছর পর ২০০৩ সালে হাল ছেড়ে দেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। ছেলেকে হারিয়েছেন, তার ওপর সেই সময় ইংল্যান্ডে তার ট্যাক্স সুবিধাও শেষ হয়ে যায়। তিনি ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ সমাজের উচ্চবিত্তরা মজ্জাগতভাবেই বর্ণবাদী। ইংল্যান্ডের মাটিতে ৩৫ বছর কাটানোর পর অবশেষে তিনি সেখানকার পাট চুকিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২০১০ সালে কাতারের রাজপরিবারের কাছে হ্যারডস বিক্রি করে দেন মোহাম্মদ আল-ফায়েদ। ২০১৩ সালে ফুলহাম এফসির মালিকানাও ছাড়েন। দোদির ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট ৯৪ বছর বয়সে মারা যান এ ধনকুবের।