জাপান যেভাবে ভূমিকম্পকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখল
১৩ বছর আগে জাপানে হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয় ফুকুশিমার পারমাণবিক চুল্লি। সেই দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি এখনও জাপানিদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সোমবার (১ জানুয়ারি) জাপানের ইশিকাওয়াতে হওয়া আরেকটি ভূমিকম্পের পর সুনামির সাইরেনের শব্দ তাদের মনে আবার উদ্বেগ তৈরি করে — আগের বারের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তো!
ভূমিকম্প জাপানের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি যখন প্রথম এখানে আসি তখন মৃদু ভূমিকম্পেও সতর্ক হয়ে ভবনের বাইরে চলে যেতাম। ঘুমন্ত অবস্থায় আতঙ্কে থাকতাম কখন ভূমিকম্প হয়। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
তবে তারপরও একটি চিন্তার কারণ থেকেই যায়। শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে এর পরিণতি কী হবে কিংবা আমার বিল্ডিং কি আদৌ ভূমিকম্প সহ্য করার মত ক্ষমতা রাখে কি না — এসব চিন্তা ভাবায় আমাকে।
২০১১ সালের ১১ মার্চে হওয়া ভূমিকম্পের ভয়াবহতা পুরো বিশ্ববাসী দেখেছে, এই প্রজন্মের জাপানিদের মনে তখন থেকেই ভয় কাজ করে। ওইদিন মাত্র দুই মিনিটের ভূমিকম্পে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় পুরো জাপান। ভূমিকম্পের ৪০ মিনিটের মধ্যেই প্রথম সুনামি আঘাত হানে, জাপানের উত্তরপূর্ব উপকূল বরাবর শহরগুলোকে গ্রাস করে। সেন্ডাইয়ের ওপর দিয়ে চলা একটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সেদিন পুরো ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
পরের দিন আরও খারাপ সংবাদ পাওয়া যায়। ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লি গলতে শুরু করে। ফুকুশিমার আশপাশে থাকা হাজারো বাড়িঘর খালি করার আদেশ আসে, এমনকি টোকিও নিয়েও শঙ্কার উদয় হয়।
ওইদিনের ঘটনা আমার মনে এক ধরনের ভয়ের সৃষ্টি করে। আমি টোকিওতে কয়েকমাস ধরে নতুন থাকার জায়গা খুঁজতে থাকি। আমার স্ত্রী নদী থেকে দূরে, শক্তিশালী বেডরকসহ অঞ্চলগুলো খুঁজতে থাকে ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র ব্যবহার করে। সে সাফ জানিয়ে দেয়, ১৯৮১ সালের আগে নির্মিত কোনো ভবনে সে থাকবেই না।
১৯৮৫ সালে নির্মিত একটি ভবনে ওঠার পর আমরা সেখানে জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য খাবার ও পানি সংরক্ষণ করে রাখা শুরু করি। এগুলোকে একটি কার্টনের বাক্সে করে বাথরুমের সিঙ্কের নিচে মজুত করে রাখতাম।
২০১১ সালের এই আতঙ্ক ও বিভীষিকা এই সোমবারেও হয়তো ফিরে আসত। কিন্তু এই ভূমিকম্পকে জাপান সফলভাবেই মোকাবিলা করেছে।
জাপান তীব্রতা (ম্যাগ্নেটিউড) দিয়ে ভূমিকম্পের পরিমাপ করে না। মাটি কতটা কেঁপে ওঠে তার ওপর ভিত্তি করে পরিমাপ করে। এ স্কেল ১ থেকে ৭ পর্যন্ত যায়। সোমবার ইশিকাওয়াতে কম্পন সর্বোচ্চ – ৭ আঘাত করে। এ ভূমিকম্পে সড়ক ও সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হয়েছে ব্যাপক ভূমিধসও। কিন্তু অধিকাংশ ভবন এখনও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
তোয়ামা এবং কানাজাওয়া বড় শহরগুলোর জীবনযাত্রায় ইতোমধ্যে এক ধরনের স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে।
আমি কাছের শহর কাশিওয়াজাকির এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সে বলল, "এটি সত্যিই ভয়ংকর ছিল, এখন পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি। আমাদের উপকূল থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন বাড়িতে ফিরে এসেছি এবং সবকিছু ঠিক আছে।"
এত শক্তিশালী ভূমিকম্পেও আহামরি কোনো ক্ষতি না হওয়ার জন্য জাপানের আধুনিক প্রকৌশলব্যবস্থাকে সকল কৃতিত্ব দিতে হবে। জাপানের টোকিওতে ১৯২৩ সালের শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর তারা তাদের নগর পরিকল্পনায় বিভিন্ন পরিবর্তন আনে, পুরো শহরের আবাসন ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজায় তারা।
১৯২৩ সালে গ্রেট কান্টো ভূমিকম্প টোকিওর বেশ কিছু অংশকে সমতল করে দেয়। এরপরই জাপান তাদের প্রথম ভূমিকম্প-প্রতিরোধী বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেয়। ভবনগুলোকে ইস্পাত এবং কংক্রিট দিয়ে শক্তিশালী করা হয় এবং কাঠের ভবনগুলোতে মোটা বিমের ব্যবহার করা শুরু হয়।
এ পদক্ষেপগুলো আস্তে আস্তে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করতে শুরু করে। ২০১১ সালে যখন ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তখন টোকিওতে কম্পনের মাত্রা ছিল মাত্র ৫। এটি ১৯২৩ সালের টোকিওতে হওয়া গ্রেট কান্টো ভূমিকম্পের সমান। কিন্তু ২০১১ সালে হওয়া ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ সুনামি, ভূমিকম্প নয়। ভূমিকম্পে খুব একটা ক্ষতিসাধন হয়নি।
ইশিকাওয়ায় হওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ছবিগুলোতে কিছু ক্ষতি দেখা গেলেও তা খুবই নগণ্য। জাপান এর আধুনিক ভবন নির্মাণকৌশল ও উন্নত প্রকৌশলের কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গার তুলনায় ভালোভাবে ভূমিকম্প মোকাবিলা করে।
রুপার্ট উইংফিল্ড-হায়েস: বিবিসি'র সাবেক টোকিও প্রতিনিধি