ইসরায়েলের এই যুদ্ধ কি 'গাজার শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'?
গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রতি ১৫ মিনিটে একজন শিশু নিহত হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে একটি ফিলিস্তিনি এনজিও।
হামাসের হামলার পাল্টা জবাবে গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল বোমা হামলা চালাচ্ছে। চলমান এ হামলায় প্রতিদিন একশোরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রোববার (২২ অক্টোবর) জানিয়েছেন, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় ৫,০৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে; এরমধ্যে রয়েছে ২,০৫৫ শিশু।
দ্য ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-প্যালেস্টাইন (ডিসিআইপি)-র একজন মুখপাত্র বলেছেন, "আমরা বাস্তবে একটি গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি।"
এমনকি ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত ১৪০০ ইসরায়েলির মধ্যে কমপক্ষে ১৪ শিশু রয়েছে বলে জানা গেছে। হামাসের হাতে বন্দী প্রায় ২০০ জনের মধ্যেও শিশু রয়েছে। তবে, ইসরায়েল হামাসের হামলায় নিহত সবার তথ্য প্রকাশ করেনি।
শিশুরা কি যুদ্ধে আইনতভাবে সুরক্ষিত নয়?
হ্যাঁ। আইনতভাবেই শিশুরা যুদ্ধে সুরক্ষিত। ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনের অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সশস্ত্র সংঘাতের বিধি পাস করা হয়। এতে বলা আছে, যুদ্ধের সময় শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং তাদের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে।
হলোকাস্টের সময় ইউরোপে দেড় মিলিয়ন ইহুদি শিশু নিহত হওয়ার মাত্র দুই বছর পর ইসরায়েল ১৯৫১ সালে কনভেনশনের বিধিগুলোর স্বীকৃতি দেয় করে। কিন্তু ইসরায়েল ৪র্থ জেনেভা কনভেনশনকে স্বীকৃতি দেয় না। ৪র্থ কনভেনশনে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইরত বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলা আছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে দখলকৃত ভূমি বলে মনে করে না।
গাজায় সামরিক শক্তির অসম ব্যবহারকে ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করার একটি বৈধ উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে। আর তাই হামলায় শিশুসহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু যুদ্ধাপরাধ নয় বলে দাবি ইসরায়েলের।
যুদ্ধ শিশুদের উপর কী প্রভাব ফেলছে?
৩০ বছর বয়সী একজন মা আল জাজিরাকে বলেছিলেন, তার ৮ বছর বয়সী ও ২ বছর বয়সী দুই বাচ্চাই বিমান হামলার পর থেকে থেকে বমি করছে। যা অতি মাত্রায় ভয়ের একটি প্রতিক্রিয়া।
এই দুই শিশুর মতোই অবস্থা গাজার ৯৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি শিশুর, যারা যুদ্ধের মানসিক প্রভাব নিয়ে বেঁচে থাকছে প্রতিদিন।
ফিলিস্তিনি মনোবিজ্ঞানী ড. ইমান ফারাজাল্লাহর লেখা একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া শিশুদেরকে মানসিক, আবেগজনিত ও আচরণগতভাবে উচ্চ মূল্য দিতে হয়।
অনেক শিশুই অস্থিরতা বা হিংসাত্মক আচরণ প্রদর্শন করে।
বড় ছেলে কুসায়কে (১৩) নিয়ে উদ্বিগ্ন চার সন্তানের মা, গাজা শহরের বাসিন্দা সামাহ জাবর (৩৫)। তিনি আল জাজিরাকে বলেন: "সে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং আজকাল অন্যদেরকে প্রচুর মারধর করে। যেকোন শব্দেই সে লাফিয়ে ওঠে। কেউ জোরে কথা বললে সে সহ্য করতে পারেনা। এমনকি কেউ মজার ছলে বললেও সে তা সহ্য করতে পারেনা। আমি ওকে সবসময়ই বলি, এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।"
অনেক শিশু, এমনকি কিশোররাও তাদের মা ছাড়া অন্য রুমে যেতে ভয় পাচ্ছে।
স্কুলগুলোতে কী প্রভাব পড়ছে?
অবিরাম বোমা হামলার চলায় গাজায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। এখন বেঁচে থাকাই একমাত্র লক্ষ্য।
জাতিসংঘ বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীকে বিভিন্ন স্কুল ও অন্যান্য ভবনে আশ্রয় দিচ্ছে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজায় ২৭৮টি স্কুল পরিচালনা করে। তারা জানিয়েছে, ইসরায়েলি বোমা হামলায় কমপক্ষে চারটি স্কুল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে।
বোমা হামলায় গাজার আল-ফাখুরা স্কুলে ফিলিস্তিনিদের জন্য বৃত্তি প্রদানকারী এডুকেশন অ্যাবাভ অল (ইএএ) ফাউন্ডেশন মঙ্গলবার ধ্বংস হয়ে গেছে।
ইএএ একটি বিবৃতিতে বলেছে, "সম্মিলিত শাস্তি, প্রতিশোধ, এবং বেসামরিক নাগরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামোর উপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন, এবং যদি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় তাহলে তা যুদ্ধাপরাধ।"
খাদ্য ও পানির অভাব শিশুদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
গাজায় ইসরায়েলের সম্পূর্ণ অবরোধের অর্থ হলো, এই অঞ্চলে কোনো খাদ্য বা পানীয় জল প্রবেশ করতে পারবে না। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজায় পানির সরবরাহ পুনরায় চালু করেছে।
এদিকে ফিলিস্তিনিরা বলেছে, বিদ্যুৎ না থাকায় পানির পাম্প চালানো যাচ্ছে না। ফলে পানির সংকটও কাটছে না।
খাদ্য এবং পানিয় জল দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ায় গাজাবাসীরা তাদের সন্তানদের জন্য সামান্য একটু পানি সরবরাহ করাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
শিশুদের ডিহাইড্রেশনের ঝুঁকি বেশি থাকে। এরমধ্যে অপুষ্টিতে থাকায় এর আরও গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে শিশুর দেহে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) জেরুজালেম-ভিত্তিক এক পুষ্টিবিদ আল জাজিরাকে বলেছেন, পানির স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো না থাকায় শিশুরা ডায়রিয়াজনিত রোগের উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণও এটি।
খাদ্যের অভাবে শক্তি কমতে থাকলে অনাহারে মৃত্যুও হতে পারে।
এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি কী?
গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য মেডিকেল এইডের সাথে কাজ করা ব্রিটিশ ফিলিস্তিনি সার্জন গাসান আবু-সিত্তা বলেন, যারা এই যুদ্ধে বেঁচে যাবেন, তাদেরকে তাদের পরিবারের বাকি সদস্যদের ছাড়াই বেঁচে থাকা শিখতে হবে।
তিনি এই যুদ্ধকে 'শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' বলে অভিহিত করেছেন।
ডিসিআইপির গবেষক ড. মোহাম্মদ আবু রুকবেহ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, "এই যুদ্ধে শুধু নিহতদেরকেই আমরা হারাবো না। বরং বেসামরিক নাগরিক ও শিশুদের উপর যে বিপর্যয়কর মানসিক প্রভাব পড়বে, সেটিও বহন করতে হবে আমাদেরকে।"
সামনেই কি যুদ্ধবিরতি সম্ভব?
ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলার মধ্যে সীমান্ত বন্ধ থাকায় সেভ দ্য চিলড্রেন সহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
ইউনিসেফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "গাজায় শিশু এবং বেসামরিকদেরকে জরুরি সাহায্যের অনুমতি দেওয়ার জন্য অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং মানবিক প্রবেশাধিকার এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।"
"একটি শিশু কেবলই একটি শিশু। শিশুদের সর্বদা সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং কখনই আক্রমণের শিকার হতে দেওয়া যাবে না।"