গাজা হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ঘটনা যেভাবে বদলে নতুন আখ্যান তৈরি হলো
গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে মঙ্গলবার বিস্ফোরণের পর অন্তত ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় সময় ৭টা ৩০ মিনিটে এই হামলা হয়। যুদ্ধের দামামার মধ্যে এই হামলা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া এসেছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল; উভয় পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করেছে। উভয় পক্ষই হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পাশাপাশি অনলাইনেও বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে পড়ছে এবং ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে।
ইসরায়েল দাবি করেছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদ এই হামলার জন্য দায়ী। তবে অনেকে বিশ্লেষক এই দাবি বিশ্বাস করেননি। কারণ হামলার পর ইসরায়েলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল একরকম। কিন্তু পরে তা বদলে যায়। ফলে ইসরায়েলের সর্বশেষ দাবি নিয়ে জোর সংশয় দেখা দেয়।
ইসরায়েল যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সহকারী হানানিয়া নাফতালি এক্স (সাবেক টুইটার) এ পোস্ট করেন, 'গাজার একটি হাসপাতালের মধ্যে হামাস 'সন্ত্রাসীদের' ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী।
রয়টার্স হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলা লিখে নিউজ করে। সেটি শেয়ারও দেন নাফতালি। তবে আগের সেই পোস্ট ডিলেট করেন তিনি। পরে ১০টা ৫৮ মিনিটে তিনি ক্ষমা চেয়ে পোস্ট করেন যে, 'ইসরায়েলি সেনাবাহিনী যেহেতু কোনো হাসপাতালে বোমা হামলা চালায় না। আমি ধরে নিচ্ছি যে, ইসরায়েল সম্ভবত গাজায় হামাসের কোনো ঘাঁটিতে হামলা করেছে।'
অথচ কিছুক্ষণ আগে, রাত ৯টা ০৪ মিনিটে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পোস্ট করে দাবি করে যে, ইসলামিক জিহাদের একটি লক্ষ্যচ্যুত ক্ষেপণাস্ত্র হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। পোস্টে লেখা হয়, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শত্রুপক্ষ ইসরায়েলের দিকে এক ঝাঁক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে সেটি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে হাসপাতালে পড়ে এবং পরে বিস্ফোরিত হয়।
তবে এই পোস্টটি এডিট করা। আগের পোস্টে একটি ভিডিও যুক্ত করা ছিল। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভিজ্যুয়াল তদন্ত দলের সাংবাদিক আরিক টোলার ভিডিওর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দাবি করেন, বিস্ফোরণের ৪০ মিনিট পর সেই ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল।
এসময় নেতানিয়াহুর মুখপাত্র তাল হেনরিখ মন্তব্য করেন, ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালের হামলা চালায় না। তিনি বলেন, আমরা কেবল হামাসের শক্ত ঘাঁটি, অস্ত্রে ডিপোকের লক্ষ্যবস্তু করি।
কিন্তু সে রাতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতিতে তুলে ধরা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর থেকে গাজার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলিতে ৫১টিরও বেশি হামলা হয়েছে। ১৫ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর মৃত্যু হয়েছে এবং ২৭ জন আহত হয়েছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ২২টি হাসপাতালের ২,০০০ জনের বেশি রোগী অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয়। কারণ তারা বোমা হামলা জোরদার করার চেষ্টা করছিল। গাজার একজন জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, বিস্ফোরণের কয়েকদিন আগে আল-আহলি আরব হাসপাতালে হুশিয়ারি হিসেবে দুটি আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করে ইসরায়েল।
পশ্চিম তীর ও গাজার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিনিধি রিচার্ড পিপারকর্ন বলেন, এখন এমনকি একটা হাসপাতালও আর নিরাপদ জায়গা নয়।
কি 'প্রমাণ' আছে?
ইসরায়েল হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি ভিডিওতে সংগৃহীত 'প্রমাণ' হাজির করে। সেটি পোস্ট করেন নেতানিয়াহু। সেখানে দেখানো হয়, 'আর্মির বোমায় সাত থেকে নয় মিটার পর্যন্ত গর্ত সৃষ্টি হয়। আর হাসপাতালের ভিডিওতে দেখানো হয় যে, সেখানে কোনো দৃশ্যমান চিহ্ন বা গর্তের প্রমাণ মেলেনি। ভবনগুলির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি।'
আরেক পোস্টে নেতানিয়াহু লেখেন, পুরো বিশ্বের জানা উচিত যে, গাজায় থাকা বর্বর সন্ত্রসীরাই গাজায় হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল বাহিনী নয়।
বিশ্লেষকদেরও দিয়েও ইসরায়েলিরা এটা প্রচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, ভূমিতে থাকা বিস্ফোরক থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি সমর বিশ্লেষক ডেভিড লিসভসেভ বলেন, এটি আকাশ থেকে ছোড়া কোনো বোমা নয়। এটি ভূমিতে থাকা বিস্ফোরক। মনে হচ্ছে হামাসই গাজার জনগণের জন্য এই দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে।
ইউএস সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিসের এক বিশ্লেষক হাসপাতালের পার্কিং এলাকার ছবি শেয়ার করে লেখেন, চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটাই যদি হয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তাহলে বলব, বিমান হামলার সম্ভাবনা কমই। বরং কোনো রকেট হয়তো লক্ষ্যচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে। পরে কোনভাবে বিস্ফোরিত হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি কথিত হামাস কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি কথোপকথনের একটি রেকর্ডিং অনুবাদ করেন, ওই কথিত রেকর্ডিংয়ে দুইজনকে হাসপাতালে লক্ষ্যচ্যুত রকেট নিয়ে কথা বলতে শুনা যায়।
রেকর্ডিংকে অনেকের কাছে অতি স্পষ্ট বলে মনে হয়। এক সাংবাদিক ইসরায়েলি বাহিনীর মুখপাত্র হাগারিকে রেকর্ডিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ এসব বিষয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর অতীত ইতিহাস নিখুঁত নয়।
প্রশ্নে জবাবে হাগারি স্বীকার করেন যে সেনাবাহিনী আগেও মিথ্যে প্রচার করেছিল, কিন্তু এখন বিষয়টি ভিন্ন।
কি নিয়ে সংশয়?
আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ এর মৃত্যুর পর অনেকে ইসরায়েলি সরকার ও বাহিনীকে আর সেভাবে বিশ্বাস করেন না। ইসরায়েলি সরকার প্রথমে সাংবাদিকের মৃত্যুতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। তারপর কয়েকটি স্বাধীন তদন্তে যখন উঠে আসে যে, ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলি সেনার পক্ষেই তাকে গুলি করা সম্ভব। তখন ইসরায়েলি সরকার স্বীকার করে নেয়।
শিরিনের মৃত্যুর পর নাফতালি ব্যানেট তার হত্যার জন্য ফিলিস্তিনকে দায়ী করে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন, আমরা যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছি, তাতে মনে হচ্ছে যে সশস্ত্র ফিলিস্তিনিরা সাংবাদিকের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর জন্য দায়ী।
পরে অবশ্য স্বীকার করে যে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত শিরিন আবু আকলেহ 'দুর্ঘটনাক্রমে' হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো সামরিক তদন্ত হয়নি।
গাজায় অবরুদ্ধ মানুষের ওপর ইসরায়েলির হামলার নির্মমতার কারণেও সংশয় আরো বাড়ছে। ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির এক্সে লেখেন, হামাস যতক্ষণ না জিম্মিদের মুক্ত করে ততক্ষণ গাজায় শত শত টন বিস্ফোরক ছোড়া উচিত। এবং এক আউন্স মানবিক সহায়তাও দেওয়া হবে না।
এছাড়া হামলার পর নেতানিয়াহুর টুইট থেকে একটি লাইন ডিলেট করা হয়। যেখানে লেখা ছিল,'এটি আলোকিত বনাম অন্ধকারাচ্ছন্ন শিশুর লড়াই, মানবতা এবং জঙ্গলের রাজত্বের লড়াই'। যা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের কথার প্রতিধ্বনি বলা যায়, যিনি ফিলিস্তিনের বলেছিলেন, 'মানুষরূপী পশু'।