হামাস-ইসরায়েল লড়াই আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হলে তার জন্য কতটা প্রস্তুত মধ্যপ্রাচ্য?
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আচমকা আক্রমণের পর ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনী গাজা উপত্যকায় তীব্র পালটা হামলা শুরু করেছে। এ সংঘাতের পর মধ্যপ্রাচ্যে আরও বিস্তৃত পরিসরে, বহুমুখী লড়াইয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান এবং এর ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া ও সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে। তারই ফলস্বরূপ ইসরায়েল এখন তিন–চারমুখী যুদ্ধের আশঙ্কার মুখে রয়েছে। এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে গাজা এ পশ্চিমতীরের হামাস ও প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক জিহাদ, তাদের সম্পূরক হিসেবে থাকতে পারে লেবানন ও সিরিয়ার হিজবুল্লাহ ও পিআইজে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রকেট হামলা করেছে। জবাবে ইসরায়েলও পালটা হামলা করেছে হিজবুল্লাহর অবস্থানে। চলমান সংঘাতে দ্বিতীয় আরেকটি ফ্রন্ট তৈরি করার আগে হিজবুল্লাহকে 'দ্বিতীয়বার ভাবতে' বলেছে পেন্টাগন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে এটি ইসরায়েলকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। দেশটি ইতোমধ্যে ইএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ভূমধ্যসাগরের দিকে পাঠিয়েছে। এছাড়া ইসরায়েলের কাছাকাছি সমুদ্রে আরেকটি নৌবহর পাঠানোর চিন্তাও করছে বলে শোনা যাচ্ছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হিজবুল্লাহ বা ইসরায়েল কেউই এ মুহূর্তে বড় কোনো আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না। বৈরুতে কার্নেগি মিডল ইস্ট-এর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মাইকেল ইয়াং বলেন, 'আমার মনে হয়, উভয় পক্ষই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত সহিংসতা ও প্রাণহানি মেনে নিতে প্রস্তুত। কোনো পক্ষই আদতে চায় না এ লড়াই আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ুক।'
তবে এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ খেলা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেকোনো সময়ই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ইরান এবং লেবানন, ইরাক ও ইয়েমেনে ইরানের শিয়া প্রক্সিগোষ্ঠীগুলো শনিবারের হামলাকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছে। এ হামলার এমন জবাব দেওয়া হবে যা শত্রুরা কয়েক দশক ধরে মনে রাখবে, এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তবে জেরুজালেম স্থল আক্রমণ শুরু করলে ইসরায়েলকে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হতে পারে।
হামাসের সশস্ত্র শাখা আল কাসাম ব্রিগেড ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। এ ব্রিগেডের প্রধান কমান্ডার মোহাম্মেদ দেইফ লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের মিত্র সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের লড়াইয়ে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাকি ও ইয়েমেনি সশস্ত্রগোষ্ঠীগুলো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বাইডেন প্রশাসন যদি ইসরায়েলকে সমর্থনের উদ্দেশ্যে এ লড়াইয়ে নাক গলায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনায় মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালাবে তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লেবাননের হিজবুল্লাহ এ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার পর যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যাবে। এবং এতে গত ৫০ বছরে নজিরবিহীন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ইসরায়েল।
এছাড়া এ যুদ্ধের খরচ ও রাজনৈতিক মদতের কথাও ভাববার বিষয়। করোনা মহামারির কারণে খাদ্য ও জ্বালানির দাম অস্থিতিশীল। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক অর্থনীতিও এখন অনিশ্চিত পর্যায়ে রয়েছে।
লেবাননের অনেক রাজনীতিবিদ ইসরায়েল-হামাস লড়াইয়ে তাদের দেশকে জড়ানোর বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তাদের মতে, প্রলম্বিত অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে স্থিতিশীলতা ও একতাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদাল্লাহ বুহাবিব হিজবুল্লাহ যেন বাধ্য না হলে এ লড়াইয়ে যোগ না দেয় তার পুনর্নিশ্চয়তা চেয়েছেন। অন্যদিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি নিরাপত্তা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননের প্রেসিডেন্টবিহীন সরকারের হিজবুল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর কোনো প্রভাব রাখার ক্ষমতা নেই। তবে তারা মনে করেন, ইসরায়েলে হামাসের বিরুদ্ধে কতটা শক্ত লড়াই দাঁড় করাবে তার মাত্রার ওপর হিজবুল্লাহর এ লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নির্ভর করবে।
হামাসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার ইসরায়েলি চেষ্টা মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে। কার্নেগি মিডল ইস্ট-এর ইয়াং বলেন, ইসরায়েল যদি হামাসের অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, তাহলে আমরা ধারণা করতে পারি যে হিজবুল্লাহ তা রোধ করতে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।
'কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ইসরায়েলকে কম প্রাণহানিতে সীমাবদ্ধ থেকে পুরো গাজা দখল করতে হবে। আর তার জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হাজার হাজার হামাস সদস্যকে আটক করতে হবে।'
'এ কাজটা দারুণ চ্যালেঞ্জিং। আমার তো মনে হয় না ইসরায়েল এটা করতে পারবে। গাজায় এভাবে আটকা পড়া তাদের জন্য সবচেয়ে বাজে দৃশ্যপট। আর ইরানিরা ঠিক এটাই চায় — ইসরায়েলকে গাজার রাস্তায় নিয়ে এসে লড়াইয়ের মুখে ফেলা,' ইয়াং আরও বলেন।
আবার ইসরায়েল যদি মার্কিন মদতপুষ্ট হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যায় [হামাসের আক্রমণে ইরানের জড়িত থাকার সন্দেহে], তাহলে পালটা জবাব হিসেবে হরমুজ প্রণালিতে তেল পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে ইরান। আর তা ঘটলে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।
আবার কেউ কেউ আশা প্রকাশ করেছেন, হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার চূড়ান্ত কোনো লড়াই হলে তার ফলাফল হিসেবে ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধপরবর্তী ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মতো কিছু একটা ঘটতে পারে, যার মাধ্যমে চলমান এ সংঘাতেরও কোনো সমাধান পাওয়া যাবে।
তবে এমন আশা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মিশরীয় সাংবাদিক ও কলামলেখক আবদেলাতিফ এল-মেনাওয়ে। 'হামাস আর ইসরায়েল কি শান্তির অংশীদার হতে পারবে? সেটা প্রমাণ করার জন্য দুপক্ষেরই একাধিক সুযোগ রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'স্রেফ প্যালেস্টাইনিয়ান ইসলামিক মাফিয়া, এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসার একটা সুযোগ ছিল হামাসের কাছে। তারা গাজা শাসন করার সুযোগ পেয়েছিল, সেখানেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারত তারা।
'কিন্তু একই সময়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের নিয়মিত অবৈধ দখল, দেশটির জাতিগত বৈষম্যের নীতি, বসতিস্থাপন ইত্যাদির বিপরীতে অপারেশন আল-আকসা ফ্লাডও কিছুটা প্রত্যাশিত ফলাফল ছিল,' বলেন তিনি।