ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ: শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পারে কারা?

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের চতুর্থ দিনে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, তিনি ইসরায়েলের গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক অবরোধের বিষয়ে 'গভীরভাবে ব্যথিত'।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, বোমাবর্ষণ কেবল শুরু হয়েছে। অর্থাৎ হামাসের হামলায় ৯০০ ইসরায়েলি মৃত্যুর ঘটনায় আরো কঠোর হওয়ার হুমকি দিচ্ছেন তিনি।
বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণের মাত্রা কমানোর আহ্বান জানানোর বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে।
ইসরায়েলের হামলায় তিন দিনে ৭০০ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। স্থল, নৌ ও আকাশপথে ইসরায়েলের অনবরত হামলায় ২৪ লাখ ফিলিস্তিনির এখন যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি ইসরায়েলকে গাজার উপর হামলা বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গাল্ফ স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক মাহজুব জাওয়েরি বলেন, আমার মনে হয় মধ্যস্থতার জন্য এটি আদর্শ সময় নয়, কারণ ইসরায়েল এখন পুরোপুরি রাগ ও ক্ষোভ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
তবে কোনো এক পর্যায়ে হয়তো কিছু দেশ, সংস্থা বা জোট মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখতে পারে।
আরব লিগ
বুধবার (১১ অক্টোবর) আরব লিগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জরুরি বৈঠকে বসবেন। জোটের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি প্রতিনিধির অনুরোধে এই বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে।
আরব লিগের মহাসচিব হোসসাম জাইকি বলেন, গাজায় 'ইসরায়েলের আক্রমণ বন্ধে' আরব লিগের ভূমিকা নিয়ে কথা বলবেন মন্ত্রীরা।
এই বৈঠকের সম্ভাব্য ফলাফল কি হতে পারে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
অধ্যাপক জাওয়েরি বলেন, আরব লিগের ভূমিকা নেওয়ার কিছুই নেই। তিনি বলেন, এটি (আরব লিগ) কেবলই আরব সরকারগুলোর প্রতিফলন।
চীন
যুদ্ধের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে চীন। পর্যবেক্ষকরা এখন দেখতে চাইছেন, সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে মধ্যস্থতার পর মধ্যপ্রাচ্যের আরো একটি সংঘর্ষে নিজেদের শান্তির দূত হিসেবে দাঁড় করাতে চায় কিনা বেইজিং।
এপ্রিল মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বলেছিলেন, শান্তি আলোচনার বন্দোবস্ত করতে প্রস্তুত চীন।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ব সীমান্ত অনুযায়ী দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই সমাধান বলে মনে করে চীন। যেখানে সার্বভৌম ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনাও করেছে বেইজিং।
মিশর
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার আগের সংঘর্ষগুলোতে কায়রো মধ্যস্থতা করলেও অধ্যাপক জাওয়েরি মনে করেন, মিশর এখন গাজার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিজেকের দূরে রাখার চেষ্টা করবে।
তিনি বলেন, সামনেই মিশরের জাতীয় নির্বাচন। এ কারণেই বর্তমান সরকার নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করবে।
ইউরোপ
জার্মানি ও ফ্রান্স সহ ইউরোপীয় নেতৃস্থানীয় কয়েকটি দেশ হামাসের হামলার প্রতি নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতেই যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়ে যাওয়ার কথা।
সংঘর্ষের ক্ষেত্রে ইইউ এর প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল ফিলিস্তিনের জন্য সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া। তারপর সংস্থাটি জানায়, এখনই বন্ধ না করে সহায়তার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেজ অবশ্য বলেন, এই ধরনের পদক্ষেপ (সহায়তা বন্ধের) গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্যই সহায়তা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
মঙ্গলবার একটি স্প্যানিশ রেডিওকে তিনি জানান, ইইউ এর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় থাকা হামাসকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বা এর মানুষদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
ইরান
মধ্যস্থতায় ইরানের ভূমিকার বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
ইরানের শীর্ষ নেতা আলি হোসেইনি খামেনি মঙ্গলবার বলেন, আমরা অবশ্যই ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেই। ফিলিস্তিনের তরুণ এবং সাহসী যোদ্ধাদের আমরা সাধুবাদ জানাই। হ্যাঁ, এটাই সত্য।
তিনি আরো বলেন, কেউ যদি মনে করে এ ঘটনায় ফিলিস্তিনের বাইরের কেউ জড়িত… তারা ফিলিস্তিনের ভালোভাবে চিনতে পারেনি। তারা ফিলিস্তিনকে খাটো করে দেখেছে। এটা তাদের ভুল।
কাতার
গাজায় সহায়তা দেয় কাতার এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে এর আগেও মধ্যস্থতা করেছে দেশটি।
কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি রয়টার্সকে বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার হলো রক্তক্ষরণ বন্ধ করা, বন্দীদের মুক্তি এবং এই সংঘর্ষ যাতে আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে না পড়ে তা নিশ্চিত করা।
তবে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা রয়াটার্সকে নিশ্চিত করেছেন, মধ্যস্থতার জন্য কোনো প্রচেষ্টা হয়নি।
রাশিয়া
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, ফিলিস্তিনিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনই শান্তির জন্য 'সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য' সমাধান এবং হামাস একাই যুদ্ধ চালিয়ে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
তুরস্ক
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষকেই সংঘর্ষ বন্ধ করে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন।
অধ্যাপক জাওয়েরি বলেন, যদি শান্তি আলোচনা শুরু হয় তাহলে তুরস্ক এবং কাতার উভয় দেশের সক্রিয় ভূমিকা থাকবে।
তিনি বলেন, আমার এমন অনুমানের কারণ, এই দুই দেশেরই হামাস এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমাদের দেখতে হবে কারা উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসাতে সক্ষম হয়।
জাতিসংঘ
শনিবারের হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই নতুন করে সংঘর্ষ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছিল জাতিসংঘ।
সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিদূত টর ওয়েনেসল্যান্ড গাজায় হামাস কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে এক্সে (সাবেক টুইটারে) লেখেন, গাজার মানুষজন, বিশেষ করে অতি সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আলোচনা এবং কাজ করছে জাতিসংঘ।
যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলের চরম মিত্র এই দেশটি তেল আবিবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান গাজার কাছাকাছি নিয়ে আসার পাশাপাশি ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়ার কথাও জানিয়েছে।
আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জন হেনড্রেন জানান, ফিলিস্তিনিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আলোচনা আপাতত স্থগিত করেছে ওয়াশিংটন।
ওয়াশিংটন বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চায়। তবে ইসরায়েলকে সম্মত করা সম্ভব হয়নি।
তবে জাওয়েরি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক করার মতো। তারা মূলত ইসরায়েলকে যা খুশি তা করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।